স্নোপিয়ারসার: ক্লাইমেট বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বযুদ্ধ, শ্রেণীবৈষম্য
খান আলাউদ্দিন
জানুয়ারী, ১৩, ২০২৩
পৃথিবীর সময় ও স্থানের ফেব্রিকে, জীবাশ্মে চোখ রাখলে আমরা আবিষ্কার করতে পারি এর ঝঞ্ঝাময় অতীত, গ্রহ, গ্রহাণু ও ধূমকেতুর সাথে এর সংঘর্ষ, টেকটোনিক প্লেটের বিচ্যুতি, রাসায়নিক বৃষ্টি, গণবিলুপ্তি, প্রাণবৈচিত্রপূর্ণ ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ। বর্তমানেও যে পৃথিবী সংহত, স্থির কোনো অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা বলা যায়না। সমুদ্রস্তরের বৃদ্ধি, মরুকরণ, বন্যা, ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস আটকে পড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং অস্থির পৃথিবীকেই নির্দেশ করে। তবে প্রকৃতির পাগলামি, দুর্যোগ ঠেকিয়ে দিতে একটা উপায় মানুষের হাতে আছে, জিও ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু ৪.৫ কোটি বছর বয়সী পৃথিবীর নিজস্ব ব্যাকরণে মানুষের হস্তক্ষেপকৃত সংস্কার কোনো সুফলাফল বয়ে আনবেনা। ক্লাইমেট নোবেল থেকে অনুপ্রাণিত স্লোপিয়ারসার মুভিতে দেখা যায় বৈষ্ণিক উষ্ণায়ণ রোধ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এক হয়ে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে CW7 নামের একটি কেমিক্যাল ছড়িয়ে দেয়। CW7 কৃত্রিম শীতলীকরণ উপাদান যা পৃথিবীর উপরের স্তরে ছড়িয়ে দিলে সূর্যের আলো বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করতে পারেনা। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমতে থাকে। কমতে কমতে একসময় আরেকটি বরফ যুগ ঘনিয়ে আসে পৃথিবীতে। বাস্তবিক বিজ্ঞানীরা বৈষ্ণিক উষ্ণায়ণ রোধ করতে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে এ্যারোপ্ল্যানের মাধ্যমে সালফার ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। সালফার ডাইঅক্সাইড পৃথিবীতে সূর্যের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন আগমনে বাধাদান করবে। ফলে পৃথিবী উত্তরোত্তর তাপমাত্রা হারিয়ে শীতল হবে। কিন্তু সূর্যের আলোর অভাবে সালোকসংশ্লেষণ করতে না পেরে মারা পড়বে উদ্ভিদ, উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল প্রাণীকুল। বায়ুমন্ডলের উপরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হবে ওজোনমন্ডলে। সেইসব গর্ত দিয়ে পৃথিবীতে ঢুকে পড়বে উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্নি। যার ফলাফল হবে ভয়াবহ, সুদূর প্রসারী।
স্নোপিয়ারসার মুভির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বিজ্ঞানী উইলফ্রডের বানানো ’স্নোপিয়ারসার’ট্রেনের মধ্যে। মৃত, ওয়েস্টল্যান্ডে পরিণত পৃথিবী বিস্তৃত এর রেল লাইন। ক্লাইমেট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভূলে পৃথিবীতে বরফযুগ নেমে আসায় ধাবমান, উষ্ণ ট্রেনেই আশ্রয় মিলেছে জীবনযুদ্ধে নামা কিছু মানুষ। ট্রেনের ক্লোজড ইকোসিস্টেমে চাষ করা হয় বিভিন্ন শাকসবজি, মাছ, পোষা পাখি। তবে এগুলো ভোগ করতে পারেনা ট্রেনের লেজ অংশে বসবাসকারী নিচুশ্রেণীর ব্রাত্য মানুষেরা। তাদের খেতে দেয়া হয় কীটপতঙ্গ থেকে বানানো একধরণের চকোলেটবার। মুভিটিতে কীটপতঙ্গ থেকে বানানো চকোলেটকে গরিবের খাবার , অখাদ্য হিসেবে তুচ্ছ করা হলেও সুদূর ভবিষ্যতে কীটপতঙ্গই মানুষের ক্ষুধা নিবারণের