আমাদের কথা বলার বিষয় মুক্তিযুদ্ধ, তার ভিতর দিয়ে কুসুমিত হয়ে উঠা আমাদের কথাশিল্প এবং তাতে বিরাজমান আমাদের প্রান্তজনের কথা থাকবে। এখানে বিষয় আছে তিনটি— মুক্তিযুদ্ধ, কথাসাহিত্য আর প্রান্তজন। প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধ তথা আমাদের স্বাধীনতা শব্দটির প্রতি আমরা নজর দিতে পারি। তাতে স্বভাবতই সেই নজরের অনেক গভীরে যাওয়ার বাসনা হয় আমাদের। একধরনের সাংস্কৃতিক-সত্য আমরা খুঁজতে চাই। প্রকৃত ব্যাখ্যা খোঁজার বাসনা হয় আমাদের। আমরা সরাসরি এর আসল অর্থ বুঝতে চাই। কারণ মানবজন্ম তো নানাপদের স্বাধীনতা বা শৃঙ্খলের ভিতর দিয়েই যায়। কাজেই এর সাথে বোঝাপড়া করাটা একটা জটিল এবং দরকারি বিষয়ই বটে। তবে স্বাধীনতা বলতে আমাদের বোধে আসে যে আমরা কেবল একাত্তরের স্বাধীনতাকেই বুঝে নেবো! তাই তো হওয়ার কথা— এবং তা একধরনের স্বস্তিদায়ক বিষয়ও বটে। কারণ এই ধরনের প্রচারণায় সর্বজনীনতা আছে। তবে এও প্রশ্ন থেকে যায় যে আমাদের স্বাধীনতার সবটুকু তাহলে একাত্তর দ্বারা নির্মিত! আমি এখানেই কিঞ্চিত দ্বিমত প্রকাশ করে রাখছি। কারণ এই স্বাধীনতার সাথে আমাদের আরও আরও ইতিহাস, সময়, মানুষের কোলাহল যুক্ত হয়ে আছে। সব ধরনের স্বাধীনতা একটা চলমান প্রক্রিয়ার নাম। আমরা এখানে শুধু ১৯৪৭ আর ১৭৫৭ সালের স্বাধীনতার অনুসঙ্গই স্মরণ করছি না, আমাদের নদ-নদী, হাওর, জল-জমিনের জীবন যে নানা ধরনের ঘটনার ভিতর দিয়ে এসেছে, নানান সাংস্কৃতিক আবহ এতে মিশেছে তাও স্মরণ করে রাখছি।
নিরাশার ভিতরই এ কথা শেষ করা যায় যে ই-ম্যাগাজিন, ব্লগ, ফেসবুক, কেবল টিভির যুগে কথাসাহিত্য বিশেষত প্রান্তিক জীবনকে জিইয়ে রাখার জন্য আরও নিবিড়ভাবে ভাবার সময় এসেছে।
একাত্তরের স্বাধীনতার আলাদা চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য আর উদ্ভাবসনের বিষয় আছে। চমৎকার বিষয়টি হচ্ছে, এই অঞ্চলের মানুষ সরাসরি এই অঞ্চলকে শাসনের সুযোগ পেল তখন। আমাদের আর তখন অন্যদের উপর নির্ভরশীল থাকার বিষয়টা হয়ত থাকল না। আমাদের স্বাধীনতা অন্তত আমাদেরকে আমাদের অধীনে করে রাখতে পেরেছে। জগতের সব স্বাধীনতাই তো আপেক্ষিক ব্যাপার, মানুষ ১০০% স্বাধীন হতে পারে কিনা, তাও এক প্রশ্ন বটে। তবে মানুষের চেহারাকে বরাবরই এক আন্তর্জাতিক কাঠামো মনে হয় আমার। রাষ্ট্র সেই কাঠামোতে ভাগ যে বসায় তা তো বলার বিষয়ই। তবু আমরা একাত্তরে একটা ভুখণ্ড পেলাম, তাতে মানুষ তো আছেই, আছে একটা রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা। এতদিন যে পাকিস্তানি জান্তবগোষ্ঠী আমাদের মাথার উপর শাসনের খড়গ নিয়ে ছিল, বা তারও আগে শাদা চামড়া ছিল, ধর্মের নামে, উচ্চ বর্ণের নামে সরাসরি পেষণ ছিল তাদের, তা আর থাকল না। প্রান্তিক সমাজ নিয়ে কথা হতে পারে; হতে পারে এ নিয়ে যা বোঝানো হলো তার একচুয়েল অর্থ নিয়েও। এ হচ্ছে দূরবর্তী সমাজ যেখানে আলো-হাওয়া, ছায়া, মায়া নেই, যা আছে তা কঠিন রূঢ় জীবন।
