এই কথা আর নতুন করে বলবার দরকার নেই সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র দুটি আলাদা শিল্প। কিন্তু কতখানি আলাদা, দুই ভাইয়ের মতন? দুই বন্ধু বা প্রতিবেশীর মতন? অথবা দুই প্রতিযোগী?
চলচ্চিত্র প্রথমে এসেছিল শিশুর মতন সাহিত্যের কোলে চেপে। শুধু নড়া চড়া কিংবা ছোট ছোট স্ক্রিপ্টের বদলে কাহিনী চিত্র এলো, তখনই ডাক পড়লো সাহিত্যিকদের। হলিউডে গিয়ে বসতি নিলেন দেশ বিদেশের লেখকরা। এতে বায়োস্কোপ জগত লাভবান হয়েছে নিশ্চিত কিন্তু সাহিত্যের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। উদহারণ হিসেবে বলা যায়, এফ স্কট ফিটজেরাল্ডের মতন সূক্ষ্ম রুচি লেখকের মাথা খেয়ে ফেলেছে হলিউড। এরিক মারিয়া রেমার্ক জার্মান ছেড়ে হলিউডে আসবার পর আর কোনো স্মরণীয় উপন্যাস লিখতে পারলেন না। বোম্বাই ছায়াছবি জাদুও টেনে নিয়েছিল অনেক বাঙালী সাহিত্যিককে। বোম্বাইয়ের মুভি-মোগলরা সাহিত্যিকদের বানিয়ে ফেললেন মাইনে করা চিত্রনাট্যকার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ হাতছানি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই শেষপর্যপ্ত তিনি তারাশঙ্কর রইলেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র বোম্বাইতে গিয়েও পালিয়ে এসেছিলেন কিন্তু হারিয়ে গেলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নবেন্দু ঘোষের মতন লেখকরা।
বাংলা চলচ্চিত্রের আদি যুগে অনেক লেখক শধু যে গল্প সাপ্লাই করেছেন তা-ই নয়, চলচ্চিত্রকারের ভূমিকাও নিয়েছেন বেশ কয়েকজন। যেমন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ। জ্যোতির্ময় রায় নামে একজন প্রতিভাবান লেখক সাহিত্য জগতে সদ্য নাম করতে না করতেই ‘উদয়ের পথে’ নামে ফিল্মের কাহিনী লিখে এত সাথর্ক হলেন যে পুরোপুরি ডুব দিলেন সিনেমায়।
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল দুজনেই চলচ্চিত্র সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন। নজরুল গান লিখেছেন এবং অকালে অসুস্থ হয়ে না পড়লে তিনি নিশ্চিত আরও অনেক বেশী জড়িয়ে পড়তেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন, এবং ‘নটীর পূজা’তে দলবল নিয়ে অভিনয়ও করেছিলেন। (দুঃখের বিষয় ‘নটীর পূজা’র নেগেটিভ পুড়ে গেছে বলে আমাদের ভাগ্যে সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের অভিনয় দেখার সুযোগ ঘটেনি।) প্রসঙ্গত মনে পড়ড়ো, আমি আইসল্যান্ডের একটি সিনেমা দেখেছিলাম একবার। ছবিটির নাম ‘প্রথম প্রেম’। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ল্যাক্সনেস-এর কাহিনী নিয়ে ছবি, এবং স্বয়ং ল্যাক্সনেস তাতে অবতীর্ণও হয়েছেন। (সাদ। দাড়িওয়ালা ওঁর চেহারা অনেকটা রবীন্দ্রনাথেরই মতন!)
