অন্যান্য সাহিত্যে যেমন বাঙলা সাহিত্যেও কবিতা গদ্যের পূর্ববর্তী। জন্মসূত্রে অগ্রজ খালি নয়, জন্মদান সূত্রেও কবিতা গদ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। বাঙলাদেশে কবিতার আশা আর দুরাশার দিক হচ্ছে তার এই সংখ্যাধিক্য। মোটামুটি এই প্রক্রিয়ায় আশান্বিত থাকা যায় যে, সাফল্য না এলে এতো কবিতা রচনা করা সম্ভবপর হতো না। অন্যদিকে হতাশার কারণ থেকে যায় এভাবে যে, সাহিত্য যদি একটা পরিচর্যা ও মনীষার বিষয় হয়, তাহলে মেধাহীন, শ্রমহীন অজস্র মিল অমিলের এই পয়ারগুলি কী সবই কবিতা? বমি করতে কষ্ট হয়, সন্তান প্রসবের যন্ত্রণা আরো অনেক বেশি, কিন্তু বিপুল হেলাফেলায় বেরিয়ে আসছে অগুণতি কবিতা- যাতে রক্তপাত ও ক্ষরণের তেমন কোন চিহ্ন নেই।
“কবিতা তো বটেই, যে কোন শিল্পই যদি পাঠক, দর্শক কিংবা শ্রোতাকে অস্বস্তির মধ্যে না ফেলে, জীবন এবং জীবনযাপন সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের আতঙ্কে জড়িত না করে তাহলে শিল্প পরিণত হয় সংস্কৃতি কর্মে।”
কবিতার জন্য তার চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় আর কিছুই নেই যে, কবিতা খুব গা-সওয়া হয়ে গ্যাছে, কাউকে আর উদ্বুদ্ধ কিংবা চমৎকৃত করছে না। এমন তো কেউ নেই যার ভালবাসার কিংবা রিরংসার, ক্ষোভের কিংবা হিংসার, বিজয় কিংবা পতনের কোন অভিজ্ঞতা নেই! কবিতার সে-সব খসখসে বালুকণা উন্মোচন করার কথা- কবিতার প্রকৃত শক্তি এখানেই নিহিত যে, সে জীবনের অন্তঃশীল মর্মে টঙ্কার তুলতে পারে। সচরাচর আকারে সংক্ষিপ্ত হলেও কবিতা সবচেয়ে মহৎ আনন্দ কিংবা বেদনার মুহূর্তকে প্রাণকম্পিত করে তোলে। কম্পিত করা কেবল জ্বলে ওঠা নয়, সেইসঙ্গে নির্বাপিত হবারও মন্ত্র। এজন্যই হয়তো বাইবেল একটি সফল কাব্য। একবার যে বীক্ষা ও সত্য মানুষের চেতনাকে উন্মোচিত করে সেই পূর্বোক্ত সত্য দ্বিতীয়বার অক্ষম প্রতিধ্বনি মাত্র। তাই পুশকিন যে কবিতা লিখেছেন, ইভগেনি ইভতুশেঙ্কো সেই কবিতা লেখেন নি; কোলরিজ যে কবিতা লিখেছেন অ্যালেন গিনসবার্গ একই অনুভূতি অনুবাদ করেন নি।
কবিতার এই প্রথকতা আসে প্রতিবেশ ও জীবনবোধের ভিন্নতা থেকে। একজন কবি যদি জীবনের সারাৎসার সম্পর্কে নোতুন উৎসমুখ আবিষ্কার করতে না পারেন, তাহলে তিনি যা রচনা করবেন তা কবিতা না হয়ে হবে কতগুলো নিষ্প্রাণ পুনরাবর্ত মাত্র। জাবরকাটা কবিতা পদবাচ্য নয়, কবিতার নামে পদ্যময় গদ্য, গদ্যের নামে স্যাঁতসেঁতে খিঁচুনি। এলিঅট বোদলেয়ার সম্পর্কে বলেছিলেন : যদিচ বোদলেয়ারের কাব্যরীতি ও শব্দবিন্যাস বৈপ্লবিকভাবে নোতুন, জীবনবোধে যে নতুনত্ব তিনি এনেছিলেন তা আরো মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ। রোম্যান্টিকরা ছিলেন প্রসন্নতা ও প্রেমাকাঙ্ক্ষার কবি, তাঁদের সামনে জীবন ছিল মাধুর্যমণ্ডিত ও কোলাহলময়, তাই তার প্রশান্তি নির্মাণ করা ছিল তাঁদের জন্য এক মহান কীর্তি। কিন্তু শার্ল বোদলেয়ারের জীবন পঙ্কিল ও কন্টকাকীর্ণ। তাই তাঁর কবিতা তীব্রতায় আলাদা, ব্যাখ্যা আর মূল্যায়নে নেতিবাচক।