এই তো গেল সাংস্কৃতিক কথার বয়ান। আমরা তো কথাসাহিত্য দিয়েও এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা দেখে নিতে পারি। স্বাধীনতা-উত্তর কথাসাহিত্য বা তার ভিতর দিয়ে প্রান্তিক সমাজকে দেখা মানেই তো একাত্তরের পরবর্তী সময়কে এক নিমিষে আলাদা করে দেখার বিষয় নয়। তার তো পরম্পরা আছে। আমরা তো জল-মাটি-নদী আচ্ছন্ন এই এলাকার কথ্যসাহিত্যের যেমন অংশ, তার তো লিখিত সাহিত্য আরও নিবিড় ভাবে আছে। আমরা বঙ্কিম, রবিঠাকুর, বিদ্যাসাগর, ঈশ্বর গুপ্ত, মোহিতলাল, প্রমথ, মানিক, তারাশঙ্কর, জীবনানন্দ, সতীনাথ, জগদীশ, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, সন্দীপন, দেবেশকে তো অস্বীকার করার কোনো জো নাই। মীর মশাররফ হোসেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদের মতো তারাও আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্যের অংশীদার।
তবে এটা তো ঠিক যে বাংলাদেশ যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের ধারাবাহিকতার ফসল, তাহলে এর সাথে আমাদের বিচ্ছিন্নতার গল্পটিও সাহিত্য-ইতিবৃত্ত দিয়ে করে নিতে হবে। দেশভাগ সেই সময়কার প্রান্তিক রাজনীতি নিয়ে চমৎকার কিছু উপন্যাস হচ্ছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন। কথাক্রমেই বলতে হয় পূর্ববাংলার মানুষ, বিশেষত সাধারণ কৃষক স¤প্রদায় পাকিস্তানই কামনা করেছিল। কেন তা করেছিল? কারণ তারা শাদা চামড়া আর জমিদারদের নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। তো, তারা কি বাঁচতে পারল? তা তো নয়ই, —তাই তো এই এলাকার মানুষ দেশভাগের পরবর্তী বছর দুয়েকের ভিতর জাতিসত্তার সার্বিক মুক্তির জন্য লড়াই করতে থাকল। আমরা যে কাঁদো নদী কাঁদো পেলাম, তাতে যে কুমুরডাঙা পেলাম, সেই কুমুরডাঙার কান্দন শুনি, —তার কি কারণ? কুমুরডাঙা নামের জায়গাটার আড়ালে আছে আমাদের নদী দ্বারা সীমানা নির্মিত এই পূর্ববাংলা। তখন আমরা তথাকথিত স্বাধীনতা পেলেও তার কান্দন থামার কোনো পথ ছিল না। আমরা তখন সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে সামিল হতে শুরু করলাম, আমরা আরেক ফাল্গুন নামের উপন্যাস পেলাম। আমরা জীবন থেকে নেয়া নামের রাজনৈতিক ফিল্ম পেলাম। একজন জহির রায়হান তো সাংস্কৃতিক চেতনার ফসল। সেই চেতনার ধারাবাহিকতায় আমরা পেলাম আহমদ ছফার ওঙ্কার নামের উপন্যাস। প্রান্তিক সমাজ আর মানুষের মৌলিক চেতনার অংশীদার হলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তার রিয়েলিস্টিক ইমেজের ফিল্মিক সৃষ্টি চিলেকোঠার সেপাই তো আমাদের জাতিসত্তার লড়াইয়ের অংশ, যাতে মূর্ত হয়েছে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। শহর আর গ্রামের প্রান্তিক সমাজ এখানে দারুণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে আরেকজন প্রকাশিত হলেন, তিনি হাসান আজিজুল হক। তার লেখায় প্রান্তিক সমাজ অনেকটা শৈল্পিকভাবে প্রকাশিত হলো। গ্রামের সাংস্কৃতিক সমাজ হয়ত তাতে নিপুণভাবে আমরা পাইনি, বাংলাদেশের জল-হাওয়ার গন্ধের হয়ত কিঞ্চিত কমতি আছে তাতে, কিন্তু প্রান্তিক সমাজের অন্তর্জগত, লড়াই-সংগ্রাম তার লেখায় আছে। শীতের অরণ্য সমুদ্রের স্বপ্ন, জীবন ঘষে আগুন সেই সময়কার একবারে দারুণ সৃষ্টি। সেই