ছেলোবেলা থেকেই আমি সিনেমাসক্ত। আব্বা তাঁর জীবনের এক পর্যায়ে চলচ্চিত্র ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন, অর্থাৎ একটি সিনেমা হলে তাঁর শেয়ার ছিলো। সেই সুবাদে অল্প বয়সেই প্রচুর ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম বিনা পয়সায়। কখনো কখনো আব্বার অজ্ঞাতসারে সিনেমা হলে ঢুকে পড়তাম, ভয়ে বুক দুক দুক করতো, পাছে আব্বার নজরে পড়ে যাই। গেট কিপারদের সহযোগিতা না পেলে আব্বার সর্তক দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব ছিলো না। আবার কোনো কোন দিন আব্বা স্বেচ্ছায় আমাদের নিয়ে যেতেন সিনেমা হলে। এমন কি কোন কোন রাত ভোর করে দিয়েছি ছবি দেখে। সেকালে সারা রাতব্যাপী ফুল সিরিয়াল চালানোর রেওয়াজ ছিলো। কত ছবি যে দেখেছি তার কোনো লেখাজোখা নেই। কোনোরকম বাছবিচারের বালাই ছিলো না। ছবির ভালোমন্দ বিচার করার মতো হিকমত তখন হাসিল করতে পারার প্রশ্নই ওঠে না। যা পেয়েছি তা-ই দেখেছি। কোনো কোনো ছবি সাত-আট বারও দেখা হয়ে যেতো। এদিক থেকে, বলা যায়, আব্বা ছিলেন খুবই উদার।
ছেলেবেলার অনেক কিছুই অস্তমিত হয়েছে আমার জীবন থেকে, কিন্তু সেই ফিল্মি শখ আজো অটুট রয়ে গেছে। এখন অবিশ্যি যে-কোনো ছবি দেখার লোভে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ি না, মুফতে দেখবার সুযোগ থাকলেও নয়। এখন কিছুটা বাছবিচার করতে শিখেছি। যখন ঝাঁঝালো যুবক ছিলাম, তখনও সত্যিকারের ভালো ছবি সনাক্ত করতে পারতাম। আমার চলচ্চিত্র বিষয়ক রুচি খানিক গড়ে দিয়েছিলো অধুনালপ্ত ব্রিটানিয়া সিনেমা হল। ব্রিটানিয়াতে প্রচুর উঁচু মানের বিদেশী ছবি দেখানো হতো। আজো কালেভদ্রে ব্রিটানিরার কথা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করি। হায়-ব্রিটানিয়া, সোনালি ডানার ব্রিটানিয়া।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের একটি সন্ধ্যার কথা আজো মনে পড়ে। মন ভালো ছিলো না সেদিন, হতাশা একটা কালো বেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আমার ওপর। বেড়ালটাকে আমার অস্তিত্ব থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে একটা সিনেমা হলে (ব্রিটানিয়া নয়) ঢুকে পড়লাম। একটা বিদেশী ছবি চলছিলো সেখানে। জাপানী ছবি। রশোমন। ছবিটা দেখে নেমে পড়লাম পথে, হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম অনেক দূর। মন আশ্চর্য এক নান্দনিক আভায় উদ্ভাসিত। বৃষ্টিতে গেটের নিচে বসে থাকা একজন কাঠুরে ও একজন পুরোহিত; গহন অরণ্যে একটা কাঠুরে, চলমান কাঠুরের রৌদ্রঝলসিত কুড়ালের ক্লোজআপ; আলো আর অন্ধকারের খেলা, সুরের মূর্চ্ছনা। গহন অরণ্যে একজন সামুরাই, তার স্ত্রী এবং একজন পাহাড়ী দস্যু। হত্যাকাণ্ড। পাঁচজনের