পর্ব এক.
শাওনের মেঘ জলস্তম্ভের মতো আকাশে ঘুরপাক খায়; ঘষে ঘষে ওড়ে। তখনো মাঠটি কাদায়, জলে আর মানুষের হুড়াহুড়ির দাপটে এলোমেলো হয়ে আছে। মিহি-তরিকার বৃষ্টি আর প্যাক-কাদার গন্ধের ভিতরই লাইন করে দাঁড়ায় ওরা। মিছিলের এ লোকগুলো বহরমপুরের রকিব উদ্দীন প্রফেসরকে মুক্ত করতে এসেই এখানে আটকা পড়ে। এখন তারা অপেক্ষা করে এবং তাদের এ অপেক্ষার নানাবিধ পর্যায়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় বলেও ধরা যায়। সেই শ্বাসের সঙ্গে ঘাম লেপ্টে রক্তবিন্দুর মতো নোনতা ঘ্রাণ ছড়ায়। ওদের শরীরটা ঝুঁকে আসে। শিরা-উপশিরা আর হাড়-মাংস ক্রিয়াহীন হতে থাকে। কাদা ওঠে আসে পায়ের পাতা, পা-হাঁটু ছাড়িয়ে লুঙ্গিতে। মিছিলের লোকগুলোকে এসব চিহ্ন ধরেই শনাক্ত করায়।
মহকুমার বড়োসাহেব আর পুলিশের কর্তাব্যক্তিটির নড়াচড়ার কোনো নমুনাই নাই। হেলে-যাওয়া-দুপুরের মেঘভেজা রোদও বড়োসাহেবের কালো শেরওয়ানিতে, এর বেগুনি-ঘেঁষা-কালো বোতামে আর মাথার মাঝখানে- ডুব-দেয়া মখমলের টুপিটায় ছড়িয়ে আছে। ইউনিফর্মের বাইরে যে-টুকু মুখ খালি পড়ে আছে, তাতে থ্যাবড়ানো নাকটির নিচে ঘনঘাসের মতো গোঁফও আছে পুলিশের কর্তাটির। ক্যাপটি দিয়েই পাকা চুলসমূহকে জব্দ করছেন অনবরত। ওদের ফাইলটি পুলিশের কর্তার পাশের লোকটির হাতেই; ফিতাটি এমনই টাইট করে গিঁট দেয়া যে, এর মাঝখানটা দেশি নৌকার পেটের মতো ভিতরে ঢুকে গেছে। ২২ জনের যে শ্বাসটুকু বেরোয়, তা ঐ ফাঁকটুকুর জন্যই। পুলিশের কর্তাটি পেট-খালি-করা-শ্বাস ছাড়ে ফের। ঠোঁটের ফাঁকটুকু নাড়িয়ে কথার জামিনদারীতে মন দেন – ইয়েস স্যার, ভেরি পাওয়ারফুল মিসক্রিয়েন্টস স্যার। এমন চার্জশিটই আপ টু ডেট করব, কুত্তার বাচ্চা শালার নক্সালদের যেন তামাম জিন্দেগিভর লাল-দালানেই পইচা মরতে হয় হাঃ হাঃ হাঃ। আপনি স্যার হোম-মিনিস্ট্রিকে ডিটেইল ইনফরমেশনটা দিয়া দেন। এখনই ফোনে কনফার্ম করুন … প্লিজ। …হাউ স্ট্রেঞ্জ …! স্যার, আপনার চেম্বারে অ্যাটাক! ভয়টাকে পূর্ণ উদ্যোমে চেনানোর জন্য ষোলআনা মনোযোগ দেয় এদিকে। আবারো পুলিশভ্যানগুলোকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানোর অর্ডার দেয়।
ওদের ২২ জনকে ঠেসে-চিপে ঢুকায় পুলিশভ্যানের একেবারে ভিতরে। মেঘলা রোদের যে-টুকু তাপ আর আলো থাকে ওদের শরীরে, তাতেই চারপাশে আরো এক কুয়াশার প্রলেপ নামে! শ্বাসের শরীরে শ্বাস পেঁচিয়ে যায়। ওরা আরেক ধারণায় নিজেদেরকে চিনতে শুরু করেছে। একসময় ঝাপসা অন্ধকারের আবরণ পড়ে চারদিকে। এবং অন্ধকারই ওদেরকে মিহি-লবণদানার মতো আলো ছড়ায়! শরীর দিয়ে শরীরের তাপ টানতে থাকে। ক্রমে রোদ বাড়ে। চামড়াসমূহ সেই তেজ শুষে নিতে থাকে যেন। বর্ষার কাদা-জল সরিয়ে-পেঁচিয়ে, গোয়াড় রোদকে কাঁপিয়ে, গাড়িটা স্ট্রার্ট নেয় এক সময়। সামনের আর পিছনের পুলিশে-ঠাসা-ভ্যান দুটি মাতাল-দুপুরকে নাড়িয়ে চলতে থাকে। হঠাৎ এ শ্লোগান কে ধরল? বাইশ জনের ঘামে-ভেজা এ দলটি মহকুমা শহরটাকে শিরশির কাঁপুনির ভিতর চুবিয়ে আবারও শ্লোগান ধরে …
জেলের তালা ভাঙব - রকিব ভাইকে আনবো
এস.ডু শালার গদিতে - আগুন জ্বালো একসাথে
মুক্তি আসে কোন্ পথে - নক্সালবাড়ির ঐ পথে
জোতদার মহাজনের গলা কাটো - সমাজতন্ত্র কায়েম করো...
