বিলাল হোসেনের সাম্প্রতিক অণুগল্পগ্রন্থ ‘জারজস্থান’কলকাতার সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। যারা অণুগল্পীয় বোধ,চেতনা ধারণ করেন তারা এই গ্রন্থের নামকরণেই অণুগল্পীয় সৌন্দর্য,সৌকর্য এবং আমেজ পাবেন বলে বিশ্বাস করি। এই গ্রন্থ উপলক্ষ্য করেই দু’চার কথা ।
অণুগল্প বাংলাসাহিত্যে নতুন সংযোজিত একটি বিষয় হতে মুখিয়ে আছে কেননা সামগ্রিক সৃষ্টিশীলতা শরীরে মেখে নতুন চিন্তাধারণা নিয়ে এর অবয়ব প্রকাশিত হয়েছে। বলা যায় অণুগল্প প্রথম দশক অতিক্রম করছে। যদিও কেউ কেউ এর আদি পিতা হিসেবে বনফুলকে কৃতিত্ব দিতে চান। কিন্তু বনফুল কখনও সজ্ঞানে তার লেখাকে অণুগল্প হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেননি। শুধু ‘স্বল্পায়তন’ বৈশিষ্ট্যের জন্যই বনফুলকে টেনে আনা হচ্ছে এবং আনা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। বক্তব্য হচ্ছে,স্বল্পায়তনকে কেন্দ্র করেই যদি অণুগল্পকে বিচার করতে হয় তবে বনফুলের আগেও রচিত হয়েছে ভুড়ি ভুড়ি স্বল্পায়তন;সেই অর্থে অণুগল্পও।
অন্যদিকে,একটু চোখ কান খোলা রেখে দেখলেই বনফুলের ‘ছোট ছোট ছোটগল্প’[এই নামটি বনফুলই উল্লেখ করেছেন তার গল্প সম্পর্কে] থেকে হালের অণুগল্প এক্টিভিস্টদের লেখার পার্থক্য নিরূপণ সম্ভব। মূলত রক্ষণশীল চোখে অণুগল্পের বিবর্তন ওইভাবে না দেখারই কথা। প্রকৃত ঘটনা হল—অণুগল্প বিবর্তনের ফল নয়। আর যদি মেনেও নেই তবে এর তত্ত্ব আর করণকৌশলের চিহ্নিতকরণ, প্রয়োগশৈলীর নির্মাণকারী প্রাণপুরুষ হলেন বিলাল হোসেন।
এবার আসা যাক জারজস্থান প্রসঙ্গে। বিলাল হোসেন প্রসঙ্গে।
বিলাল হোসেনের অণুগল্পের বিষয়বস্তু কী? কিইবা লেখেন তিনি? এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় খুব সহজ না,আবার সহজও বটে।
অণুগল্প নামক সাহিত্যের এই ধারাটি তার হাতেই প্রথম বিকশিত হচ্ছে। তার হাতেই পেয়েছে এর স্বতন্ত্র স্বর। বিশেষ করে অণুগল্পে রহস্যময়তার জাদুবিস্তারের মাধ্যমে তিনি অণুগল্পকে দিয়েছেন একটি স্পষ্ট অবয়ব। তার আগে কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারেননি অণুগল্প আসলে কী! এর অবয়ব,গঠন কৌশলইবা কী! অণুগল্পে কী কী বিষয় থাকা উচিৎ তা নিয়ে তিনিই প্রথম তুলে ধরেন অণুগল্প সম্পর্কিত লেখালিখিতে। শুরুর ম্যাজিক, রহস্যময়তা, উল্লম্ফন, বহুস্বর , কমপ্যাক্ট, বিস্ময়পরিণতি, অভিঘাত, গতিচিহ্ন প্রভৃতিকে তিনি অণুগল্প রচনার প্রধান অনুষঙ্গ মনে করেন। যা অত্যন্ত যৌক্তিক এবং এ ফর্মেটে লিখে সার্থক অণুগল্পের পরিচয় রেখেছেন। তার বিগত গ্রন্থসমূহ এবং বর্তমান অণুগল্পগ্রন্থে তার প্রমাণ মেলে।