জবানিতে একই ঘটনার পাঁচ ধরনের বিবরণ। পাঁচটি মনের ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি, প্রত্যেকেই চাইছে নিজেকে ভালো প্রতিপন্ন করতে, এমন কি মৃত ব্যক্তিও এ ব্যাপারে অতিশয় যত্নশীল। চলচ্চিত্রকার কি গহন অরণ্যকে মানব মনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন সেলুলয়েডে? চলচ্চিত্রকারের নাম আকিরা কুরোসাওয়া, বারবার ভেসে উঠছিলো আমার চোখের সামনে। আগ কখনো তাঁর নাম শুনিনি। পড়েছি কি কোথাও তাঁর বিষয়ে কোনো রচনা? না, মনে পড়ে না। আমাদের কোনো আড্ডায় কি উচ্চারিত হয়েছিলো তাঁর নাম? মনে পড়ে না। পরে অবশ্য তাঁর বিষয়ে অনেক কিছু শুনেছি, দেখেছি তাঁর আরো ছবি– সেভেন সামুরাই।
রশোমনে একজন প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের অসামান্য সৃজনশীলতার পরিচয় তো ছিলোই, আরো ছিলো ক্যামেরার অসাধারণ কাজ। ক্যামেরাম্যানের নাম সেই সন্ধ্যায় মনে ছিলা না, টাইটেল সিকোয়েন্স ভালো করে লক্ষ্য করিনি। অনেকদিন পর তাঁর নাম সনাক্ত করেছিলাম। মিয়াগাওয়া। খোদ কুরোসাওয়া দিলখোলা প্রশংসা করেছেন মিয়াগাওয়ার। রশোমন প্রদর্শিত হবার পরপরই আকিরা কুরোসাওয়ার নাম ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র, তিনি নন্দিত হলেন বিশ্বের মুষ্টিমেয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার-দের একজন হিসেবে। ১৯৫১ সালে রশোমন গ্রাঁ পি পুরস্কার পেলো। এই পুরস্কার লাভের খবরটি কুরোসাওয়া পান তাঁর গৃহিণীর কাছ থেকে। ছবিটি যে ভেনিসে পাঠানো হয়েছিলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্যে, এটাই জানতেন না কুরোসাওয়া। তখন এক সাময়িক ব্যর্থতায় ভুগছিলেন তিনি, কীভাবে সংসার চালাবেন সেই উদ্বেগে ক্লান্ত, মনমরা। এক নিষ্প্রভ সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই জীবন সঙ্গিনী ছুটে এসে বললেন, ‘অভিনন্দন।’ ‘কেন? কিসের জন্যে এই অভিনন্দন?’ প্রশ্ন করলেন চমকিত কুরোসাওয়া। কুরোসাওয়া-গিন্নী হাসি ঝলসিত কণ্ঠে জানালেন, ‘তুমি পুরস্কার পেয়েছো রশোমনের জন্যে।’ আনন্দে কুরেসাওয়ার অস্তিত্বের প্রতিটি তন্ত্রী ঝংকৃত হয়ে উঠলো। যাক, আর শুধু পান্তা ভাত খেয়ে দিন কাটাতে হবে না।
আরেকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার, সত্যজিৎ রায় বলেছেন, “রাশোমনই একমাত্র সীরিয়াস শিল্পগুণ সম্মত বিদেশী ছবি যা প্রায়ই রবিবারের মনিং শো-এ দেখানো হতো। আমার কাছে এই ছবির প্রভাব ছিলো বিদ্যুৎ চমকের মতো। আমি পরপর তিনদিন তিনবার ছবিটা দেখলাম এবং প্রতিটি সময়ই অবাক হয়ে ভাবতাম আর কোথাও কোনো চলচ্চিত্রকারের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিটি বিভাগে এমন গভীর এবং উজ্জ্বল দখল আছে কিনা!”
