আমার শহর চট্টগ্রাম। এখানে কেউ কারো কবিতা পড়ে না। অনেক অনেক দিন কেবল কবিতার জন্য এই শহরে কোনো তোলপাড় ঘটেনি।
ত্রিদিব দস্তিদার বলেছিলেন বটে, ভালোবাসতে ভালোবাসতে ফতুর করে দেবো।
বোহেমিয়ান আবু মুসা চৌধুরী হাফ লিটার জলের প্লাস্টিক বোতলে সস্তা দেশী মদ মিশিয়ে ব্যাগে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমাদের কাউকে কাউকে সঙ্গ দিয়ে কবিতা ব্যাপারটা রক্তের মধ্যে মিশিয়ে দিতে চেয়েছেন। কবিতাবই বিক্রেতা দেখেছি তাঁকে। নিজের বই বন্ধুদের কাছে বিক্রি করছেন। ব্যাগে নিয়ে ঘুরতেন। খুব জনপ্রিয় ছিলেন না। আমরা কেউ কেউ তাঁকে ভালোবাসতেন। ‘মুরলী, বেজে ওঠো’ আর ‘কমা’ আর ‘বিষ’ আর অনুবাদ কবিতাবই ‘পরের বাগান’ এমন কয়েকটা বই প্রকাশের পর তিনি সংসারের চাপে আটকা পড়লেন। দেখতাম তাঁকে,প্রকাশিত কবিতা সাদা খাতায় সেঁটে রাখতে পত্রিকা থেকে কেটে। এত শৃঙ্খলা অবাক করেছিলো। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির দোকান, প্রেস ব্যবসা অনেক কিছুই করতে চেয়েছিলেন, হয়নি। দেখতাম, এইসব নানা অনিয়মের মধ্যেও একটা লোক কেমন করে কবিতায় ডুবে থাকে। এখন এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটোখাটো চাকরি করেন। সিংহ অবশেষে বাঁধা পড়েছে।
জ্যোতির্ময় নন্দী এখন ঢাকায়। অনেক দেরিতে প্রথম কবিতাবই প্রকাশিত হয়েছিলো। আমরা,অনুজরা অবাক হয়েছিলাম আমাদের পড়া একাধিক ভালো কবিতা সেই বইতে নেই। লোকমুখে শোনা তাঁর প্রথম বই মানুষকে অতিরিক্ত বিশ্বাসের ফল। এও শুনেছি, আমাদের শহরের একাধিক লোকপ্রিয়, স্মৃতিপ্রিয় কবিতা তাঁর লেখা। এও তো কবিতা বিপণন। ইংরেজিতে যাকে বলে, গোস্ট রাইটিং। কবির সময় বিক্রির চেয়ে সস্তা কি আছে আর এই সময়ে!!
সম্প্রতি একজন সিনিয়র ডাক্তারের সাথে দেখা হলো। একটি বেসরকারি হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান। তাঁর ধারণা, জীবনে তিনি কিছুই পাননি। সেসব কথা কবিতায় লিখেছেন। অতি অখাদ্য সেসব কথা। তিরিশের দশকে লিখলে তাও কিছু পাঠক পেতেন। ভালোবাসাবশত, প্রুফ কাটতে গিয়ে অনুভব করি প্রথম বইয়ের জন্য তাঁর আবেগ। কবিতা না হোক,আবেগটুকু তো সত্যি।
এবার আমার কথা। প্রায় বিশ বছর কবিতা লিখি। প্রথম উনিশ বছর দৈনিক জোটেনি। মূলত অনিয়মিত ছোটোকাগজে লিখতাম। ফেসবুক আসার পরে ফেসবুকে। ইনসমিয়ার হাত থেকে, একাকীত্বের হাত থেকে অক্ষরের সন্ততিরা আমাকে আগলে রাখে। সেইসব মার্ক জুকারবার্গের ‘হোয়াটস ইন ইউর মাইন্ড?’ কথার উত্তরে লিখি। কিছু কিছু অনলি মি করে দিই। কিছু লাইক কমেন্ট জোটে। সকালে উঠে দেখি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আরেকটা কবিতা আসে তারপর। দু চারজন যারা লেখা চায়, ভালোবাসে, গদ্য চায়। আমি যে কবিতা লিখতেই জন্মেছিলাম কাউকে বোঝাতে পারি না। সব তো বলে বোঝানো যায় না।
ভালো কবিতা মানে যে কবিতা আমাকে সঙ্গ দেয়,আমাকে স্পর্শ করে,আমাকে চোখের জল মুছে দেয়,ঘুমের ভেতর আমাকে আমার অবচেতনের দেখা পাইয়ে দেয়। ভালো মানে যেখানে হারামিপনা নেই, লেঙি নেই, গ্রুপিং নেই, দলে দলে কোন্দল নেই ইন শর্ট ভালো কবিতা আমার কাছে শৈশবে বাবার সাথে লিবার্টিতে আইস্ক্রিম খাওয়ার মত শীতল।উদোম উঠোনে ঝুম বৃষ্টিতে উদ্বাহু নৃত্য, একটা চুমুর জন্যে প্রেমিকার গতজন্মের আত্মাতেও উঁকি মেরে দেখা সেখানে সান্তার জন্য রাখা লাল মোজায় আমার নাম আছে কিনা! ভালো কবিতা মানুষের পাশে থাকে।
কবিতা নিয়ে ভাবছি। আমার কবিতা।
কখন কিছু শব্দের বিন্যাস ও সমাবেশ ‘আমার’ হয়ে ওঠে।যে শব্দের পেছনে সহস্রাধিক বছরের বিবর্তনের ইতিহাস তা কেন কেবল ‘আমার’? এত সব মহৎ উচ্চারণ হয়েছে বাংলা ভাষায় তার মধ্যে আমার কবিতা কতটুকু ‘আমার’?
