চাঁদের
চুমু
চাঁদটা
ছিল আমার দুহাত সামনে।
তার সমান্তরালে হাঁটবো বলে দ্রুতি বাড়িয়েছি যতো
ততই দূরে সরে গেছে সে।
আহা চাঁদ, সোনালী অধরা আমার, ক্লান্তিই ছিল তোমার শেষ উপহার!
একদার কিশোর এভাবেই জেনেছিল,
উল্টোযাত্রায় নিজের পথে কিভাবে কাঁধে ছোঁয়াতে হয় চাঁদের চুমু।
মায়ের মমতাঘেরা চোখ কতটা একান্ধ হলে
সৃষ্টি পৌঁছে গন্তেব্যে,
ওকথা ভুলিনি আমি!
আমার বাউলিপনায় তিক্ত বাবা যখন রাতের ছিটকিনি তুলে
ঘরকে করতেন বাহির,
মা তখনো খুঁজে পাওয়া চাবির ঘোছার মতো
গলি থেকে আমাকে কুড়িয়ে বেঁধেছেন সযত্ন আঁচলে,
ওাতের গভীরতাকে বুকে টেনে
সঙ্গোপনে তাড়িয়েছেন আমার দুবির্নীত উপোস;
যেন কতদিন খাওয়া হয়নি তার!
প্রগাঢ়
সবুজে উজ্জ্বল বাউলের মতো আমার সুগন্ধি মা যেন
নাড়ীর টানেই বুঝতেন,
এঁদো ডোবা আর ঝোপ-জংলার ভিতর ঝিঁঝির ডাকই সত্য ভাষণ।
আমি ভুলিনি ওসব কথা।
সকল গ্লানিকে উপেক্ষায় ঠেলে আজো তাই ব্যাঙ ডাকা ঘোরেলা সন্ধ্যায়
এ মাটির উর্বরা গভীরে পাতি কান,
আধাখেচরা নগরীর কুশনে নিবিড় আস্থায় রুয়ে যাই
সূঁচালো ডগার জ্বালা;
যেন বসলেই মনে পড়ে যায় অনুপম সবুজে ঢাকা তোমার নিঝুম মা-এর মুখ!
আমার
সব্জিবাগান
ভাল
ফলনের পূর্বশর্ত মানসম্মত বীজ।
একটি সব্জিবাগানের জন্যে আমি তা করেছি।
সময়ের উপাত্ত থেকে মাটিকে কর্ষণও করেছি সযত্নে।
অথচ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছি,
বীজ ফোটার আগেই আমার ভূমি ছেয়ে যাচ্ছে আগাছায়।
তবে কি বীজ ফোটবে না?
আমি উদ্বেগে অপেক্ষায় থাকি।
অবশেষে
আমার সকল সংশয় দূর করে ওদের আত্মশক্তি ক্রমশঃ মাথা তোলে, মেলে পাখা।
ওদের বর্ধিষ্ণুতর শরীর আগাছাগুলোকে ছাড়িয়ে গেলে আমি মনযোগ দেই নিড়ুনিতে।
কিন্তু আগাছাগুলো এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত যে
আমার শ্রমকে পণ্ডশ্রমে ঠেলে দিতে ওদের মোটেও বেগ পেতে হয় না।
তাই নিড়ুনির ফাঁকে আমি ওদের বিনয়ের সাথে বলি –
ভায়া, পৃথিবীতে এত চারণভূমি থাকতে আমার ব্যক্তিগত কামরায় উঁকি দেয়া কেন?
