রক্তবিজয়গীত
বাতাসের
সারা অঙ্গ ভেজা কার রক্তে?
অগ্নিজিহ্বা চেপে ধরে টুটি কার শক্তে?
প্রাতকুসুমের সব ঘ্রাণ ভিজে গেছে লাশপচাগন্ধে
কাঁপে ঘর থরথর লালন না হাছনের দ্রুতগতিছন্দে
বনকুয়াশার
বুক ছিঁড়ে উঁকি দিতেই কমলাবরন সূর্য
গর্জে উঠে বধ্যভূমি, কে রে তুই? ‘আমি রণতূর্য’।
হৃদয়ে হৃদয় খোঁজে জোছনাপ্লাবন-হৃৎ
গোধূলির ধূসরিমা গায় শোন রক্তবিজয়গীত
ঘরের
ভেতর মানুষ মানুষের ভেতরে ভয়
ঘরের
ভেতর মানুষ। মানুষের ভেতরে ভয়।
জানালা বন্ধ।
দরজা বন্ধ।
ছায়ায় বদ্ধ জোছনার কাঁপছে শরীর।
আমরা বড় দুর্দশাগ্রস্ত। আমরা বড় মন্দনসিবের জাত।
আমাদের ফুলগুলো বড় হতে হতে আর বড় হতে পারে না!
ঘ্রাণ ফুটতে না ফুটতে ঝরে যায়!
আমরা আর কখনো ঘ্রাণ নিতে পারি না
চরম রৌদ্র কী বিষ্টির দিনেও
এতটা বাড়াবাড়ি মেনে নেয়া দুষ্কর।
নিসর্গ! ইচ্ছে হয় জাতিসংঘের কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করি
খুলে বলি তোমার গোপন উচ্চাভিলাষ
আমরা
নিরাপত্তা চাই ফুল এবং সূর্যোদয়ের
আমরা উদোম মাঠের মতো সাম্য চাই
রাত্রি হলে, আমরা আমাদের অঙ্গনে কুকুর চাইবো কেন?
আমরা কুকুরবিহীন রাত্রিযাপন চাই।
কাকা চাই না।
ডাহুক-শালিকের বুকের তলদেশ থেকে ভেসে আসা
নরম শব্দের কোমল গন্ধ চাই
বাজ পড়ুক চাষার মাথায়-
এটা আমাদের কাম্য নয়, তবুও বাজ পড়ে
মানুষ
ঘরের দিকে ছুটে পালায়!
মানুষ বুকের ভেতর কফের মতো ভয় ক্রমশই বাড়তে থাকে
মানুষ ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে
আন্তরিক কাঁপতে থাকে
যেন এই কম্পনটুকু ছাড়া মানুষের আর কোনো
দায়দায়িত্ব নেই-সহায়সম্পদ নেই
শুধু
কাঁপা,
কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারের পরিধি আরেকটু বাড়িয়ে দেয়া!
লাল
রঙের নদী চাই
আমার
একটি লাল রঙের নদী চাই
লাল ঢেউ লাল স্রোত
রক্তক বাতাসে নৌকোর মতোই
হাজার বছরের রক্তসাগর
সাঁতার কাটবে এই নদীটির বুকে
গতরে ফুটবে না ভাটা
সহসা জলশরীরে জ্বলে উঠবে দ্রোহের প্লাবন
ছিঁড়ে যাবে মৃত্তিকা-
উঠে আসবে ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, নজরুল, প্রীতিলতা …
নীহারিকা গাইবে কোরাস :
চোখ যার চোখ নয় দ্রোহের প্লাবন
রক্তের ভেতরে নাচে উষ্ণ রণাঙ্গন
দ্রিম দ্রিম শব্দ যার প্রিয়তম গান
কুসুমিত যুদ্ধ তার প্রাণাধিক প্রাণ
মরুর বুকে ফুটাব এবার ফুটাব মরুদ্যান
নদী
চাই নদী চাই
ফাগুনের চোখ …
গন্তব্য
শুধু
প্রয়োজনেই উঠে আসবে এরা দাড়ি-কমার মতো।
লালনের বুকের ভেতর আছে এক অচিন পাখি,-
ঠিক এইভাবে যদি কেউ পাখিদের সান্নিধ্য চায়
আল্লাহর কসম লাগে, গার্ড-অব-অনার দেবোই দেবো।
কিন্তু আমরা তো যাচ্ছি অন্যভাবে।
পাখির বুকের ভেতর আছে এক লালন ফকির, এইভাবে-
যে-কারণে আমাদের সব ধান গোলায় আসছে না!