‘আমি’ কি পলিটিক্যাল আমি যে রাষ্ট্রের অব্যাহত চাপ ও যে কোন মুহূর্তে খুন হওয়ার চাপে থাকি?না কি সেই আমি যে খুঁজে বেড়ায় ব্যক্তিগত নারী যার সাথে সে শেয়ার করবে তার অন্তর ও বাহির?সম্পর্ক যাপনে আমি আমার পুরুষতন্ত্রের শিকার হবো না তো? না কি আমি সেই সাপ যে লেজ থেকে নিজেকে খেয়ে চলেছে? মানুষের সম্পর্ক কি পৃথিবীব্যাপ্ত সমুদ্রতীরের মতো? একই মানুষ কারো বাবা ভাই প্রেমিক বন্ধু যেমন কিনা একটাই সমুদ্র কখনো পতেঙ্গা কখনো পুরী কখনো গোয়া কখনও লস এঞ্জেলস!
এসবের ভেতর আমার কবিতা কতোটা আমার?প্রাত্যহিকের অপমান চাপতে যা লিখি কেবল ততটুকুই কি নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা?
তো এইসব ভাবনার ভেতর কোথাও কিন্তু টাকাপয়সার ব্যাপার নেই। নানা পত্রিকায় এক সময় বুক রিভিউ লিখতাম,ভালো বইটি পাওয়ার লোভে। লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা ছেপে কোনো প্রাপ্তি নেই। আমার শহরে কেউ কারো কবিতা পড়ে না। অনুজ অগ্রজে অসহ্য নিরবতা,পাশ কাটানো। আমরা আমাদের শহরের আগের প্রজন্মের লেখা পড়ি না। তাঁরা আমাদের পড়েন না। একটা মিসিং লিংক তৈরি হচ্ছে। সম্পর্কের মিসিং লিংক। নিজে নিজে কথা বলার মতো আমি আর আমার মতন কেউ কেউ কবিতা লিখি। কেননা পার্টি, ঈশ্বর, প্রেমিকায় বিশ্বাস না থাকলে মানুষ যে ব্ল্যাকহোলে পড়ে তা থেকে তাকে উদ্ধার করে কবিতা। এদ্দূর অব্ধি কোনো পুঁজিবাদ নেই।
আসছে পরের সিনে। যখন আমার বই হওয়ার কথা হচ্ছে। একটা ভালো যৌন অভিজ্ঞতার মতন আমারো ইচ্ছে ছিলো, একটা বই হোক। কিন্তু যারা করতে চেয়েছেন আমার শহরের আর আমার দেশের, শুরুতেই জানতে চেয়েছেন কত কপি বিক্রি হবে! আমি সেলসের লোক নই। তাই বুঝি না ও জানি না। এইসব শুনতে শুনতে জেনেছি, এইখানে তিনশো কপি বই হয়, অর্ধেক বিক্রি হলে ‘ব্রেক ইভেন’ হয়।
এখন কবিকে কবিতা ভাবতে হয়, কম্পোজ করে মেইল করতে হয়, পাবলিক রিলেশন করতে হয়, বইয়ের জন্য ধরাকরা করতে হয়, আমি পারিনি। তবু অনেকদিন পর একজন প্রকাশক কোনো শর্ত ছাড়াই বই করতে চাইলেন। কবিকে শুধুই কবি হতে বললেন। সেলস বা প্রমোশনাল অফিসার নয়। হাজারো নেতির ভেতর এইটুকু ইতির আলো,আমার জীবনে। বই হলে কেমন লাগে জানতে রাজি হলাম। শুরুতেই বলা, বিপণনের দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমার কবিতা লোকে পয়সা দিয়ে কিনে পড়বে, এতোটা কনফিডেন্স নিজের ভেতর থেকে পাচ্ছি না। পেলে কোনোদিন, জানাবো। তবে কবিতার পক্ষে সেই কনফিডেন্স জরুরি নয়। কবিতা আর পয়সা কোথাও একটা বিরোধ আছে, অন্তত বাংলা ভাষায়।
****
মেসবাড়ি। ততটা ভালো খাবার নয়,নিয়মরক্ষার যতটুকু পেটে গুঁজে দিয়ে লিখছেন জীবনানন্দ দাশ। মাঝে মাঝে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে চিঠি লিখছেন যদি কিছু পয়সা মেলে। কোনো বিলাসের জায়গা থেকে নয়, নিতান্তই নাকের ডগা জলের উপর পরিস্থিতিতে।