এইরকম একজন সৃজনশীল ব্যক্তিত্বের জীবন যাপনের কথা জানতে কার না ইচ্ছা করে? যার চলচ্চিত্র সম্পর্কে আগ্রহী তারা স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইবেন কুরোসাওয়ার চিত্র নির্মাণের ইতিকথা। আর এই জীবনকথা আর ইতিকথা যদি রচনা করেন স্বয়ং কুরোসাওয়া তাহলে তো সোনায় সোহাগা। রশোমন, সেভেন সামুরাই, থ্রোন অব ব্লাড এবং কাগেমুশা-র মতো ছবি যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই অসামান্য প্রতিভাধর শিল্পী মানুষের আত্মজীবনী পাঠ করা এক আশ্চর্য নান্দনিক অভিজ্ঞতা। সম্প্রতি কুরোসাওয়ার ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়েগ্রাফি’ বইটি পড়ে আমার সেই অভিজ্ঞতা হলো।
এই যে একটু আগে উল্লেখ করলাম, কুরোসাওয়ার আত্মকথা চলচ্চিত্রে আগ্রহী ব্যক্তিমাত্রই পড়তে চাইবেন, এর সঙ্গে আরেকটি কথা যোগ করতে চাই। শুধু চলচ্চিত্র মনস্ক পাঠকগোষ্ঠীই নয়, যে-কোনো সংবেদনশীল পাঠকই এই আত্মজীবনী থেকে এমন কিছু আহরণ করতে পারবেন যা জীবনের পক্ষে উদ্দীপক ও উপকারী। সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি শিল্প ও জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, শেখায় কী করে চরম হতাশার মধ্যেও মানুষ কাজ করে যায় একলব্য নিষ্ঠায়, দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যায় অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। আকিরা কুরোসাওয়া অনেক চিত্রনাট্য লিখেছেন, কিন্তু তিনি কখনো কোনো উপন্যাস রচনা করেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে তাঁর আত্মকথা একটি উন্নত মানের উপন্যাসের মতোই উপভোগ্য এবং তৃপ্তিকর। এই বই পড়লে মনে হয়, লেখক কোনো বানোয়াট কথা বলেন নি, তাঁর মধ্যে কোনো ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই, তিনি যা বলেছেন তা স্পষ্টভাবেই বলেছেন, কারুকেই খাতির করেননি, এমনকি নিজেকেও নয়। অন্যের দোষ সম্পর্কে তিনি যেমন সচেতন ছিলেন, তেমনি নিজের দোষ ও দুর্বলতার কথাও সাফ সাফ ব্যক্ত করেছেন। কুরোসাওয়ার আত্মজীবনীর ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে এক আপোষহীন সততা।
যদিও এক প্রথাশাসিত পরিবারে জন্ম হয়েছিলো কুরোসাওয়ার, তবু, ছেলেবেলাতেই তিনি বহু ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে ছিলেন। আর এই সুযোগ এসেছিলে তাঁর সামুরাই পিতার উদ্যোগে। পরিবারের সকল সদস্যের সঙ্গে ছবি দেখতে ভালোবাসতেন তিনি। তার মতে, চলচ্চিত্র আনন্দ ও শিক্ষা দুটোকেই সঞ্চারিত করে মানুষের মনে। তিনি যে ঐতিহ্যে লালিত তাতে ছোট ছেলেমেয়েদের ছবি দেখাতে উৎসাহিত করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কুরোসাওয়ার পিতা অন্যান্য প্রথা মানলেও, খাবার টেবিলের আদব কারদায় পান থেকে চুন খসলে সহধর্মিনীকে আহম্মক বলে গালমন্দ দিলেও, ছবি দেখার বেলায় কোনো প্রথাকে আমল দেননি। এদিক থেকে বলতেই হয়, তিনি ছিলেন খোলা মনের মানুষ।