ক্রমশঃ চলচ্চিত্রের সার্থক স্রষ্টারা আত্মাভিমানবশতঃ সাহিত্যের সংশ্রব সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে চান। হ্যাঁ, চলচ্চিত্রেও একটা কাহিনী থাকবে বটে কিন্তু সে কাহিনী সাহিত্য থেকে ধার করবার দরকার নেই, তার ভাষা আলাদা। ফিল্ম ল্যাঙ্গোয়েজ কথাটা এই থেকে চালু হয়। জাঁ রেনোয়া আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে তাঁর একটি চিত্রনাট্য সংকলনের ভূমিকায় দেখলুম, তিনি নিজেকে শুধু ডিরেক্টর বলেন নি, তিনি দাবী করেছেন, যেহেতু সমগ্র চলচ্চিত্রটি তাঁরই সৃষ্টি, সেই জন্য তিনি অথর অব দা ফিল্ম। এটা একটা নতুন কথা। ইংগমার বার্গমানকে সেই হিসেবে বলা যায় সেলুলয়েডের দার্শনিক। তাঁর প্রত্যেকটি ছবিই তাঁর নিজস্ব কাহিনী সূত্র ধরে এক একটি দর্শনের প্রতিফলন। ধর্ম, প্রেম এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক- এই তিনটি বিষয় নিয়েই তিনি বারবার প্রশ্ন তুলেছেন।
আইজেনস্টাইন ও ফ্লাহার্টি থেকে একালের কুরোশাওয়া, ওয়াইদা, বুনুয়েল, ফেলিনী প্রমুখ অনেকেই বিখ্যাত সাহিত্য কীর্তির দ্বারস্থ হননি। চিত্রনাট্য রচনায় এঁরা কেউ কেউ মাঝারি ধরনের লেখকদের সহায়তা গ্রহণ করেন বটে, কিন্তু এঁদের সিনেমাকে কোনো ক্রমেই সাহিত্য ঘেঁষা বলা যায়না। কিন্তু কোনো সার্থক ফিল্ম দেখে যে রস আমরা পাই, সেটা কী রস? তাকে কি সিনেমা-রস হিসেবে আলাদা কোনো নাম দেওয়া যায়! শিল্প-রস বলা যেতে পারে অবশ্যই, কিন্তু শিল্প বলতে এখনো আমরা সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত এই সব কটিকেই এক সঙ্গে বুঝি। সিনেমা কি এর সঙ্গে যুক্ত হবার মতন আলাদা কোনো রস হতে পেরেছে? কিংবা এই তিনেরই সম্মিলত রস?
ষাটের দশকে ফরাসী দেশের তরুণ চলচ্চিত্রকারের ‘নবতরঙ্গ’ নামে এক আন্দোলন শুরু করে সিনেমাতে কাহিনীর পারম্পর্যই বাদ দিতে চাইলেন। অথাৎ সাহিত্য থেকে আরও দূরে সরে যাবার চেষ্টা। শিল্পের সব ক’টি শাখাই এক সময়ে অ্যাবস্ট্রাকশানে পৌঁছোবার চেষ্টা করে। সঙ্গীত সবচেয়ে বেশি সঠিকভাবে বিমূর্ত। সাহিত্য এবং চিত্রকলাও অনেক সময় বাস্তবে দাঁড়িয়ে বিমূর্ত সীমানায় পৌঁছেছে। বিশেষতঃ এই শতাব্দীতে চিত্রকলা যেন একেবারেই বাস্তব ত্যাগ করে বিমূর্ত হতে চেয়েছে। তবে, শিল্পের এই তিনটি শাখাই বেশ প্রাচীন, অনেক ঐতিহ্য পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাদের। সেই তুলনায় সিনেমা বেশ অর্বাচীন, তার বয়েস এক শতাব্দীও নয়। এত তাড়াতাড়ি তার বিমূর্ত হবার জন্য লম্ফঝম্ফ যেন ঠিক শোভা পায় না। ত্রুফো, গদার প্রমুখের কিছু ফিল্ম এই জন্য অ্যাবস্ট্রাকশানের ক্যারিকেচার বলে মনে হয়েছে। সুখের বিষয়, পৃথিবীর খুব বেশী চলচ্চিত্রকার এ পথে পা বাড়ান নি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, সাহিত্য এবং চিত্রকলাও যেন বিমূর্তবাদ পরিবর্জন করে আবার স্বাভাবিক বর্ণনায় ফিরে আসতে চাইছে।