আরেকটা খবর এমন,বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর তৎকালীন প্রকাশক মিত্র ও ঘোষের কার্যালয়ে চাইছেন বিশ টাকা কেননা অইটুকুই তাঁর দরকার। বাংলা গদ্যে এমন কবি আর কে! তাঁর মৃত্যুর পর তোষকের তলা থেকে বেরিয়েছিলো অনেক না ভাঙানো চেক।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,যিনি সমাজতন্ত্রকে জীবনের মূল মন্ত্র করেছিলেন এবং কবিতাতেও তাঁর প্রতিফলন ঘটেছিলো সেসবের তিনি তাঁর কবিতাবইয়ের জন্য প্রকাশকের কাছে যাননি অনেকদিন। নিজেই ছাপতেন,কাঁধের ঝোলাব্যাগে নিজেই বিক্রি করতেন।
এসব যে সময়ের কথা সে সময় যৌথ পরিবার,সহজ আন্তরিকতা, পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে হাঁটা মানুষের নিত্যকর্ম ছিলো। বন্ধুদের পরস্পরের দেখা ফেসবুকে নয়, হতো খেলার মাঠে ও পাড়ার আড্ডায়। এরপর এলো বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ, ডিশ এন্টেনা, ফেসবুক ও জনবিচ্ছিন্নতা। অখন্ড মনোযোগের নির্জন আমরা হারিয়ে ফেললাম।
কবিতার বিপণন নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথম যে প্রশ্নটা আসে তা হলো, কেবল কবিতা লিখে গ্রাসাচ্ছাদন কি এখনও সম্ভব? বা কোনো কালেই বাংলা কবিতা লিখে তা সম্ভব ছিলো! এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতা লিখে দামী গাড়িতে চড়তে চাইলেও শুধুই কবিতা লিখে ত পারেননি। তাহলে? একজন কবির কবিতা বিক্রির তাগিদটা কোথায়?
আমার শহর চট্টগ্রাম। আমাদের এই শহরে সকলেই কবি ও সাংবাদিক। মানে, শুধু কবি ও শুধু সাংবাদিক নেই। এ তো সত্যি, কে যেন বলেছিলেন, বাঙালীর বয়স হলে দুটো অসুখ পেয়ে বসে। প্রথমত,বামপন্থী রাজনীতি আর দ্বিতীয়ত, কবিতা। যাদের দ্রুত সারে তাদের মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে আর বাকিরা সংসদে যায় অথবা সিনেমা খেলা চিত্রপ্রদর্শনী সবকিছুর রিভিউ লেখে, কবিতাটা পারে না।
এটা ঠিক,কিছু টাকা অনেক আপাত দৃষ্টিতে মনে হওয়া বড়ো সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে। কিন্তু এটা কবিতা নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না তো! ছকবাঁধা একটা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিরন্তর উৎপাদন পদ্ধতির দিকে একসময়ের অসামান্য কবি পরবর্তীতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন না তো! একটা ফর্ম জনপ্রিয় হলে শেয়াল পন্ডিতের একই কুমির ছানা দেখানোর মতন বার বার একই কবিতাকে নানা রঙের জামা পরিয়ে দেখাচ্ছেন না তো কবি? তখন কিন্তু সেটা কবির সার্ভাইবাল কিট হয়ে যায়, এই পদ্ধতিটা। এবং একজন কবির পক্ষে অনিবার্য প্রয়োজননিরপেক্ষ টাকা আসতে থাকা লেখার পক্ষে বিপদজনক বলেই মনে করি। অন্তত বাংলা কবিতার ইতিহাস উল্টেপাল্টে দেখলে সেসব নিদর্শন মেলে।
আমার বাড়ির বারান্দায় অনেক পাখি সারাদিন ডাকাডাকি করে। এসব পাখিদের নিজস্ব ভাষার কবিতা। এসবের জন্য সে অর্থ দাবি করে না তো। প্রয়োজন মিটিয়ে নেয় সে পাখিকবি প্রকৃতির কাছ থেকেই। যেদিন মানুষ পাখির ভাষা বুঝবে ‘একা’ শব্দটা অভিধান থেকে হারিয়ে যাবে।তেমন তেমন সমাজ একদিন বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠলে কবিতাও পাখির ডাকের পুঁজির নিয়মের উল্টোদিকেই হাঁটবে।
কবি তখন প্রকৃত অর্থেই সমাজপ্রকৃতির সন্তান হবেন।