তার লেখায় বিষয়বৈভব বিচিত্র পাশাপাশি থাকে একটি আপাত নিস্পৃহ গল্প বলার ঢং যা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব। তার ন্যারেটিভের প্রাণ বেসিক্যালি জাদুময়তা। তিনি বাস্তব আর জাদু মিলে এমন ঘোর তৈরি করেন যেখানে পাঠক বাস্তব এবং বিভ্রমের মধ্যে ভ্রমণ করে এক অত্যাশ্চর্য, রহস্য কুহেলিকায় জড়ায়। এবং রহস্যজট ভেদ করে পাঠক তৃপ্তি লাভ করে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়। তবে সেই রহস্যময়তা রহস্যগল্পের রহস্য নয়।
খুব স্বাভাবিক, সাধারণ শব্দে বেশ অনায়াসে পাঠককে বাস্তবতা-অবাস্তবতার বেড়া ডিঙিয়ে পরাবাস্তব জগৎ ঘুরিয়ে আনতে বিলাল হোসেন লাতিন আমেরিকার গল্পকারদের চেয়ে কোনও অংশে কম সিদ্ধহস্ত নন। পার্থিব এ-জগতের গল্প বর্ণনা করতে করতে কোন ধরণেরর ইশারা ইঙ্গিত না দিয়েই পা রাখেন অপার্থিব কোনো এক জগতে। বাংলাদেশে এই ধারায় কিছু কাজ রয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের রচনায়,এ ধারার আরও কয়েকজন হচ্ছে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, শহীদুল জহির প্রমুখ। তবে অণুগল্পের মত স্বল্পায়তন পরিমণ্ডলে সফলতায়, মুন্সিয়ানায় বিলাল হোসেন একক কৃতিত্বের দাবিদার।
জারজস্থান অণুগল্প গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘খাওয়া ও খাদ্যের গল্প’। এ গল্পের কিছুটা পাঠ করলে বুঝা যাবে কীভাবে তিনি গল্পে জাদু বিস্তার করেন-
‘সে নকশি কাঁথায় একটা নদী আঁকে। নদীটায় তিনটি বাঁক আছে।
নদীর পাশে গাছ। শীত মরসুমের নদী হওয়াতে নদী ভরা মাছ। ছোটো
বড়ো নানারকমের মাছ।
ইস্ কত মাছ! জোবেদা মনে মনে ভাবে।
রাতে হল এক কাণ্ড। শীতের রাত,নকশি কাঁথাটা জড়িয়ে সবাই
ঘুমায়। আর জেগে ওঠে মাছ।
ঘুমন্ত মানুষকে লাশ ভেবে ঠোকরাতে লাগল নকশি কাঁথার মাছগুলি।
শরীর থেকে দলা দলা মাংস খসতে থাকে।
ভয়ে চিৎকার করে উঠল মকবুল।’
গল্পের এই অংশে দেখা যায় জোবেদা একটা নকশীকাঁথায় আঁকা নদীটি বাস্তবে নদীতে রুপান্তরিত হয় এবং সেখানে মাছেরা মানুষের মাংস খায়। এর সমাধান স্বরূপ মকবুল বলে নদীর কিনারের গাছে মাছরাঙা,বক এঁকে দিতে। এতে সমাধান হয়তো হয় ঠিকই। কিন্তু চিল বকের শিকার হয় নিজেরাই। শেষ অংশ পড়া যেতে পারে।
‘…ছোঁ মেরে নিয়ে যায়
মাছের ছায়া। ছায়ারা মাছ নয়, তাই তারা লুকিয়ে পড়তে পারে না। তারা
বরং ছিঁড়ে যায়। ফুটো হয়ে যায়।
অসংখ্য ফুটো হতে হতে হতে নকশি কাঁথা পরিণত হয়ে গেল
জালে।
একদম ছোটোটি বলল একটু বড়োটিকে— ভাই, দ্যাখো আমরা মাছ
হইছি। জালে আটকা পড়ছি। হি হি হি।
জালের ভেতরে আটকে পড়ে রইল তারা।
ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসতে লাগল বক চিল মাছরাঙার দল। মাছ খেতে।’
এ গল্পপাঠ শেষে বোঝা যায় গল্পটা নিছক খাদ্যের নয়,খাদ্যশৃঙ্খলের গল্পও।
দ্বিতীয় গল্প ‘বাবারা’। অসাধারণ এক গল্প। বিলালীয় ধারার এ-গল্পটি সম্পর্কে সামান্য বললেও স্পয়লার হয়ে যাবে। চেতন ও অবচেতনতার মধ্যে এক মহাযাত্রার গল্প এটি। পিতার জন্য অষুধ আনার গল্পে তিনি ঢুকিয়ে দেন এক কিশোরের বর্তমান ভ্রমণ। শেষ মুহূর্তে মনে হয় পিতার অষুধ আনাটাই ছিল তার অতীত রোমন্থন।
‘মানুষ’ গল্পে মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর বিষয়-সম্পত্তির মৌমাছির জন্ম আর বিনাশ দেখিয়েছেন অবলীলায়। গল্পের বর্ণনা উল্লেখযোগ্য –
‘ জমি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ছেলে হল,মেয়ে হল। ছেলের আবার ছেলে হল;মেয়ের আবার মেয়ে হল। যে মেয়ে হল তারা বড়ো হল,যে ছেলে হল তারা বড়ো হল। বড়ো হওয়া সেইসব অনেক ছেলে আর অনেক মেয়েদের অনেক অনেক ছেলে মেয়ে হলে নিজ গ্রাম হতে পাশের গ্রাম হয়ে অন্যান্য গ্রামে বসবাস শুরু করল। আর এইভাবেই নাতি পুতি খুতি সুতি লুতি গুতি মুতি-রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল যত পুর-কান্দি-হাট-তলি আছে সবখানে,সব জায়গায়…’।
এই গ্রাম সেই গ্রাম হয়ে বিলাল হোসেনের সহজাত দক্ষতা। তিনি তার গল্পে বিজ্ঞান চিন্তা, বৈজ্ঞানিক মতবাদ তুলে ধরেন নিপুণ হাতে,সাহিত্যের মূলরসের কোনো বিচ্যুতি না ঘটিয়ে।
এভাবেই আশ্চর্য জগৎ সৃষ্টি করে বিলাল হোসেন সবাইকে সেখানে মোহাবিষ্ট করে ফেলেন। গল্প বর্ণনায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে সপ্তাকাশে চড়িয়ে সেখান থেকে আলতো ধাক্কা দিয়ে পাঠককে ফেলে দেন অথৈ সমুদ্রে। তবে সে পতন অত্যন্ত আনন্দের।
তার সৃষ্ট চরিত্ররা বিচিত্র,রহস্যময়। তার চরিত্র কাফকার চরিত্রের মত আনপ্রেডিক্টেবল,এবং স্থান এলিসের ওয়ান্ডারল্যান্ডের মত; কল্পনার জগৎ।
নুরুর মা গোসল করতে গেলে নুরু এক রেকাবী খুঁজে পেতে দুটো পাথর বের করে। এরা তারই দুই যমজ ভাই হীরা মানিক।
কিংবা ‘দৌড়’গল্পের কথক যখন দৌড়ে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ পাড়ি দেয় এবং মৃত্যুর পর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা যায় তার মৃত্যুর কারণ খিদে। তখন বুঝতে পারি এ গল্প হয়তো এ পৃথিবীর শুরুর দিকের গল্প;যখন পৃথিবী আজকের মতো বিভিন্ন মহাদেশে বিভক্ত নয়,একক প্যাঞ্জিয়া। কিংবা এ গল্প হয়তো চিরকালের। কেননা খিদা যে শাশ্বত।