সত্যজিৎ রায় কিন্তু প্রথম দিক থেকেই ক্ল্যাসিকাল এবং আধুনিক সাহিত্যকে গ্রহণ করেছেন তাঁর চলচ্চিত্রের জন্য। তাঁর স্বরচিত কাহিনীও তিনি নিয়েছেন, তার দুটি বাদ দিলে (কাঞ্চনজঙ্ঘা ও নায়ক) বাকিগুলি ছোটদের জন্য। সত্যজিৎ রায়ই এ যুগে ধারাবাহিক ও সার্থকভাবে দেখিয়ে গেছেন যে সাহিত্য ভিত্তিক হলেও চলচ্চিত্র কী ভাবে আলাদা ভাষার সুষ্টি করতে পারে। মৃণাল সেন অবশ্য এখনো ঠিক কোনো ক্লাসিক কাহিনী নেন নি, তবে, তাঁর প্রায় সব চলচ্চিত্রের সঙ্গেই কাহিনীকার বা চিত্রনাট্যে সাহায্যকারী হিসেবে কোনো না কোনো আধুনিক লেখক যুক্ত। এতদিনে মৃণাল সেনেরও একটা আলাদা ভাষা আমরা পেয়েছি।
সিনেমা থেকে আমরা যে-রস পাই, তার যে অনেকটাই সাহিত্য রস, তাতে কোনো সন্দেহ আমার অন্ততঃ নেই। একটি দুটি সংলাপও যদি বেসুরো হয়, তবে সে সিনেমা আমাদের মনে দাগ কাটে না। সংলাপের এই বাঁধুনি সাহিত্যকে বাদ দিয়ে হয় না। এ ছাড়া, সিনেমায় বাস্তবের যে অনুকরণ, সেই ভঙ্গিটিও সাহিত্য-অনুগত। বড় বড় চলচ্চিত্রকাররা সাম্প্রতিক সাহিত্য রচনা কিংবা সাহিত্যিকদের সাহায্য না নিয়েও যদি স্বরচিত কাহিনী নিয়ে একটার পর একটা সার্থক চলচ্চিত্র সৃষ্টি করে যান, তাতেও প্রমাণিত হয় না যে ঐ সব সিনেমা সাহিত্যের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক শূন্য। তাতে এই-ই প্রমাণিত হয় যে ঐ সব চলচ্চিত্রকাররা আসলে ভেতরে ভেতরে গুপ্ত সাহিত্যিক। কাগজ-কলমের বদলে এঁরা সেলুলয়েডে শব্দ-ছবি ফোটাচ্ছেন। চলন্ত ছবির আবিষ্কার না হলে বোধহয় এঁরা লেখকই হতেন। এমনিতেই দেখা যায়, মাঝে মাঝে যখন কলম ধরেন, তখন প্রত্যেক বড় চলচ্চিত্রকারই বেশ ঝকঝকে লিখতে পারেন। সুইডেনে এখনো অনেকের ধারণা, বার্গমান চলচ্চিত্রকার হিসেবে যতটা বড়, তার চেয়েও বড় নাট্য পরিচালক এবং লেখক। ফেলিনীর ‘সাড়ে আট’ কিংবা ‘আমার মনে পড়ে’ (আমার-কর্ড) দেখার পর আমার মনে হয়েছিল, দুটি অত্যন্ত চমৎকার আধুনিক রচনা দেখলুম, যার উপাদান সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র ভাষা।
# পাঠ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ধ্রুপদী (নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলনের মুখপত্র) পঞ্চম সংখ্যা আগস্ট ১৯৮৫ থেকে দেশলাই টিম কৃর্তক সংগৃহিত ।