সময়কার আরেকজন কথাশিল্পীর কথা না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন কায়েস আহমেদ। তার হাতে প্রান্তিক সমাজ একেবারে ক্যামেরার নিপুণতায় ধরা দিতে শুরু করল। জীবন যে অত কঠিন, রূঢ়, জলজ্যান্ত হতে পারে, তাই যেন তিনি একেবারে শব্দস্থাপত্যে নির্মাণ করতে থাকলেন। শওকত ওসমান আর সত্যেন সেন মার্কসীয় ধারাকে ঠিকঠাক করে তাদের আখ্যানে প্রান্তিক সমাজ আনেন। তবে তাতে শিল্পের সৌন্দর্য খানিক অগোছালো হয়ে গেল কিনা, তা ভেবে দেখার বিষয় বটে। শওকত আলী আর সৈয়দ হকরাও তখন প্রান্তিক সমাজের দিকে তীব্র চোখে নজর দিচ্ছেন। তাদের দেখার থেকে খানিক সরে গিয়ে, খানিক মায়া দিয়ে, ভালোবাসার পরশ মাখিয়ে জীবনকে দেখতে থাকেন মাহমুদুল হক, রাহাত খান, সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, রশীদ করীম, সুচরিত চৌধুরীরা।
আমরা তবে এখন মুক্তিযুদ্ধের কথন-ইতিহাসে প্রবেশ করি। এই সময়কার সাহিত্য নিয়ে বরং খানিক কথা বলে নিই। মুক্তিযুদ্ধ এমন এক বিষয় যা আমাদের এই দেশের জাতিব্যবস্থার সাথে একেবারে নিগূঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে। এমন সময় হয়ত আমাদের জীবনে আর আসবে না। হয়ত তা ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় আমাদের অস্তিত্বের সাথে লেগে আছে। কিন্তু একাত্তরের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সাথে আর কারও তুলনা চলে না। আমাদের এমন দুঃসময় আর আসবে না, এমন সুসময়েরও আর নাগাল পাবো না হয়ত। তবে এখানে স্পষ্টতই বলে রাখা দরকার যে এটা শুধু বাঙালির বিষয় ছিল না, তা ছিল অন্য নৃগোষ্ঠীরও বিষয়। তাই তো প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীই নানাভাবে তাতে অংশ নেয়। তো, যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক উপন্যাসই লেখা হয়েছে, তাতে প্রান্তিক সমাজও এসেছে, আরও আসবে। এখানে প্রথমেই আমরা স্মরণ করতে চাই আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত’র নাম। যুদ্ধে শহীদ এ লেখক তার চাক্ষুস অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে এটি লিখেছেন। ২৫শে মার্চের পরবর্তী সময় খেকে জুন পর্যন্ত সময়কে সুদীপ্ত শাহীন নামের চরিত্র দিয়ে দেখেছেন তিনি। তার দেখায় জায়গা পেয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর তার আশপাশের এলাকা। তার লেখায় হয়ত শিল্পমান অত সফলভাবে আসেনি, কিন্তু সময়ের দাবিতে এর মূল্য অনেক বেশি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথাসাহিত্যে প্রচুর কাজ করেছেন শওকত ওসমান (জাহান্নাম হইতে বিদায়, দুই সৈনিক, নেকড়ে অরণ্য, জলাংগী), শওকত আলী (যাত্রা), সৈয়দ শামসুল হক (বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী), সেলিনা হোসেন (হাঙর নদী গ্রেনেড), রিজিয়া রহমান (বং থেকে বাংলা), মাহমুদুল হক (জীবন আমার বোন, খেলাঘর) হুমায়ূন আহমেদ (জোছনা ও জননীর গল্প, ১৯৭১, শ্যামল ছায়া, সৌরভ, দেয়াল), ইমদাদুল হক মিলন (কালোঘোড়া, রাজাকারতন্ত্র, দ্বিতীয় পর্বের শুরু, একজনা, সাড়ে তিন হাত