উপায় হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বলছি কেন? এখনইতো অস্ট্রোলিয়ায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খদ্দেরদের ভাজা কীটপতঙ্গ পরিবেশন করা হয়। টেক্সাসে, ভিয়েতনামে গড়ে উঠেছে কীটপতঙ্গের খামার। সুপারশপগুলোতে পাওয়া যায় ঝিঁঝিঁর পাউডার, ভাজা কীট। কীটপতঙ্গ চাষের সুবিধাও অসামান্য। এরা গ্রীনহাউস গ্যাস কম নির্গমন করার পাশাপাশি গবাদিপশুর তুলনায় খাদ্যও অনেককম গ্রহণকরে। উপরন্তু প্রোটিনের জীবন্তখনি। ট্রেনের সম্মুখ অংশে বসবাস করে অভিজাতশ্রেণী। এদের জীবনমান অনেক উন্নত। বিনোদনের জন্য বার, বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য স্কুল, আছে চিকিৎসা সাপোর্টও।অর্থ্যাৎ আপার ক্লাস ও লোয়ার ক্লাস এই দুই শ্রেণীর মধ্যকার সংঘাত চিত্রিত হয়েছে মুভিটিতে। অস্ত্রধারী পাহারাদাররা নিঁচু শ্রেণীর লোকজনকে কখনোই উঁচুশ্রেণীর বগিতে প্রবেশ করতে দেয়না। তাই ট্রেনটিতে সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নামে সাধারণ মানুষেরা। পিতৃপ্রতিম গিলিয়াম কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে অবহেলিত বিপ্লবী মানুষদের নেতৃত্ব দেয় কার্টিস ও এডগার নামের দুই যুবক। ট্রেনের ই্ঞ্জিন দখল করতে গিয়ে তারা সশস্ত্র শ্রেণীসংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামের , ব্রাক্ষণ ও শূদ্রের, শাসিত ও শোষিতের। ট্রেনে নিঁচুশ্রেণীর মানুষদের সাথে উইলফ্রডের সৈন্যদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। সৈন্যদের বন্দুকে কোনো গুলি ছিলোনা, বিগত বিদ্রোহ দমন করতে গিয়েই তাদের সব প্রাণসংহারক গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিলো। তাই সৈন্যরা ধারালো কুড়াল নিয়ে বিপ্লবীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের কুড়াল কেড়ে নিয়ে বিপ্লবীরাও পাল্টা আক্রমণ করে।কুড়াল ম্যাসাকার দেখানো হয়েছে কখনো ক্যামেরা জুম করে, কখনো স্লোমোশনে। ভায়োলেন্স সিনটিতে বিপ্লবীদের রাগ ক্ষোভ টের পাওয়া যায় অত্যন্ত ভালোভাবে।ক্যাপ্টেন আমেরিকার ক্রিস ইভানস মেইন ক্যারেক্টার হিসেবে এখানেও কামাল করে দিয়েছেন। সাম্যের লড়াই ছাড়াও শিশুশ্রম দেখানো হয়েছে মুভিটিতে। ট্রেনের লেজ অংশে বসবাসকারী তানিয়া ও অ্যান্ড্রুর শিশুসন্তানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রেনের সম্মুখ অংশে। সেখানে তারা উইলফ্রডের ইঞ্জিনরুমে কাজ করতে বাধ্য হয়। শিশুরা কি কাজ করছে না আজকের পৃথিবীর বহু প্রতিষ্ঠানে, বাংলাদেশে, চীনে, আমেরিকায়?
মুভিটির সমাপ্তি খুব আশা জাগানিয়া। ক্রোনাল এক্সপ্লোশন পরবর্তী বরফধ্বসে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হলে শুধু ইয়োনা ও টিমি সারভাইভ করতে পারে। তারা ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হয়ে আসে এবং দূরে একটি পোলার বিয়ার দেখতে পায় যা সাক্ষ্য দেয় ট্রেনের বাইরেও প্রাণ বেঁচে আছে। পৃথিবী তার সংকট মুহূর্ত কাটিয়ে উঠছে , তাপমাত্রা বাড়ছে। অতিতাপ এবং অতিঠান্ডা উভয়ই ধ্বংসাত্মক, প্রাণীকুলের জন্য ক্ষতিকর। রবার্ট ফ্রস্টের ফায়ার এন্ড আইস কবিতার শুরুতেই রয়েছে যার উল্লেখ: “some say the world will end in fire, Some say in ice.”
ছবি: স্নোপিয়ারসার
পরিচালক: বং জন হু
ধরণ: সাই ফাই
অভিনয়ে: ক্রিস ইভানস, জেমি বেল, টিলডা সুইনটন, এড হ্যারিস, কাং হু সং, জন হার্ট, অক্টাভিয়া স্পেনসার, ভ্লাড আইভানভ, কো এসাং, ইউয়েন ব্রেমনার…