এই ভিন্নতা আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতামাত্র নয়, বরং তা কাব্যমুক্তির অনিবার্য প্রকল্প। যদি বোদলেয়ার জীবনকে গ্লোরিফাই করার নামে পুতুপুতু মনোভাব বয়ান করতেন তা হলে তাঁর কবিতাকে বহন করতে হতো অক্ষমতার গ্লানি, উপরন্তু সময়ের ক্লেদ ও গ্লানিকে চিহ্নিত করায় তাঁর কবিতা পেয়েছে রৌদ্র।
বোদলেয়ার ও র্যাঁবোর চিন্তার ক্ষণিক বীজ নিহিত থাকলেও পল অ্যাপোলিন্যায়ার ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গীর পরাবাস্তববাদী চিন্তার বুনিয়াদ সার্বিকভাবে পৃথক।
তাঁরা বলেন, সবচেয়ে নিকৃষ্ট দাসত্ব হচ্ছে চিন্তার দাসত্ব- যা দুনিয়া সম্বন্ধে ভুল ধারণা দেয়, এবং মানুষকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেয় না। এই পৃথক জীবনবোধের উপর দাঁড়িয়ে ব্রঁত’র সঙ্গীদের কেউ কেউ- যেমন লুই আরাগঁ, পল অ্যাপোলিন্যায়ার, জ্বারা প্রমুখ কবি রাজনৈতিক তৎপরতাকে মুখ্য বলে মানেন, এবং পরাবাস্তববাদের সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শন মার্কসবাদকে মিলানোর চেষ্টা করেন।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একটা দিক কিছুটা খোলাসা হয়েছে যে, কবিতা কখনও একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। বলা যায়, দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না- কবিতার পায়ের নিচে সরিষাদানা আছে- কবিতা ধ্যানী কিন্তু চলমান এক বোধি। টি. এস. এলিঅটের পক্ষে দ্বিতীয়বার পড়ো জমি লেখা সম্ভব ছিল না; জীবনানন্দ দাশ আবার লিখতে পারতেন না- বোধ; আবুল হাসানের পক্ষে ফের লেখা সম্ভব ছিল না তাঁর- অপেক্ষা কবিতাটি। কেননা প্রতিমুহূর্তেই জীবনের প্রতিবেশ আর আভিমুখ্য বদলে যায়। যেমন এক নদীতে দুইবার গোসল করা যায় না, তেমন একটি কবিতা দুইবার লেখা যায় না। উপলব্ধির নোতুন দুয়ার উদ্বোধন করা আদতে কঠিন, অন্যদিকে আবিষ্কার না করে পুনরাবর্তনের নিরাপদ কোটরে বসে থাকাও অসম্ভব।
“একজন কবি যখন তাঁর নিজের বর্তমানকে প্রবোধ দেন, তখন বুঝতে হবে তিনি চেতনার কোন নোতুন দরোজা উদ্বোধন করছেন না, বরং তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলে কেউ বড়জোর কূটনীতিবিদ হতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই কবি হতে পারেন না।”
রবীন্দ্রনাথই বাঙলা ভাষার প্রথম কবি- যিনি উপলব্ধির ক্ষেত্রে নিজস্ব- তাঁর বোধকে বাণীমূর্তি করার জন্য অন্যান্যের সঙ্গে মিলিয়েছেন এভাবে- যেমন করে একজন ভাস্কর তাঁর ভাস্কর্য পূর্ণাঙ্গ করতে উপকরণের সঙ্গে পলেস্তারা যোগ করেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম এবং শেষ ভারতীয় কবি। কিন্তু আজকের দিনে কবিতা লিখে ভারতীয় কবি হতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ অসফল হতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় দৈব