জনমানবহীন দুপুর, দোকানপাট, গার্লস কলেজ, রঙমহল সিনেমা, মুক্তিযোদ্ধা অফিস, স্টেডিয়াম, বি.এ.ডি.সি অফিসেরও পর আমতলা। এখানকার অন্ধকারটুকু আরো জমাট বেঁধে আছে। এমনই আন্ধারে ওরা নামে। এ-সবকে সরিয়ে দূরে রাখলে, তেরো শিক সাত দরজার প্রথম দরজাটি হো-হো-শীতলতার ভিতর ক্যাড়ক্যাড় করে খুলে যায়। ওরা এগোয়; কোমরের মোটা রশি আর হ্যান্ডকাপও পিরপির করে উত্তরদিকে এগোতে থাকে।
ডেপুটি জেলার হাতের কব্জি ধরে টেনে না-তুললে তখনই লম্বা-চওড়া একটা ঘুম শুরু করে দিত মামুন। হাত থেকে তার সারা শরীরে এক কাঁপুনির বিস্তার ঘটে। সেই কাঁপুনিতে সারাদিনের শুধু-চা-নাস্তা-খাওয়া-পেট থেকে ট্রেন-জার্নি, শ্লোগান-মিছিল, পুলিশের ধোলাই, জেলখানার খাতায় নাম উঠা – সবই মিলেমিশে যেতে থাকে। অফিসটায় ঢুকতে পারবে তো সে? কম্পাউন্ডার কাজল ঠোঁটের কোণে বাড়তে থাকা হাসিটুকুকে ভেজাভেজা ঠোঁট থেকে ঠেলে জিবের মাঝখান থেকে সরিয়ে পেটের গর্তেই শুধু চালান করে দেয় না, মুখের সবটুকু সচলতা যথাস্থানে ফিরিয়ে ইমার্জেন্সি ডাক্তারের দিকেই যথাযথ মনোসংযোগ দেয়। জেলের পুলিশ জলিল মিঞাসাহেব ২২ জনের ভিতরকার রতন নামের কিশোরটিকে কলা-বিস্কুট খাওয়ানোর ধান্দায় কতটুকু মনোযোগ দিতে পারল; এ সব অবজার্ভ করা কি আর তার এক্তিয়ারে পড়ে? দুই-মানুষ-লম্বা জেলখানার ওয়াল পেরিয়ে মরারোদ ভিতরে ঢোকার যেন ফুরসতই পায় না। বাইরের কমলা-রঙ-বিকাল এখনো রোদ-কাদা-জল দিয়েই তৈরী। জেলার, ডেপুটি জেলার, এমন কী ওয়ার্ড ইনচার্জ মৌন-চঞ্চলতার ভিতর তাদের গাম্ভীর্য ছিটিয়ে রাখেন। তেরো-শিকের ভিতর সমূলে না ঢোকা পর্যন্ত কোমরের রশি কিংবা হ্যান্ডকাপ এক আনাও সরে যায় না। ইমদু মেট আবারও একটা গুণতি দিয়ে ফেলে। মুনির আর শ্যামলালের গা ঘেঁষে জেলার প্রকাশ রঞ্জন সাহা দাঁড়িয়েই থাকেন। কেন? কী অত পাহারা দেয় পাছায় পাছায় ঘুরে? কী যে মধু পড়ে আছে এখানে? মোমালি কি এই প্রথম ঢুকল এখানে? তার কী এসব দেখা নেয়? হায়রে! সারাদিন চিল্লিয়েও হারামজাদাদের পাত্তাই পাওয়া যায় না।