ওরা হেসে লুটিপুটি, এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে! বলে-
আমরা ছোটপ্রাণ, ওসব তত্ত্বকথা বুঝিনে, এভাবেই বাঁচি;
বেশী বললে আমাদের নগ্ন জনপদে তোমাকেও ন্যাংটা করে ছাড়বো।
আমি
ভয়ে আর কথা বাড়াইনে। নিয়ত সংগ্রামরত থাকি। নিভৃতে। নিঃশব্দে।
তবে অবশ্যই বিষ প্রয়োগের বিরুদ্ধে।
কেননা মৃত্তিকায় ঠিকঠাক ঘুমপাড়ানো গেলে ওরা ম্যানগ্রোভের প্রেরণা।
একসময়
অনুভব করি
আমার সব্জিগাছ সাবলীল হয়ে ওঠছে।
ওদের শিকড় ডানা মেলছে মৃত্তিকার গাঢ় এবং গভীর অন্ধকারে।
আর তার ছায়ায় ক্রমশঃ দুর্বল আগাছাগুলো সপ্রশংস বিস্ময়ে দেখছে আমার ফলবান
সব্জিবাগান।
শিল্প
অজগরের হা-এর ভিতর মৃতপ্রায় নদীর পাশে একজন জন্মান্ধ ভিক্ষুক এইমাত্র এসে বসল তার প্রতিদিনকার গ্রামীণ পথের বাঁকে। তুলনামুলক পরিচ্ছন্ন পরিপাটিতে মুখে তার খাওয়া শেষের তৃপ্তির ঢেকুর। দানপাত্রটিও আজ ঘষে-মেজে বেশ ঝকঝকে, আত্মপরিচয়ে এলুমিনিয়াম; মুদ্রাপতনের শব্দ আজ শ্রুতি থেকে বুক-অব্দি বেশ ঢেউ খেলে যাবে! এক্ষণে তার ডেবে যাওয়া অংশগুলোগুলোকে টিপে টিপে ঠিকঠাক করে নিচেছ সে। হা হয়ে যাওয়া ভাঙ্গা কার্নিশটুকুও মিশিয়ে নিলো সযত্নে। পায়ের পাতায় অনুমেয় ঝরাপাতাগুলোকে সরালো যথাসম্ভব। মানানসই ভঙ্গিমায় রাখলো হাতের লাঠি। যেন আনমনে দেখিয়ে দিল শিল্পের প্রতি মানুষের সহজ অঙ্গিকার।
কিন্তু
এসব উজ্জ্বলতাকে ছাপিয়ে রাগাশ্রিত সুরের আলাপ শেষে এবার সে গাইলো; তার ম্লান এবং
ধুলিময় কণ্ঠ মৌলিক শিল্পের দিকে।
পাথরের
যোজন ছিঁড়ে
নীল
আকাশে মেঘের পলেস্তরা
যেমন ভাসে, ভাসছে।
টুকরো কাগজের মতো একঝাঁক পাখি
যেমন ওড়ে, উড়ছে।
ওদের কণ্ঠ থেকে পিয়ানোর রীডে
পরিণত আঙ্গুলে ছোঁয়ালে
যেমন লাবণ্য-শব্দ ঝরে, ঝরছে।
যেন পাথরের যোজন ছিঁড়ে
ওরা আজ নিজেরই জন্যে
পাগল হবার, হয়েছে।
হাওড়ের
হিজল গাছটি
যতদূর
চোখ যায়
হাওড়ের হা করা বাতাস কানে কানে
সীমাতিক্রান্ত শূন্যতাকেই ডেকে ফিরে যায়।
তার মাঝে একটি, শুধু একটি হিজল গাছ ভীষণ একলা,
বিপন্ন দাঁড়িয়ে আছে।
যেনোবা অন্তর্লীন বেদনার পলিতে বেড়ে ওঠা
একথোকা বিষণ্ণতা, একাকীত্বের বান্ধব!
তার ঝাঁকড়া পাতার উড়ো চুলে থমকে আছে
দীর্ঘ প্রান্তরের কান্না।
তাকে ঘিরে ছায়াপথের গন্ধমাখা নিঃশব্দ রোদ, একাকী ভাঙছে পাড়।
দূরে অলস চারণছবি, আবছা স্থির গ্রাম
সব, সব তারই একলার গানে মুখরিত।
অথচ
তার শাখায় পাখি গাইছে স্বতঃস্ফূর্ত গান।
তার সুর রোদেলা ঢেউয়ে জলের চুমকি,
প্রাণের শিহরণে আকাশের রঙ।
যেন নিজেকেই অনুভব করে অস্তিত্বের অন্তহীন গভীরে!
তবুও
প্রান্তরব্যাপী চৈত্রদগ্ধ বিশাল শূন্যতা অতিক্রান্ত নয়।
নিশুতির
আসন্ন অন্ধকারে,
কোথায় পালাবে তার ভয়ার্ত হৃদয়, যখন পাখিগুলো গাইবে না গান?
মনে কি পড়বে তখনো
বাদুরের ডানার বিস্তৃত ছায়ার ফাঁকে তারাদের দয়ার্দ্র চোখ?
নাকি আত্মার খোলস ছেড়ে সেও নির্ভার ডুবে যাবে
আরো গভীর কোন শূন্যতায়?
থাকবে
শুধু সুনসান বাতাস, বাতাসের প্রবহমান কান্না!