প্রতিভার বলে ভবিষ্যতের কররেখা পড়ে ফেলতে পেরেছিলেন, তাই কবিতা থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে গানের বাদশাহিতে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করেন, এবং তাঁর হস্তগণনা শতভাগ নির্ভুল প্রমাণিত হয়। রবীন্দ্রনাথের আরো বড় সাফল্য ওখানে যে কবিতায় তিনি তুলনামূলকভাবে কিছুটা অসফল হন। ভারতীয় মৌলিক ও ঐতিহ্যগত কাব্যপ্রবাহে যে সুরের দীপ্তি তাতে রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি নিমজ্জিত ও ধ্যানমগ্ন ছিলেন, কিন্তু ইতোমধ্যে বিশ্বকবিতার ভাষা সুরের বাইরে এসে কর্কশ গদ্যে ঘনীভ‚ত হয়ে উঠেছে যা রবীন্দ্রনাথের মনস্তাত্তি¡ক বেড়ের বাইরে। এই অবাধ্য পাথুরে বাগান পরিসরে পুঁই মেলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী ও বুদ্ধদেব বসু। রবীন্দ্রনাথের পরে বাঙলা কবিতা অনেক পরীক্ষার ভিতর দিয়ে গ্যাছে। পরীক্ষা ডিঙানোর জন্য নিরীক্ষা অপরিহার্য। এই পরীক্ষা যেমন বিভিন্ন কাব্যদর্শনের ক্ষেত্রে, একইভাবে বিশ্বকবিতার অগ্রগতির সাথে। সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন- অপরীক্ষিত জীবন যাপন করারই যোগ্য নয়, বাঙলা কবিতার ক্ষেত্রেও সেই মানদণ্ড প্রযোজ্য হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের পর বাঙলা সাহিত্যের দুই প্রধান স্রষ্টা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে দেখি ব্যক্তির অসামান্য রুগ্নতা, জীবনানন্দ দাশে ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা। জীবনানন্দ দাশ যদি উপন্যাস লিখতেন, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা- তাহলে কী জীবনানন্দ দাশ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হতেন, আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হতেন জীবনানন্দ দাশ? মোটের উপর যে অভিব্যক্তি উপন্যাসে রুগ্নতা আনে, কবিতায় তার নিঃসঙ্গতা আনা ছাড়া বিকল্প নেই। কেননা রুগ্নতার কাঠামোচিত্র সাহিত্যে তুলে আনতে চাইলে জীবনের যে ধারাবাহিক পতন এবং ক্ষয়ের বর্ণনা জরুরি, কবিতায় তা সম্ভব নয়। কবিতার গড়ে ওঠার এই যে নির্দিষ্ট এলাকা সেটি তার মহত্ত¡ কিংবা সীমাবদ্ধতা- এ দুইয়ের যে কোন একটি হতে পারে। কবি অনেকটা যিশু খ্রিস্টের মত; কিন্তু যিসাসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য হচ্ছে- যিসাস তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবায়নে অসফল হলে ঈশ্বরের কাছে নতজানু হতে পারেন, প্রসারিত স্বপ্নের জন্য এভাবে নতজানু হওয়া তাঁর জন্য মহত্তে¡র; কিন্তু প্রকৃত কবি এভাবে নতজানু হতে পারেন না; যদি হোন, তাহলে তিনি আর কবি থাকেন না- একজন সংকীর্ণ মুৎসুদ্দিতে পরিণত হন।
