বাঙলার মূল
ব্যাপারটা কিন্তু আশ্চর্য লাগে। দুই বাঙলা ভাষাভাষী অঞ্চল দুইরকমভাবে বিকাশ লাভ করে, পিছনে পড়ে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ধরে নিতে হর্ষ হয় এমন ভেবে যে, কোথাও ঘন্টাধ্বনি বেজে চলে।
প্রথমত পশ্চিম বাঙলা কোলকাতার উন্মেষে, বিকাশে সমানতালে পা ফেলে, কখনও উড়ে এগিয়েছে। দুর্গাপূজার সময় কোলকাতা নিদারুনভাবে জমে ওঠে। নাচে, গানে, পোশাকের জেল্লায়, পূজামণ্ডপের ছড়াছড়িতে কোলকাতা সয়লাব- জনজীবন অচল, গাড়িঘোড়া নিয়ে স্বাভাবিক নাগরিক চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ঈদের সময় ঢাকা ভীষণ লুপ্ত হয়ে যায়- ঢাকা ফাঁকা হয়ে পড়ে- সবাই গ্রামে, দেশের বাড়ি চলে যায়। এভাবেই কোলকাতা অধিক নাগরিক মেট্রো নগরে দিশাহারা তড়পায়; অন্যদিকে ঢাকার নগর হয়ে ওঠা তো বহুত পরের কথা- না শহর না গ্রামের নো ম্যান’স ল্যান্ডের দোটানায় লোকগীতির গানে মজে, রবীন্দ্রনাথের চান্নি-পসরে জাগে।
পশ্চিমা, সংস্কারমুক্ত আধুনিক শিক্ষার কায়দামুখী যে কোলকাতার জাগরণ তার অন্তরাত্মায় তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে পথপ্রদর্শক করে যদ্দূরসম্ভব এগিয়ে গ্যাছেন। তাঁদের নাটকে, থিয়েটারে, বিয়ের আমন্ত্রণপত্রে, মেট্রোরেলে, পূজোর ঘরে হরহামেশাই রবীন্দ্রনাথ আসন করেন। তা-সত্ত্বেও আজ তাদের সৃজনশীলতা অনেকটাই রাস্তার ডেড এন্ডে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গ্যাছে।
এমত লক্ষ্মণে অনেকের চিকিৎসাপত্র এরকম- রবীন্দ্রনাথের অন্তর্বস্তু সমাজে, জীবনে আরো গভীরভাবে অঙ্গীভূত করে নিলে এই নিস্ফলা খরাকাল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতো।
অন্যদিকে পূর্ব বাঙলা এগিয়ে যাবার সঙ্কল্পে, পথে পরিক্রমায় নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাগরণের রেনেসাঁয় উজ্জীবিত করে তোলে; তার এই অভিযাত্রায়ও কেন্দ্রীয় প্রণোদনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০বছর পর এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাঙলাদেশও এক ডেড এন্ডের মুখে এসে দাঁড়ায়- যার বামদিকে বাঙালি মুসলমানের জনরব; যে পথ ডানদিকে যায় তার মুখে মুসলমানের, কী খানিকটা মুসলমান বাঙালির শোরগোল।
বাঙলাদেশেও অনেকের ছাড়পত্র এমন- রবীন্দ্রনাথকে দর্শন ও প্রকল্পে আরো নিবিড়ভাবে আত্মস্থ করলেই আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক দুর্দশাকাল ডিঙিয়ে আলোর উৎসারণ দেখা যেতো।
এ-বেলায় দুই সম্মুখবাদী বাঙালির সামনেই একটি প্রশ্নের পেন্ডুলাম- রবীন্দ্রনাথকে সর্বনিশানায় বসিয়ে কী ইতিহাসের কোন ব্লাইন্ড স্পটকে আমরা বেমালুম ভুলে এক দূরত্বের ঢালুতে এসে দাঁড়িয়েছি- নাকি নানা সংখ্যালঘু জাতিসত্তা, বর্ণ, শ্রেণী, নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক আত্মীয়ের ব্যথা, বাসনার প্রতিধ্বনি আমলে না তুলে এক সম্মিলিত নাগরিক উচ্চবিত্তীয় একাকিত্ব গড়ে তোলার ফল এটি?
শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর খায়েশের ঘেরাটোপে- কোথাও বর্ণপ্রথার পেষণে, কোথাও শ্রেণীর শোষণে দু’চোখে আমূল রক্ত এসে জমে; আমরা কেবল ভাবি- প্রেশার বেড়েছে- একটু শিথিলে বসে একচুমুক রবীন্দ্রসঙ্গীত শোন হে বাপু, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইতিহাসের পিছনে ও সামনে পাতাদের শনশন ধ্বনি ও সহস্র পায়ের পত্তনির আওয়াজ ভেসে আসে; আর জেব্রা ক্রসিঙে আকুল তাকিয়ে থাকে বাঙালি এক, বাঙালি দুই।
বাঙলার উপরে দাঁড়িয়ে ভাবি- বাঙলা আসলে কোথায়!