ভ‚মি), রশীদ হায়দার (খাঁচা), শামসুর রাহমান (অদ্ভুত আঁধার এক), হারুন হাবীব (প্রিয় যোদ্ধা, প্রিয়তম), সুকান্ত চট্ট্রোপাধ্যায় (জীবনতরু), মিরজা আবদুল হাই (ফিরে চলো), হরিপদ দত্ত (মোহাজের), মঈনুল আহসান সাবের (কবেজ লেঠেল, পাথর সময়), মঞ্জু সরকার (অন্তর্দাহ) শহীদুল জহির (জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা), আনিসুল হক (মা), মহীবুল আজিজ (যুদ্ধজোড়া) শাহীন আখতার (তালাশ), ওয়াসি আহমেদ (রোৗদ্র ও ছায়ার নকশা), কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর (যখন তারা যুদ্ধে), রফিকুর রশীদ (দাঁড়াবার জায়গা), হোসেনউদ্দীন হোসেন (সাধুহাটির লোকজন)।
প্রান্তিক জীবন নিয়ে সৃজিত কিছু উপন্যাসের কথা আমরা এই ক্ষেত্রে স্মরণ করি,—তাতে বিষয়ে প্রতিও সুুবিচার করা হবে বলে মনে করছি। আমরা যদি সাংস্কৃতিক ইতিবৃত্তকে স্মরণ করি, এর পরম্পরাকেও স্পর্শ করতে চাই, তাহলে কিছু উপন্যাসের কথা স্মরণ করতে হবে, যেমন শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন, সৈয়দ শামসুল হকের আয়না বিবির পালা, দূরত্ব, মহাশূন্যে পরাণ মাস্টার, সত্যেন সেনের কৈবর্ত বিদ্রোহ, হাসনাত আবদুল হাইয়ের তিমি, রিজিয়া রহমানের একাল চিরকাল, রক্তাক্ত অর, সেলিনা হোসেনের পোকামাকড়ের ঘরবসতি, জলোচ্ছ্বাস, আবুবকর সিদ্দিকের খরাদাহ, জলরাস, হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি, হরিপদ দত্তের অন্ধকূপে জন্মোৎসব, মোহাজের, বশীর আল হেলালের পানপাত্র, ইমদাদুল হক মিলনের ভূমিপুত্র, পরাধীনতা, সবুজপাতা ভালো আছো, হুমায়ূন আহমেদের গৌরীপুর জংশন, পেন্সিলে আঁকা পরী, মেঘ, এই রৌদ্রছায়া বিপ্লব দাশের কিম্পুরুষ, প্রশান্ত মৃধার মৃত্যুর আগে মাটি, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী, হরিশঙ্কর জলদাসের জলপুত্র, জাকির তালুকদারের পিতৃগণ, পাপড়ি রহমানের পালাটিয়া, নাসিমা আনিসের মোহিনীর থান, কামাল রাহমানের অগ্নি, মৃত্তিকা ও অরণ্য, শিমুল মাহমুদের শীলবাড়ির ময়নাতদন্ত, মোসাদ্দেক আহমেদের আয়নামহল, রাখাল রাহার অমাবতী।
এবার আমরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী কথাশিল্পীদের কথা স্মরণ করব, তাদের সাথে প্রান্তিক সমাজের সম্পর্কের বিষয়টিও দেখে নিতে চাইব। আমরা একটা কথা স্মরণ চাই যে, সেই সময়টাই ছিল প্রান্তিক মানুষের জেগে উঠার সময়, তাদের ভিতর থেকে সবকিছুর স্বাদ নেয়ার সময়। মুক্তিযুদ্ধ মানুষকে এভাবেই স্বাধীন করে। তারা ভাবতে শুরু করতে পারে, যারা ক্ষমতায় বসেছে, তারা তো তাদেরই লোক, তাদের ভিতর থেকে গড়ে উঠা মানবসত্তা। তাই তো প্রগতির পিছনে মানুষ পঙ্গপালের মতোই ছুটে। তারা সবকিছুতে তাদের অংশীদারীত্বের গন্ধ নিতে চায়। তারা ভাবে, দেশটা তো সকলে মিলেই স্বাধীন করেছি। তবে তারা অচিরেই রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা বলে আলাদা একটা বিষয় আছে বলে তা দেখতে থাকে। অতঃপর তাদের জীবনে সেই ব্যবস্থাপনার সাথে বোঝাপড়ার একটা বিষয় তৈরি হতে থাকে। রাষ্ট্র মানেই দ্বন্দ্বের নাম, রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট। সেই