সত্যিকারের কবি কখনও আপোষ করেন না। তাই কবিতায় উৎসবের চেয়ে বিরহ শক্তিমান, উত্থানের চেয়ে পতন মহীয়ান। কবির বিশ্বাসের সততা আর অনন্য সংবেদনশীলতা তাঁকে এই প্রত্যাখানের দৃঢ়তা জোগান দেয়। রুশ বিপ্লবের উৎসবে যখন মিখাইল শলোকভ এবং নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি প্রবল বিক্রমে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, সে-ক্ষণে সের্গেই এসেনিন কিংবা ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির রক্তক্ষরণ আর দহনের পালা। যে রোম্যান্টিক কবির স্বপ্নের সঙ্গে তাঁর জীবনযাপনের কোন ফারাক নেই- তাঁর ট্র্যাজিক পরিণতি আটকানো দায়। কবিতায় ট্র্যাজিক পরিণতি কেবল মৃত্যু নয়, আকাক্সক্ষা এবং বাস্তবানুগতার ব্যবধানে তিনি যদি অকবিতে ঘনীভ‚ত হন তাহলেও তাঁর পরিণতি ট্র্যাজিক- যে ট্র্যাজেডি মৃত্যুর অধিক। ১৯২৪-এ ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির লেখা ৪ হাজার লাইনের বিখ্যাত কবিতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন-এর তুলনায় সের্গেই এসেনিনের আত্মহত্যা পরবর্তী ক্ষীণকায় কবিতা- সের্গেই এসেনিন- তাৎক্ষণিকতার চাহিদার কাছে হয়তো কিছুটা অপ্রয়োজনীয় ঠেকতে পারে- কিন্তু অনেক বেশি নির্দিষ্ট, আর বিষাদময়। মায়াকোভস্কি সম্পর্কে আনাতোলি লুনাচারস্কির স্মৃতিচারণের শুরুটা অনেকটা এরকম : যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে মায়াকোভস্কিকে জানেন, অন্তত জনসমক্ষে তাঁর অনুষ্ঠান দেখেছেন, ওঁর লেখা পড়েছেন – তাঁদের কাছে মায়াকোভস্কি মানে গোটা জীবন। তাঁর বিশাল সমর্থ দেহে উদ্দাম ও শক্তির সমস্ত আবেগ নিয়ে মায়াকোভস্কি আর জীবন এক ও অনন্য।
একজন কবি যে মুক্তির জন্য রাত্রিভর ঘণ্টাধ্বনি করেন, কিংবা ক্রন্দনে ছিন্নভিন্ন হন- সেই মুক্তি তাঁর হাতের আয়তনে চলে এলে তাঁর আর কী করার থাকে! হয় তিনি মুক্তির বিপক্ষে দাঁড়ান, না হয় মৃত্যুবরণ করেন, তা না হলে অকবির ভোঁতা শৌর্য গ্রহণে কলঙ্কিত হন। আয়েশি পয়াভারী সরকারি আমলা হয়- কবি হয় না! বিন্দুবিন্দু রক্তের ওমে তমসার গোলাপ ফোটে- আর ধীরে ধীরে নেমে আসে নাইটিঙ্গেলের মৃত্যু; বরং বলা ভালো, মুক্তির কোন পরিপূর্ণ আকার নেই বলে তিনি নোতুন মুক্তির দিকে প্রসারিত হন।
বাঙলা কবিতায় যে রোম্যান্টিক বিপ্লবী কবির উদাহরণ সংশ্লিষ্ট করা যায়, তা হলো- সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সমর সেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় একসময় লিখেছিলেন : আনো দিন হাতুড়ির, আনো দিন কাস্তের, খাদ্যের শিল্পের, শিক্ষার, স্বাস্থ্যের। পরবর্তীতে তিনি অসীম ক্লান্তি আর অবসাদে লেখেন : এই পৃথিবীতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, দেখো, আমি জটায় বাঁধছি বেদনার আকাশগঙ্গা। সমর সেন প্রথমদিকে লিখেছিলেন : প্রায় পত্রহীন সে প্রৌঢ় বট, বহুকাল মাখেনি সবুজ কলপ; কিন্তু তার শিকড়েরা ঊর্ধ্বমুখ, আকাশ সন্ধানে। পরবর্তীতে লেখেন: আর অব্যর্থ বিলাপের বিকারে বলি, আমাদের মুক্তি নেই, আমাদের জয়াশা নেই!