ছেলেবেলা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতেন কুরোসাওয়া। বহু ইউরোপীয় ও আমেরিকান ছবি তিনি শৈশবে দেখেছেন, সেসব ছবির কোনো কোনো দৃশ্যের ছাপ এমন গভীরভাবে পড়েছিলো তাঁর মনে যে সেগুলি কোনোদিন মুছে যায় নি। সেকালে জাপানী ছবি তাঁকে তেমন টানেনি। ছবির ভালোমন্দ সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করেন তাঁর ভাই হেইগো। শুধু চলচ্চিত্রই নয়, সাহিত্যসহ অন্যান্য বিষয়েও গোড়ার দিকে কুরোসাওয়া তাঁর উজ্জ্বল অগ্রজের তালিম পেয়েছিলেন। এই তালিম ওপর থেকে জোর করে চাপানো কোনো ব্যাপার ছিলো না। তাঁর পক্ষে সূর্যের আলো কিংবা হাওয়ার মতোই ছিলো অগ্রজের সাহচর্যের ফল। দুই ভাই একই স্কুলে পড়শোনা করতেন। হেইগো ছিলেন কুরোসাওয়ার চার বছরের বড়। ছাত্র হিসেবে হেইগোর বেশ নাম ডাক ছিলো। ঝলমলে বুদ্ধির অধিকারী হেইগোর মধ্যে ছিলো আত্মপ্রত্যয়ের ঝলসানি। এই আত্মপ্রত্যয় ছোট ভাইয়ের মানসে সঞ্চারিত করতে তিনি যত্নশীল ছিলেন শৈশবেই। কুরোসাওয়া তারি এই দীপ্তিমান অথচ ব্যর্থ অগ্রজের কথা গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন আত্মকথায়।
কুরোসাওয়া অকুণ্ঠ কবুল করেছেন যে, ছাত্র হিসেবে তিনি কখনো কৃতিত্বের পরিচয় দেন নি। সেরা ছাত্র বলতে যা’ বোঝায় তার ত্রিসীমায় ছিলেন না তিনি, তাঁর নির্বুদ্ধিতা ও দুর্বলতা নিয়ে স্কুলের ছাত্ররা হর-হামেশা হাসিমস্করা করতো। ছিঁচকাদুনে বলে গরিচিত এই ছেলেটিকে নাস্তানাবুদ করার জন্যে সবাই উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিলো। হেইগো ছোট ভাইকে এই বিপাক থেকে বাঁচানোর জন্যে নানা তরকিবের আশ্রয় নিতেন এমনকি কখনো কখনো তিনি ব্যঙ্গের ছলে অস্থির করে তুলতেন কুরোসাওয়াকে। ছোট ভাই যাতে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে, সেজন্যই তিনি এরকম আচরণ করতেন তাঁর সঙ্গে।
সে-সময়ে আরো একজন অনুপ্রাণিত করেছিলেন কুরোসাওয়াকে। তিনি সেই স্কুলের শিল্প-শিক্ষক তাচিকাওয়া সেইজী। আগেই বলেছি, ছাত্র হিসেবে কুরোসাওয়া ছিলেন গৌরবহীন, ব্যাকবেঞ্চারদের একজন। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে একজন চিত্রকর ঘুমিয়ে ছিলো তাকে তাচিকাওয়া সেইজী জাগিয়ে তুলেছিলেন ছাত্রকে প্রচুর উৎসাহ জুগিয়ে। ছাত্রটি সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল যে সে বাস্তবিকই ছবি আঁকতে পারে আর এই ঘটনাই তাকে আত্মবিশ্বাসী হতে শেখালো। তাচিকাওয়া সেইজী এবং অন্য দুএকজন শিক্ষকের গুণাবলীর কথা তিনি ঠোঁট চেপে বলেন নি: তাঁদের ঋণ স্বীকার করেছেন দিলখোলা ভাষায় যেমন করেছেন তার প্রিয় চলচ্চিত্রকার ইয়ামামাতো কাজিরোর বেলায়। ইয়ামা-সানের কাছে তিনি শিক্ষানবিশী করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে, তরুণ শিক্ষার্থীর শ্রম ও প্রতিভা লক্ষ্য করে গুরু তাঁর শিষ্যকে দিয়েছেন অকৃপণ উৎসাহ ও স্নেহ। কুরোসাওয়া ইয়ামা-সানের সহকারী হিসেবে বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ইয়ামা সানের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন।
মনে হতে পারে, যে, শৈশবেই চলচ্চিত্র প্রীতিই কুরোসাওয়াকে চলচ্চিত্র-জগতে টেনে এনেছে। আসলে তা নয়। সেলুলয়েড, ক্যামেরা ও আর্ক ল্যাম্পের দুনিয়ায় তিনি আকস্মিকভাবেই হাজির হয়েছিলেন। সহকারী পরিচালকের চাকরি পাওয়ার পরেই তা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, কাজ ভালো লাগেনি ব’লে। একজন সহকর্মীর পরামর্শে শেষ পর্যন্ত কুরোসাওয়া পদত্যাগ করেন নি। সহৃদয় সহকর্মীটি তাঁকে বলেছিলেন, সকল চলচ্চিত্রকারই এক রকম নয়, এমন কিছু চলচ্চিত্রকারও আছেন যাঁদের সঙ্গে কাজ করার আনন্দ অপরিসীম। আর কী আশ্চর্য কিছুদিনের মধ্যেই ইয়ামা-সানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ ঘটে গেলো কুরোসাওয়া। ইয়ামা-সানের সহচর্যে কুরোসাওয়া জীবনে এক নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