সময়ে আমরা কিছু কথাশিল্পী পাই। তারাও অন্য সময়ের অংশ, —তবু তারা এই সময়টাকে নিজেদের মতো দেখতে চায়। তারা গল্প উপন্যাস লেখে। মঞ্জু সরকার, সুশান্ত মজুমদার, মঈনুল আহসান সাবের, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মনিরা কায়েস, হরিপদ দত্ত, ভাস্কর চৌধুরী, আতা সরকার নতুন এক জগতের সন্ধান দিতে থাকেন। আমার কেন জানি মনে হয়, মঞ্জু সরকারই এই সময়ের প্রধান শিল্পী যিনি সময়টাকে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে ধরতে পেরেছিলেন। অথবা, সময়েরও কিছু আকাঙ্ক্ষা বা নিয়ম হয়ত থাকে, সেই সব প্রয়োজনীয়তার অংশই তিনি। তার হাতে একে একে সৃজিত হচ্ছিল অবিনাশী আয়োজন, মৃত্যুবাণ, তমস, প্রতীমা উপাখ্যান, নগ্ন আগন্তুক, অপারেশন জয়বাংলা নামের প্রয়োজনীয় সৃষ্টিযজ্ঞ। সময়ের আরেক সেনানী সুশান্ত মজুমদার, যিনি মানুষের জীবন লগ্নতাকে একটা রাজনৈতিক ধারায় মেলাতে চেয়েছেন। তার অবজার্ভেশনের ভিতর দিয়ে সময়টা ভেসে ওঠছিল। তাকে আমরা এভাবে স্মরণ করতে শুরু করেছিলাম। মঈনুল আহসান সাবের এই সময়ের আরেক কথাশিল্পী যিনি মূলত মধ্যবিত্তকে হ্যান্ডল করলেও প্রান্তিক জীবনও তার সৃজনশীলতায় আছে। মানুষর অন্তর্গত বোধকে তিনি নিপুণভাবে এঁকে যান। কবেজ লেঠেল, পাথর সময়, এখন পরিমল নামের উপন্যাস, —ভুল বিকাশ, গ্রাম-শহরের গল্প তেমনি তার চমৎকার কাজ। মিলন আর হুমায়ূন মূলত মধ্যবিত্তের ভিতর কাজ করলেও তারাও প্রান্তিক সমাজ নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধকে নানা ভাবে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। মিলনের ভ‚মিপুত্র, আর হুমায়ূনের গৌরীপুর জংশন, অয়োময়, অপেক্ষা, মাতাল হাওয়া বা কবি দারুণ সৃষ্টি। মনিরা কায়েস বরাবরই প্রান্তিক জীবনকে বিশাল ল্যান্ডস্ক্যাপের ভিতর দিয়ে এঁকে রাখছেন।
আশির দশক হয়ত জেগে উঠার দশক, —আশাহতেরও দশক; প্রান্তিক সমাজকে ঝাঝালো ভাবে প্রকাশেরও দশক। কারণ ততদিনে জাতি জেনে গেছে এদেশ নানা মাত্রার স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়েছে। এবং তা এক অব্যাহত প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই চলবে। এখানকার প্রান্তিক সমাজের চেহারা বদলে যাচ্ছে। তারা নানান বর্ণে নিজেদের দেখতে বাধ্য হচ্ছে। পরজীবী অর্থনীতি তাদের শ্রম শুধু নয়, দ্রোহ, হাহাকার, লজ্জা, ঘৃণাও ক্রয় করতে শুরু করেছে। সবকিছুরই যে বাজারমূল্য থাকতে হয়, তা তারা বুঝতে শুরু করেছে। বিদেশি ঋণের কবলে রুরাল ইকোনমি চলে যাচ্ছে। দেশ ক্রমাগত জলপাই শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছে। তখনকার মধ্যবিত্তের ভিতর দ্রোহ দানা বাঁধে। তারা সামরিক শাসন থেকে মুুক্তি চায়, গণতন্ত্র চায়, সৌন্দর্যের তুমুল বিকাশ চায়। তখনই অল্টারনেট সাহিত্যের চেহারা বেশি দেখা যায়। সেই সময়ের কথাশিল্পীরা হচ্ছেন শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, ওয়াসি আহমেদ, কাজল শাহনেওয়াজ, ইমতিয়ার শামীম, মহীবুল আজিজ, পারভেজ হোসেন, নাসরিন জাহান, শহিদুল আলম, সেলিম মোরশেদ, হুমায়ূন মালিক, দেবাশিস ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, হামিদ কায়সার, সামসুল কবীর, ব্রাত্য রাইসু, সুব্রত অসাস্টিন গোমেজ, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। ওই সময়ে লিটলম্যাগ চর্চা যেমন বেশি হয়েছে গল্পের কাজও প্রচুর হয়েছে। শহীদুল জহির, নাসরিন জাহান, ইমতিয়ার শামীম বিনে প্রান্তিক জীবন নিয়ে উপন্যাস-লিখিয়ে তেমন একটা তখন দেখা যায় না।