একসময় দুজন কবিরই দীর্ঘশ্বাস বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে। তাঁদের নিরাশা এক, কিন্তু তার প্রতিফল হয় আলাদা আলাদা: সমর সেন কবিতা লেখা ছেড়ে দেন; সুভাষ মুখোপাধ্যায় একের পর এক লিখতে থাকেন আপোষকামী পদ্য। সমর সেন তাঁর জয়াশা আর হতাশা ব্যাখ্যা করেন অতঃপর সাংবাদিক গদ্যে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজেকে তারপরও প্রাসঙ্গিক করে রাখতে চান কবিতায়। এ-ক্ষেত্রে সমর সেনের কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়া তাঁর সততা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নিজেকে কবিতায় অব্যাহত রাখা এক ম্যাড়ম্যাড়ে অভ্যাসের নামান্তর।
জ্বরের মত অতিকথন নিজে কোন অসুখ নয়, তা হলো অন্য একটি মূল সমস্যার পার্শ্বপতিক্রিয়া। মূল সমস্যাটি হচ্ছে- কবির হাতে পাঠককে দেবার মত কোন মৌলিক বেদনা নেই। নোতুন সংবাদ দিতে হলে কবিকে চলতে হবে ঘটনার আগে, সময়ের পিছনে পিছনে, এমনকী সাথে সাথে চললেও হয় না। কবিতা ঘটনার ধারাবর্ণনা নয়, যেমন ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলায় হয়।
একজন কবি যখন তাঁর নিজের বর্তমানকে প্রবোধ দেন, তখন বুঝতে হবে তিনি চেতনার কোন নোতুন দরোজা উদ্বোধন করছেন না, বরং তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলে কেউ বড়জোর ক‚টনীতিবিদ হতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই কবি হতে পারেন না।
বাঙলাদেশে কবিতার অবিকাশের প্রধান কারণ – তার মধ্যবিত্ততার ঘেরাটোপ। মধ্যবিত্ত ফলবান স্বপ্নবাহী শ্রেণী, কিন্তু মধ্যবিত্ততা এক দুর্ভাগ্য। একজন কবির কাছে যদি তার চারপাশ আয়েশে গ্রহণযোগ্য মনে হয়, তাহলে তার কবিতা কেন পাঠকের কাছে সংবেদনশীল মনে হবে! এতো কবিতা নয়- ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা বা বড় আমলার সকাশে নিবেদিত মানপত্রের অধিক কিছু নয়! যে বিশ্বাস এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলা যায়, সেই প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হাজার কথা বলবার দরকার পড়ে। এজন্য এখানকার কবিতায় অতিকথন এক মারাত্মক ব্যাধি। জ্বরের মত অতিকথন নিজে কোন অসুখ নয়, তা হলো অন্য একটি মূল সমস্যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। মূল সমস্যাটি হচ্ছে- কবির হাতে পাঠককে দেবার মত কোন মৌলিক বেদনা নেই। নোতুন সংবাদ দিতে হলে কবিকে চলতে হবে ঘটনার আগে, সময়ের পিছনে পিছনে, এমনকী সাথে সাথে চললেও হয় না। কবিতা ঘটনার ধারাবর্ণনা নয়, যেমন ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলায় হয়।
বাঙলা জনপদে মধ্যবিত্ততাই একজন কবির প্রধান মোকাবেলা। মধ্যবিত্ততা বিষবৃক্ষ- এখানে জীবন বন্ধ্যা, ক্রন্দন হয় নাকিকান্না, ভালবাসা ক্যারিকেচার, ক্ষোভের নাম প্যানপ্যানানি, সৌন্দর্য হয় মুখস্থ হাততালি। মধ্যবিত্ত, আর মধ্যবিত্ততা যে এক নয়- এই নিরেট সত্য একজন প্রকৃত কবি’র চেয়ে আর কে বেশি অনুভব করতে পারেন?