ওদের এভাবে অ্যারেস্ট হওয়ার খবর তো সারা জেলখানায় দুপুরের খাবার দেয়ার পরপরই হয়ে গেছে। রাত বারোটার আগে যে ১ নম্বর সেলের গমগম আওয়াজ কমে না; সেই সেলে পর্যন্ত শুরু হয় অজানা কিসিমের ফিসফিসানি! এস.ডি.ও সাহেবের এজলাসে গণ্ডগোল! হাজার হাজার মানুষ কোর্ট ঘিরে ফেলেছে! এস.ডি.ও-পুলিশ-উকিল-পেশকারের গদিতে নাকি আগুন দিয়ে দিয়েছে? শালার এস.ডি.ও. নাকি অফিসবন্দি? ৩ নম্বর সেলের রকিব প্রফেসরকে আজকের মধ্যেই নাকি জেল থেকে বের করবেই করবে! আরে বাপরে, বহরমপুরের মানুষকে অত তেল আল্লায় দিছে! কাজল ইচ্ছে করেই তখন ৩ নম্বর সেলের দিকে ফিরেও তাকায়নি! রাইটার খাদেমকে উল্টা ধমক চুদায় – তর অতো পাছা কাওজ্জাইলে, তুই যা, রকিব প্রবেসাররে তর পাছার কাপট্টা তুইল্যে দে।
তার রাগের কারণও আছে – ৩ নম্বর সেল থেকে ১০টা মাস পরে কার জন্য বেরোতে হলো? কার জন্য ২ নম্বর সেলে ঠাঁই নিতে হলো? ঐ প্রফেসর রকিব, শাকিব রেজা চৌধুরী আর তাদের ৩ সাগরেদের জন্যই তো। ৫ শ’র অধিক আসামির চোখ এখন তো ৩ নম্বর সেলের দিকেই! জেলার, ওয়ার্ড ইনচার্জ মিঞাসাহেবরা এমনকি মেটদের দৌড়ঝাপ-লাফালাফি-পাদাপাদি দেখে কে! সিভিল সার্জন অফিস থেকে যখন তাকে ড্রেসিং মেটেরিয়েল নিয়ে প্রিপেয়ার থাকতে ম্যাসেজ পাঠানো হলো, তখনই তার বোঝা হয়ে গেছে, ব্যাপার তা হলে গুরুতরই?
কোর্টের পক্ষে ৩ নং কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট যখন সবশেষ সইটি জেলারের সামনের ফাইলটাতে করে ফেলেন তখন সন্ধ্যাও মরে গেছে। আমদানি ওয়ার্ডে ফাইনাল গুণতিটি দেন জেলার নিজে। ৪ জন করে ১ ফাইল। ৫ ফাইল + ২= ২২ জন। জেলারই ভাগ করে দেন – ৭ জন যাবে ৩ নম্বর সেলে। কটকটে-হলদে আলো আসতেই থাকে। ইট-রং দেয়ালে সেই আলো ধূসর রঙ বিলায় কিংবা ফ্যাকাসে হতে হতে সারা জেলখানাকেই ডুবিয়ে রাখে।
অফিসটা পেরোতেই যে মানুষটি শ্লোগান ধরে, তাকে আধমাইল দূর থেকেও শ্যামলাল বলে অতি সহজেই সনাক্ত করা যায়। সারা জেলখানা শ্লোগানের রোশ্নাইয়ে কেঁপে ওঠে। নলক‚পটা বায়ে রেখে ৪ নম্বর সেল আর রান্নাঘর ডানে ফেলে ইঁদারা পেরিয়ে মিছিলটি এগোয় ৩ নম্বর সেলের দিকে। স্পেশাল অর্ডারের দরজা হুড়মুড় করে ফাঁক হয়ে যায়। ১০ বাই ৬ কদমের রুমটাতে ঠেসে ৯ জনকে ঢুকায়। শিকঅলা দরজাটি লক করলে, ছড়ানো-ছিটানো ঠাণ্ডায় গরমের সর পড়তে শুরু করে। সেদ্ধ-ভাপ-জমা পঁচাভাতের ঘ্রাণ, খসে পড়া শ্যাওলা রং প্লাস্টারে জমা হতে থাকে। ড্রেনের গন্ধ জমে শিক ভাঙ্গা মর্চে-ধরা জানালায়। জানালাটির ৫টা শিকের ৩টা নাই। মাথার উপর বাতিটি ঝুলে রং-নিভা দুটি তারকে ধরে। কখন জানি পুট করে ঝরে পড়ে! সন্ধ্যারও পরে, কাঁচালেট্রিনে ৩ বালতি পানি মারল হরিধন সুইপার। শালা নিজের মা-টাকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে জেলে ঢুকলে কী হবে, ১ বোতল বাঙলা মদ পেটটাতে ঠাঁই দিতে পারলে আর দিশামিশা থাকে না, গাধার মতো গু-মুত-ড্রেইন সাফ করতে থাকে। মুনির, শ্যামলালদের ছাড়িয়ে বাকী ১৫ জন ঢুকে পড়েছে ১ নম্বর সেলে তারও আগে।