হ্যাঁ,
কারো সাথেই আমাদের বৈরিতা থাকবে না-
মেঘ, বৃক্ষচ্ছায়া, রোদ, জোছনা, ফুল, পাখি, নদী …
আমরা সবার কাছেই যাব; সবারই কুশল কামনা করব
কিন্তু এক শর্তে-
আমাদের সবকিছুই মানুষ এবং জমিন দিয়ে শুরু হবে-
মানুষ এবং জমিন দিয়েই শেষ হবে-
বাকিরা অনুষঙ্গ মাত্র- এই যেমন
আমরা মেঘের কাছেও যাবো তবে সরাসরি যাবো না
‘জমিন অইল টুডাফাডা’- ঠিক এইভাবে যাবো অর্থাৎ
আগে তো ভাত চাই, পিঁড়িটা পরে।
লাল
রঙের সালাম
ধুলোর
নিচে শুয়ে আছে খণ্ড খণ্ড তালেবানি রোদ
একচিলতে মেঘের ভাঁজে সূর্যোদয়
এবং হেমন্ত-বাতাসের হৃৎস্পন্দ, এ-জন্যেই
বৃষ্টিকে
বড় স্নেহ করি
বৃষ্টিকে বড় ভয় পাই
বৃষ্টিকে বাপ-মার এবং মৃত্তিকার মতো শ্রদ্ধা করি, জানি
ধুলোর
নিচে শুয়ে আছে কতিপয় অনাথ নদ-নদী
ধুলোর নিচে শুয়ে আছে কুয়াশার মতো জ্যোৎস্না
ধুলোর নিচে শুয়ে আছে অজস্র দ্রৌপদী
ধুলোর নিচে শুয়ে আছে অজস্র ধ্রুপদীপ্রাণ দেশপ্রেম এবং রুদ্রপ্রলয়সমূহ
বাতাসের পিঠে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে লালনের একতারা
পদ্মার নির্জন বোটে রবিঠাকুর নেই
রবিঠাকুরের নির্জন বোটে শঙ্কা ছড়ায় অগণন অগ্ন্যুৎপাত
ঘুমের ভেতরে জেগে ওঠে লালনের একতারা
ভেঙে যায় যাত্রাগানের জল্লাদের হাসির মতো জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ
সুর তার জানান দেয় পাথরে ফোটে না ফুল
সত্যের কাছে প্রণত হয় থোকা থোকা স্বদেশ-
‘একই আকাশ একই বাতাস’ কাঁধে নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরোয়
মাতৃস্তনের মতো মৃত্তিকার মতো ভালবাসাবোধ
পদ্মার বুকে লাফিয়ে ওঠা, ইলিশের রুপালি শিহরণের জন্য
লাফিয়ে উঠে ‘স্বর্ণজ্যোতি’
সুপারি গাছের মতো ডালপালাহীন গগনচুম্বি একটি বৃক্ষ-
কী নাম তার?
কানে বাজে চারটি গায়েবি আওয়াজ
একটি ঘর
একটি উন্মুক্ত জানালা
একটি ভোর এবং
একটি সূর্যোদয়
ধূলোর
নিচে শুয়ে থাকা খণ্ড খণ্ড তালেবানি রোদ
বাতাসের দেহে গেঁথে দেয় দীর্ঘশ্বাসমুক্ত টুকরো টুকরো নদ-নদী
যারা দ্রুতলয়ে ছুটে যায় এবং মুছে দেয় হাজার বছরের
মহাসাগরের সবটুকু ধূসরিত বিরহ-বিচ্ছেদ
রবীন্দ্রনাথও ছিড়ে ফেলেন সেই কবিতাখানি-
‘ছুয়ো না ছুয়ো না ছিঃ
ও যে চণ্ডালিনীর ঝি
ঘরেতে উঠিলে নষ্ট হবে দই’…
লালনের একতারা জানতে চায় বিশ্বপ্রকৃতির কাছে
‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বুদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে’ ….
ছিড়ে যায় ধূলিকণা- তালেবানি রোদ এবং
অচেনা বৃক্ষ কহে, আমার নামই অভেদসুন্দর!
কূজনগৃহ
গাঢ়
নীল নিশুতিতে একাকী বসে দাবদাহে বুণে বরষা
পৌর্ণমাসীর হৃদয়ে জমে রাশি রাশি ধোঁয়াশা
নীল আকাশের সব নীল উড়ে যায় বিদ্রোহী বাতাসে
শীতার্ত শিশির তবু খোঁজে উষ দূর্বাঘাসে
সহসা
ঘুমের ভেতর থেকে জেগে ওঠে মন
আঁধার-প্রসবঘরে ঢেউ খেলে জোছনার প্রাণ
ক্ষেতের আলে ভাঙ্গনের শব্দে জাগে সাম্যের ঘ্রাণ!
আমাকে জড়িয়ে ঘুমায় ঘন শশীবন!
ধারাপাত
প্রত্যেকের
জীবনে একটি শেষদিন থাকে
পুলকেরা ঝরে যায় ঝরে যায় শশীবন
নদীগ্রাস চরে-চরে
সারা ঘরে ঢেউ খেলে ধূসরা প্লাবন
টগবগে খরানের গহ্বর কাড়ে ভয়াল শ্রাবণ
সবুজাভ বাতাসের ঘ্রাণে বাজে ভাঙনের শব্দ;
ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে
ফুলসজ্জার মতন থোকা থোকা গাছ
সূর্যাস্ত-দিনের বাঁকে