একথা ঠিক যে কবিতায় ব্যাখ্যা করার সুযোগ কম। একজন আদতী কাব্যজন তাঁর অনুভ‚তির অগ্নি কবিতায় ধরতে না পারলে অন্য মাধ্যমে তা প্রকাশ করবেন- তাই তো স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা কবিতায় কানায়কানায় বলতে পারেন নি- তা বলেছেন গানে; যা গানেও আসেনি, সেকথা চিত্রিত করেছেন পেইন্টিঙে বা স্কেচে। শনাক্ত করতে সমস্যা হয়- যখন দেখা যায় যে, অজস্র সমিল অমিলের পয়ার প্রতিদিন বেরিয়ে আসছে কিন্তু সঙ্গে কোন অগ্নি নেই- তাহলেই বোঝা যায় শীতার্ত জনপদে তিনি প্রমেথিউস নন; এসকল পয়ার কবিতা নয়- টেনেটুনে তাদের পদ্য পর্যন্ত বলা যায়, তার বেশি কিছু নয়।
স্বাধীনতাউত্তর কালে কবি আবুল হাসান অনেক সফল কবিতা লিখতে পেরেছিলেন; কেননা, স্বাধীনতার ভিতরকার নিঃসঙ্গ অগ্নি ও ছটফটানি তিনি ধরতে পেরেছিলেন। আবুল হাসানকে অনেক সময় মনে হয় বুঝি জীবনানন্দ দাশের প্রতিধ্বনি করছেন, কিন্তু আসলে তিনি জীবনানন্দ দাশ থেকে অনেক আলাদা। জীবনানন্দ দাশে আছে বেদনা, আবুল হাসানে যন্ত্রণা; জীবনানন্দ দাশের ক্ষয়, আবুল হাসানের ভাঙন। আমার ধারণা, আবুল হাসান এতোদিন বেঁচে থাকলে হয় কবিতা লেখা ছেড়ে দিতেন, না হয় লিখতেন গদ্য- হয়তো দুই একটা কবিতা হতো তাঁর অভ্যাসের মোচড়। জীবনের প্রকৃত মুক্তি বলতে কী বোঝায়- এই মৌল, প্রাথমিক ও স্বপ্নভঙ্গকারী প্রশ্নটি সামনে চলে এলে আর কোন বেহিসাবি উন্মার্গতা থাকে না- যার অনুপস্থিতিতে কবিতা লেখা সম্ভব নয়- সম্ভব প্রবন্ধ।
আভিমুখ্যটি বোঝার সুবিধার জন্য আলাদা মেজাজের দুই কবিকে একসঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে : সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা আবুল হাসানের প্রথম দিককার কবিতার সঙ্গে শেষের দিকের কবিতায় মূল প্রবণতার যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে- তা হলো :
সুকান্ত ভট্টাচার্যের শেষের দিকের কবিতায় সঙ্গোপনে একটি ক্ষয়ের ধ্বনি শোনা যেতে শুরু করে- যা পরিণত হলে সুকান্ত আর সুকান্ত হিসাবে পরিগণিত হতে পারতেন না। অন্যদিকে আবুল হাসানের কবিতায় ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ের ক্ষরণ কমে আসতে থাকে-যা পরিপক্ক হলে আবুল হাসান আর মুক্তা ফলাতে পারতেন না।
মোহাম্মদ রফিকের কবিতাকে অনেকে কবিতাপ্রবন্ধ ডাকেন; রফিক আজাদের কবিতাও গদ্যাশ্রয়ী। কবিতায় প্রবন্ধের প্রশ্রয় থাকার দরকার কী? এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ রফিকেরই একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন : তাঁর অভীষ্টই হচ্ছে- পাঠক যাতে তাঁর কবিতা গড়গড় করে পড়ে যেতে না পারেন। কবিতার মাঝে মাঝে তিনি ছন্দটি ভেঙে দেন- যেন পাঠক হোঁচট খান। বাস্তব যেমন কর্কশ আর রূঢ়, কবিতায় গীতলতা ভেঙে না দিলে সে বাস্তবের অভিঘাত তুলে আনা যায় না।
কবিতা মানুষকে জীবনের প্রতি প্রহরে জাগ্রত করে রাখে। সহস্র সংগ্রামশীল মৃত্যু যদি কেবলমাত্র পলি বৃদ্ধি করে, অগণিত আত্মদানের অঙ্গীকার যদি হৃৎপিণ্ডের মরিচা দোলাতে না পারে, তাহলে সাহিত্যের কী-ইবা অর্থ হয়!
সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, অনেক সফল কবি গদ্য লিখছেন। কোন কবি কখনও গদ্য, এমনকি সফল গদ্য লিখতে পারবেন না- এমন কোন আরোধ আরোপ করা যায় না। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হচ্ছে- একজন কবি গদ্য লিখবেন কেন? তখনই লিখবেন, যখন একজন কবির সামনে এমন এক ধরনের বাস্তবতা উপস্থিত যাকে কাব্যে ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না- লিখতে হবে গদ্যে। এখানে একটি বক্তব্য নয়, অনেকগুলো বক্তব্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বাহাস করে। এ-কথা সত্য যে, উপর্যুক্ত অবস্থাটি কবিতার জন্য সুখকর নয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় সঙ্কট হচ্ছে- একজন কবি যখন কবিতা লেখেন, এবং আগের উপলব্ধিই পুনরাবর্তিত করেন। শামসুর রাহমান হরহামেশায় প্রেম, দেশপ্রেম কিংবা রাজাকার নিয়ে কেজো কবিতাগুলো উপস্থিত করেন- পাঠককে তা এক সাময়িক উসকানি, বা আরাম দেয়- কিন্তু কোন ঝাঁকুনি দেয় কি? হাতে গোণা কিছু কবিতা বাদ দিলে অন্যান্য কবির কবিতা সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে।
মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের সংকট থেকে কবিরা পড়ে আছেন অনেক পিছনে। পিছনে থেকে সামনের কবিতা লেখা যায় না। এক্ষেত্রে তার সেরা উদাহরণ ফররুখ আহমদ। কবিতায় ফররুখ আহমদের সম্ভাবনা ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু পিছনে পড়া মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্পে তিনি বাঙলা কবিতার মাঠে আসেন, এবং একটি কবিতার প্রতিভা কীভাবে মরুভ‚মির বালুতে আটকে যেতে পারে তার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন নি।
কবিতা তো বটেই, যে কোন শিল্পই যদি পাঠক, দর্শক কিংবা শ্রোতাকে অস্বস্তির মধ্যে না ফেলে, জীবন এবং জীবনযাপন সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের আতঙ্কে জড়িত না করে তাহলে শিল্প পরিণত হয় সংস্কৃতি কর্মে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তে অভ্যস্ত পাঠক রবীন্দ্রনাথে এসে অস্বস্তিতে পড়েন, রবীন্দ্রনাথের পাঠক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, কিংবা বিষ্ণু দে পাঠে অনারাম পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। কবিতায় সে আনন্দ চাওয়া হয় না- যে আনন্দে ঝুঁকি নেই।
প্রকৃত কবিতা মানুষকে এক খনন প্রক্রিয়া শেখায়- কবিতায় সে নিজেরই হৃদয় খুঁড়ে করবী ফুলের বীজ আর জালি কুমড়ার সহজ ধাঁধা কুড়িয়ে আনে। কবিতা মানুষকে জীবনের প্রতি প্রহরে জাগ্রত করে রাখে। সহস্র সংগ্রামশীল মৃত্যু যদি কেবলমাত্র পলি বৃদ্ধি করে, অগণিত আত্মদানের অঙ্গীকার যদি হৃৎপিণ্ডের মরিচা দোলাতে না পারে, তাহলে সাহিত্যের কী-ইবা অর্থ হয়! জীবনে আনন্দ আর বেদনা জাপটাজাপটি করে থাকে, তার সাথে থাকে অদৃশ্য আগুনের জরুন; তাই কবিতা যদি কেবল ভীরু, শঙ্কিত গোবরে পোকার ব্যক্তিত্বে বুক ঘষেঘষে চলে- তাহলে বিদ্যুতের তারে তারে প্রবাহিত হয় অখণ্ড নিরাশা!