বাল্বের আলোতে পড়ে গায়ের সঙ্গে গা লাগানো ৯ জন মানুষ স্পষ্ট হয়। বাইরের হাজার-পাওয়ারের-লাইটের সঙ্গে ৬০ পাওয়ারের আলো চেঁচায়। হলদে-কামেলা-আলোতে টাটায় মামুনের ডান হাঁটুর জখম। চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরে এখনো – মিহিতালে। ভ্রাম্যমাণ নীরবতা আটকে যায় ন্যাংটা সেলটাতে। গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের তাপে ব্যথাটা কেবলই বাড়ে। এখন তার মেজাজটা পূর্ণ-উদ্যোগে পেতে থাকে হারামজাদা শরীফের উপর – কাদা-জল পয়-পরিষ্কার করা আর হাত-মুখ-মাথা ধুইতে জগের সবটুকু পানি সাবাড় করতে হয়? ঘুষি মেরে নাকের নক্সাখান ছেঁচে দিতে ইচ্ছে করছিল মামুনের। ইস্রে বড়োলোকের ঝাট! এখন একজন পানি আর বালের ব্যথার একটা সাধারন টেবলেট ম্যানেজ করে কী করে? ঘণ্টাখানেক আগের আতরালী সেন্ট্রিটা থাকলেও না হয় জগটা লোহার দরজাটার নিচ দিয়ে পাস্ করে চাপকলের পানি আনিয়ে নিতে পারত। এখন ডিউটি-করা-মিঞাসাবটার যে কিসিমের মেজাজ, শালাকে বলে আবার কোন ফ্যাকড়ায় না পড়ে! ব্যথাটা আবারও চেততে থাকে। রকিব স্যার বা মুনির ভাইকে ডাকবে নাকি? এত রাতে তাঁরা ঘুমাল, আবার ডাকবে? বাল্বের তাপ আর ৯টা মানুষের শ্বাসের ঝাঁজ কি তার থেঁতলানো হাড়-মাংসে আসর জমাল!
এত জোরে দরজায় ধাক্কায় কোন হালায়! তা-ও আবার মাঝরাতে! রকিব স্যার শুধু নন, সারা সেলটাই চমকে ওঠে! শব্দটা প্রথমে পায় শরীফ। তার ঘুম রসুনের বাকলের মতোই চিকন। শব্দটা ভিতরে আছড়ে পড়তে না পড়তেই করিম ওস্তাদের চিৎকার দ্বিতীয় বারের মতো তামাম ঘুমকে থেতলে দেয় – ওই! বাত্তি জ্বালাইলো কেডায়? নিবাও বাত্তি। মাঙ্গির পুতাইন, শখ কত। পাছার মাইদ্যে ছুতরা পাতা লাগানি দরহার। ব্যথাটা আবারও বাড়ে মামুনের। তাহলে ও এখন কী করবে? এত্তো রাতে কাকে জাগায়। নাকি সেন্ট্রিটাকে ১টা টাকা ধরিয়ে দিবে? এও কী শোভা পায়? দেখে-টেখে ফেললে কেউ? আবার পাঁজর-ঘেষা তীক্ষ্নশ্বাস বেরোয়। শ্যামলাল কী করে ঘুমায়! রাইফেলের পাছা দিয়ে ওকে যে একটা গুতা দিয়েছিল মোচঅলা পুলিশটা, মামুনকে এমন একটা মারলে কী যে হতো!