নব্বই দশকের প্রান্তিক সমাজের শব্দচিত্রী হচ্ছেন শাহাদুজ্জামান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, জাকির তালুকদার, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, রায়হান রাইন, প্রশান্ত মৃধা, মাহবুব মোর্শেদ, খোকন কায়সার, অদিতি ফাল্গুনী, আবু হেনা মোস্তফা এনাম, পাপড়ি রহমান, রোকন রহমান, শামীম রেজা, রবিউল করিম, মাসুদুল হক, মাসুমুল আলম, শেখ লুৎফর, রনি আহম্মেদ, সাদ কামালী, রাজিব নূর, চঞ্চল আশরাফ, শিমুল মাহমুদ, সরকার আশরাফ, মির্জা তাহের জামিল, রাশেদ রহমান প্রমুখ।
কথাসাহিত্য চর্চা তো চলছেই, শূন্য দশক পেরিয়ে আরও আরও গল্পকার বা ঔপন্যাসিক আসছেন। আরও আরও সময় নিয়ে এ সম্পর্কেকথা বলার বিষয় আছে। তবে এইটুকু বলা যায়, চর্চার চেয়ে দেখা, দেখার চেয়ে সহজে প্রকাশের চাহিদা এখন অনেক বেড়ে গেছে। প্রান্তিক জীবন আরও ম্লান হয়ে যেন আমাদের কথাসাহিত্যে ধরা দিচ্ছে।
আমরা এতক্ষণ যে সাহিত্যের কথাবার্তা বললাম, তার সবই তো লিখিত রূপের কথা বলছি। এই বাইরে কি সাহিত্য নাই? কথাসাহিত্যের লৌকিক, অলিখিত রূপের কথা কি আমরা বলব না? নাকি তা হিসাবের ভিতরই আনতে রাজি নই আমরা? কথা হচ্ছে, সাহিত্য মতাকাঠামোর ভিতরই থাকবে, তারও তো কোনো কথা নেই। প্রান্তিক সমাজ তাদের গালগল্পে, কিসসায়, জীবনে জীবনে তাদের কথা কয়ে বেড়ায়। মানুষের চলমান জীবনই তা বহন করতে থাকে। এ তো গেল বাঙলাভাষী প্রান্তিক সমাজের কথা, —এর বাইরেও তো প্রান্তিক জীবন আছে। নৃগোষ্ঠী আছে। পাহাড়ি-সমতল মিলিয়ে ৪৫টির মতো প্রান্তিক জীবনের মানুষও আছে। তাদের ভাষা আছে। জীবন আছে। কিন্তু তাদের দ্বারা সৃজিত, তাদের কোনো সাহিত্য, আমরা সেইভাবে পাই না। কথাশিল্পের কথা আমরা তেমন একটা জানি না। কিন্তু তাই বলে মুখে মুখে, সমাজে সমাজে ভ্রাম্যমাণ সেইসব কথা, গল্প, কিসসাকে কি আমরা কথাসাহিত্যের মর্যাদা দেবো না? তা একটা প্রশ্ন বটে।
সবশেষে নিরাশার ভিতরই এ কথা শেষ করা যায় যে ই-ম্যাগাজিন, ব্লগ, ফেসবুক, কেবল টিভির যুগে কথাসাহিত্য বিশেষত প্রান্তিক জীবনকে জিইয়ে রাখার জন্য আরও নিবিড়ভাবে ভাবার সময় এসেছে। লেখা, দেখা, না-লেখা জীবনের নানান বাঁককে নির্ণয়েরও সময় বয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রান্তজনকে শুধু নির্ণয় বা দেখলেই হবে না, তাকে উদ্ভাসিত করতে হবে। স্বতত মুক্তির লড়াইয়ের ভিতর তার সর্বাত্মক আননন্দকে জাগাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ লড়াই। কথার সহজতা, আননন্দময় জীবন, এর গণতান্ত্রিক বিস্তার। জীবনকে জীবনের সাথে গেথে নিয়ে তবেই না চলতে হবে। কথার আলাদা জগৎ সৃষ্টি করতে হবে।