আকিরা কুরোসাওয়া জীবনের নানা পর্যায়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। চিত্রনাট্য লিখে পয়সা রোজগার করেছেন প্রচুর আবার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উড়িয়ে দিয়েছেন ইয়ারদের সঙ্গে মদ্য পান করে। বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন, প্রচুর ঝুঁকি নিয়েছেন সেজন্যে। পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। বহুদিন কপর্দক হীন অবস্থায় ঘুরে বেড়িয়েছেন এদিক-ওদিক, আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন হেইগোর ডেরায় এবং আত্মঘাতী অগ্রজের মতোই সচেষ্ট হয়েছিলেন আত্মহননে।
অসামান্য প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে বহু অন্তরায়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সেই ছাবি দীর্ঘকাল মুক্তিলাভ করেনি সেন্সর বোর্ডের নিষেধাজ্ঞার জন্যে। তাঁকে বারবার অপদস্ত হতে হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়শাসিত সেন্সর বোর্ডের হাতে। কুরোসাওয়ার ছবিতে ইউরাপীয় ও মার্কিন ছবির প্রভাবের প্রসঙ্গ টেনে সেন্সর বোর্ডে অপদার্থ, বিদ্বেষপরায়ণ সদস্যরা কুরোসাওয়ার ছবি আটকে রেখেছেন। যৌনতার অভিযোগ এনেছেন তার কোনো কোনো ছবির বিরদ্ধে, এমনকি সেন্সর বোর্ডের তথাকথিত বিজ্ঞ সদস্যরা তোরণকে যোনির প্রতীক ভেবে গোটা ছবি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেন্সর বোর্ডের নির্বুদ্ধিতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীনিতা সম্পর্কে ঠোঁটকাটা কুরোসাওয়া প্রচুর শাণিত উক্তি করেছেন তাঁর আত্ম- জীবনীতে। সেন্সর বোর্ড তাঁকে যেভাবে ভুগিয়েছে, তাতে এটা খুবই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে আমার। আমাদের দেশের দেশের সেন্সর বোর্ডও মাঝে-মাঝে কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে। ১৯৭৭ সালে তারা বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’ ছবির প্রদর্শনী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এ ধরনের ধৃষ্টতার কথা শুনলে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় বৈকি, কারো কারো গা যদি রাগে রী-রী করে তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। কিন্তু সুখের বিষয় সেন্সর বোর্ডের সবজান্তাদের বিরোধিতার জন্যে কোনো কুরোসাওয়া কিংবা সত্যজিৎ-এর প্রতিভার বিপুল স্ফুরণ আটকে থাকে না, যেমন চিরদিন আটকে থাকে না সূর্যোদয়।
বহু বাধাবিপত্তি উজিয়ে কুরোসাওয়া সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছেন। ব্যর্থতা তাঁর মুখ ম্লান করে দিয়েছে বারবার, কিন্তু তাঁর অন্বেষাকে স্তদ্ধ করতে পারে নি, নিভিয়ে দিতে পারে নি তাঁর অন্তর্গত শিক্ষাটিকে। ভুলে গেলে চলবে না যে তাঁর শিরায় বয়ে চলেছে সামুরাই শোনিত, যা তাঁর মানসকে করেছে সংগ্রামজাগর, তরবারির মতো ঝলসে ওঠার ক্ষমতা। বাঁচার লড়াই ও শিল্পীর ক্রিয়েটিভ প্রসেস বিষয়ে যারা আগ্রহী, জীবনের জটিলতা সম্পরর্কে যারা জিজ্ঞাসু তাদের প্রত্যেকেরই এই বই অবশ্য পাঠ্য বলে মনে করি। বিশেষ করে তরুণ চলচ্চিত্র উৎসাহীদের তো বটেই।
Akira Kurosawa
SOMETHING
LIKE AN AUTOBIOGRAPHY
Vintage Books A Division of Rando.n Housa New York $6.95
# পাঠ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ধ্রুপদী (নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলনের মুখপত্র) পঞ্চম সংখ্যা আগস্ট ১৯৮৫ থেকে দেশলাই টিম কৃর্তক সংগৃহিত ।