শ্যামলাল রকিব প্রফেসরের সঙ্গে একমত হতেই পারে না যে বহরমপুর থানার পুলিশকে বিশ্বাস করাটা তাঁর ঠিক হয়েছে। এ-তো আর চকডাস্টার দিয়ে কলেজের ব্ল্যাক ব্ল্যাকবোর্ড কেমিস্ট্রির এসিড-সল্ট-বেইজের রি-অ্যাকশন বুঝানো নয় – কিছু মনে কইরেন না স্যার! বাজারের বদ-মাইয়ালোক আর পুলিশের মাইঝে একআনার উনিশ-বিশ নাই। রকিব উদ্দীনের ঘামময়-চিকন-ফর্সা নাক তিরতির করে কাঁপে – এইটা কোনধরনের অ্যানালাইসিস তোমার? মানুষরে মানুষ হিসাবে শ্রদ্ধা করো, বাজারের মাইয়ালোক কথাটার মানে কি? লিসেন মাই কমরেড, এ যুগ বিপ্লবের যুগ; আমি কি ইচ্ছা করলে পারতাম না পুলিশকে দু’কলম মুচলেকা লেইখা বারাইয়া আসতে? কিন্তু এইডা কোনো সাচ্চা বিপ্লবীর প্রপার কাজ নয়।
কিন্তু আমি ত স্যার মুচলেখার কথা কইতেছি না। আমার কথা অইলো গিয়া…। এখানটায় রকিব উদ্দীন কথা শুরু করলে, শ্যামলালের কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায় – কমরেড সি.এম. (চারু মজুমদার) কী শিখাইছেন? জবাবটিও রকিব উদ্দীনই দিতে থাকেন – শ্রেণী-শত্রু খতম করতে হবে। জোতদার-মহাজনের রক্তে হাত ভিজাইতে না পারলে কিসের কম্যুনিস্ট? তোমার আগের ঐ চাইল্ডিশ স্ট্যাটমেন্টটা রং।
কুনডার কথা কইলেন স্যার?
বাজারের মেয়েছেলে আর পুলিশের কথা কী যেন বললে না? দে আর দি পিলার অব দ্য স্টেট-ইন্সটিটিউট। এই আধা-পুঁজিবাদী, আধা-সামন্তবাদী, পরগাছা অর্থনীতিকে অ্যাটাক না করলে হবে না। মাটির ভিতরে পুইতা ফেলতে হবে; আন্ডারস্ট্যান্ড? শাকিব রেজা চৌধুরী যখন কথা বলা শুরু করেন তখনো তাঁর চোখ দুটি, মাও সে তুঙের জনযুদ্ধ বিষয়ে ৫টি প্রবন্ধের উপরই – তবে একখান কথা কী, গণসংগঠনগুলাইন বয়কট করনডা ঠিক করো নাই তোমরা। মাত্র ১৫ দিন আগে যে মওলানা ভাসানী আমরণ অনশনডা করলো, কারে নিয়া করল? ৯১ বছর বয়সে এই কামে হাত দেয়োন কি সুজা কথা? তিনি পষ্ট কইয়া দিছেন নক্সালবাড়ি গিয়া লাভ নাই, পলাশবাড়ি থাইক্যাই বিপ্লব শুরু কোরতে অইবো। যা শুরু অইছে দেশটায় মানুষের এক পয়সা ভ্যালু আছে? কিয়ের বিচার কিয়ের কি? এখন দরকার সক্কলে মিল্যা আন্দোলন-সংগ্রাম করা। তোমাগোর ঐ ডাকাইত্যে গলাকাডা শটকাট বিপ্লবরে বড় ভয় করে! কও দেহি, মাও সে তুঙ কোন জাগাডায় কইছে গণসংগঠনরে এক্কেরে তালাক দিতে? রকিব উদ্দীন তখনো নিজের বলা আগের কথাগুলোকেই উপভোগ করছেন। মুনিরই উত্তরটা দেয়–শাকিব ভাই কি তাইলে অফিসিয়াল বিপ্লবের স্বপ্ন দ্যাহেন? মস্কোর ভাইজানগো লগে দোস্তি কইরা ফালাইন হাঃ হাঃ হাঃ।