‘খুনে গল্প’- এ এক শিল্পীর মৃত্যু যে কিনা পূর্বের রাতে নিজের ছবিটা এঁকেছে। সেই ছবি মুছে গেলেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে শিল্পীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সেই ছবি মুছে ফেলছে তারই আত্মজা।
‘মিসিংলিংক’ গল্প বেশ চিন্তা জাগানোর মত। সময়ের সাথে মানুষের মেটামরফোসিস। কোন এক সময়ের হিন্দুর মুসলিমে রূপান্তরিত হওয়ার গল্প। এ গল্পগুলো পড়ার সময় পাঠককে চেতনার জগতে থাকতে হবে নতুবা গল্পের মূল সুর ধরতে সময় লেগে যেতে পারে।
মোদ্দা কথা সুররিয়ালিস্টিক ধারায় রচিত তার অণুগল্পগুলো পাঠককে কী পরিমাণ বিষ্মিত, চমৎকৃত, বিহবল করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘পিতাপুত্র’, ‘একটি সম্ভাব্য অণুগল্পের প্লট’, ‘মহাপ্রভুগণ’, ‘জারজস্থান’ প্রত্যেকটি গল্পই স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে।
‘সম্পর্ক, অসম্পর্ক, না-সম্পর্ক’ এমন একটি অণুগল্প যা শুধু অনুভবই করা যেতে পারে। শুধু অণুগল্পে না খোদ বাংলাসাহিত্যে এরকম দ্বিতীয় কোন গল্প রচিত হয়নি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
‘পোস্টমর্টেম’ গল্পটা পড়ে যে কেউ ভাবতে বাধ্য জীবনানন্দের ভিতর-বাহির নিয়ে এভাবেও গল্প লেখা যায়! জীবনানন্দের পোস্টমর্টেমে আর কীইবা পাওয়া যেতে পারে!
‘দেয়ালের খোঁজে’ গল্পে দেখা যায় বিগলে চড়ে ডারউইনের অতীত ভ্রমণ। এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিনের মত। পূর্বেই বলেছি বিজ্ঞানমনষ্কতা তার লেখার বড় এক দায়বদ্ধতার জায়গা এবং অন্যতম স্বর।
এ-গ্রন্থে রয়েছে বিলাল হোসেনের চোরালো জীবন নামে অনন্য একটি গল্প যেখানে রয়েছে বিলাল হোসেনের গগনউড়া মাঠ,(সৈয়দ শামসুল হকের যেমন জলেশ্বরী)। সেখানে কিশোর আলাউদ্দিনের ব্যাগে ধানখেত-পাটখেত ,যুবক আলাউদ্দিনের ব্যাগে যৌবনের মমতাজ এবং বৃদ্ধ আলাউদ্দিনের ব্যাগে একরাশ শূন্যতা। গগনউড়া মাঠ সম্ভবত বিলাল হোসেনের এক মহাশ্মশান। মহাজাগতিক এক স্থান।
জারজস্থানে স্থান পাওয়া মোট ঊনপঞ্চাশটা গল্প নিয়ে কথা বলা যাবে না। দু’একটা বাদ দিলে বাকি সবকটা অণুগল্প বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন। এ বই সব পাঠকের হাতে পৌঁছা দরকার।
সবশেষে যা না বললেই নয়, বিলাল হোসেন বাংলাদেশের পথিকৃৎ অণুগল্পকার। অণুগল্পের চর্চা,প্রচার ও বিকাশের এক নিরলস কর্মী। অণুগল্প ও অণুগল্পকার সৃষ্টির লক্ষ্যে তৈরী করেছেন অণুগল্প গ্রুপ। ফেসবুক ভিত্তিক আর দশটি সাধারণ গ্রুপ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম একটি প্ল্যাটফর্ম। গ্রুপটি বাংলা সাহিত্যের নবীনতম শাখার আঁতুরঘর হিসেবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে।
অণুগল্পের জয় হোক।