গরমের ঘাম-জমা-তাপে দমটায় যে ক্ষয় হয়ে যাবে শরীফের! তার রাগ শুধু লেট্রিনের নাক বরাবর শুয়ে থাকা মোমালি বা রকিবউদ্দীনের উপর নয় – তাকে মামলার তদ্বিরে পাঠানো বে-আন্দাজ-বুড়া-নানাটার কেমন ধারার বুদ্ধি! নিজে আসতে যখন পাছা ফেটে যায় তখন কলিজার টুকরা জোয়ান মর্দগুলিকে পাঠালেই তো পারত! এখন কেমন হলো? বহরমপুরের মিছিলঅলা বেজন্মা কুত্তার বাচ্চাগুলির সঙ্গে ঢুকতে হলো না জেলে? বালের কপালটাই খারাপ; কোর্টের সামনে লাইনে দাঁড় করানোর সময়টাতে বুরহান উকিলকে খুঁজেই পেল না। রাতটা কত লম্বা-চওড়া হওয়া শুরু করেছে। ধূলায়-ডুব-দেয়া কম্বলের গন্ধে তার ঘুম জমাট বাঁধে না। ডান পাশে কাৎ হতে গিয়েই গন্ধ পায় মামুনের ঘামে-ভেজা-ত্বকের। কখন ঘুমাল মানুষটা! এখনো রক্ত পড়ছে পা-টা থেকে। হলদে আলোও সেই ঘা ঘেষে ঘুমায়। বর্ষার খুচরা রাতটুকু তখনো ভেজাভেজা; ছাইরঙমেঘ ঘনকাদার মতো লেপ্টে আছে আকাশময়। দরজার সামনের লাঠিঅলা মিঞাসাবটা এখন আর নেই। শেষরাতের তাপ পেয়ে নতুন মিঞাসাবটি ঝিমায়। সেই ঝিমানোর পরশ এসে গন্ধ মাখায় শরীফের তামাম-গতরটায়। গন্ধ নিতেই থাকে। চোখের পাতা বুঁজে আসে। তখনই আজানের নরম সুর তার চোখে ঝাপ্টা মারে।
হঠাৎ-ই দরজাটায় দ্রাম দ্রাম শব্দ! সারা সেলটি স্নায়ুছেঁড়া তালে নড়ে ওঠে। কয়টা বাজে? ৫টা ৫। ক্যাচ ক্যাচ করে খুলে যায় ৩ নম্বর সেলটি। মাছের ঝাপির মতো ঠাসাঠাসি করে থাকা মানুষগুলোকে উগড়ে দেয় ১ আর ৩ নম্বর সেলের ফাঁকা জায়গাটায়। আবারও ওদেরকে ফাইলে বসায় হাবিলদার কালাম। শাকিব রেজা চৌধুরী হঠাৎ-ই মুখ খুলেন – হোয়াটস দিজ? তামশা পাইছেন? তার কণ্ঠটি এমন ভারী, ঘন আর পূর্বনির্ধারিত মনে হয় যে, হাবিলদারটির মুখে অন্ধকার ঝাপ দেয়! ফ্যাকাসে জিব কেঁপে ওঠে – স্যার বেয়াদবি নিয়েন না! আমরা ত দুই পয়সার চাহর; আইন না মাইন্যে কী পারি? আপনেরা শিক্ষিত সমাজ, ভুল-তিরুডি মাইন্যা নিয়েন। রকিব উদ্দীনের কপালের ভাজেও ঝিরঝিরে ঘাম গজায়। ঘুমের থিকথিকে প্রলেপ তার শরীরেও ঘন কুয়াশার মতো লেগে আছে। কাল রাত দেড়টারও পরে তো ওদের হাউজই ভাঙল! শ্যামলালের যুক্তির সঙ্গে অনেকেই একমত যে, পুলিশের আশ্বাসে তপ্তজনতার সামনে রকিব স্যারের উচিত হয়নি এমন ভাষণটি দেয়া!