“ধ্রুপদী”কে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখার কথা যখন কবুল করেছিলেন, তখন থেকে মনে মনে বিচলিত। চলচ্চিত্র নিয়ে লেখার কোন অধিকার তো নেই আমার। দর্শক হিসাবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও হারিয়ে ফেলেছি। বছরে একটি ছবি দেখা হয় কিনা হয় সন্দেহ। এমন অবস্থায় কি বলতে পারি। পৃথিবীখ্যাত যে সব চলচ্চিত্র মানুষকে প্রেরণা দেয়, তারই বা কয়টি দেখেছি। তাই কিছু টুকরো স্মৃতি ও ভাবনা ও চিন্তা লিপিবদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।
“ধ্রুপদি” ঢাকা থেকে বেরোচ্ছে। আমরা যখন ঢাকায়, জিন্দাবাহার লেনে মামাবাড়িতে শৈশব কাটাতে যেতাম, তখন দিদিমার সঙ্গে আদরের নাতনি আমি, আর্মানীটোলা পিকচার হাউজে ছবি দেখতে যেতাম। এখনকার দুই পারের বাংলাভাষী ছেলেমেয়েদেরই অবাক লাগবে, ছবি দেখার ব্যাপারটি কি রোমাঞ্চকর ছিল। ঘোড়ার গাড়ি চেপে যাওয়া, চিনেবাদাম কেনা, দিদিমার সঙ্গে বক্সে বসে ছবি দেখা!
আমরা দেখতাম তিনদিন ধরে চলা নির্বাক ছবির সিরিয়াল, ‘গ্যালপিং গোস্ট’-কিছু, মনে নেই। ‘ট্রেডার হর্ন,’ ‘কিড’, ‘মডার্ন টাইমস’ বেশ মনে পড়ে। আর মনে পড়ে বছর খানেক ধরে চল ছবি ‘অচ্ছৎ কন্যা’। কিশোর নায়ক ও কিশোরী নায়িকার দ্বৈত গান ‘ম্যয় বন কি চিড়িয়া’র সময়ে পর্দায় ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া লাল গোলাপি রং দেখা যেত। আমরা প্রভূত রোমাঞ্চিত হতাম। তখন পরাধীন দেশ। পর্দায় যৌনতার আমদানী হয়নি। অত্যন্ত নিষ্পাপ সে দ্বৈত গানটিকে তখন, আজকের ভাষায় অপসংস্কৃতি মনে করা হত।
নিজের কাক সুধীশ ঘটক বিলেত থেকে সিনেমাটোগ্রাফি শিখে এলেন, একটু দূরের কাকা নীরেন লাহিড়ী হলেন পরিচালক, ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’ কাগজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বড় মামা সচীন চৌধুরী কিছুদিন বোম্বে টকিজের ব্যবসায়িক কর্মভার নিলেন, সেজমামা হিতেন চৌধুরী চলচ্চিত্র শিল্পে নানাভাবে যুক্ত হলেন বোম্বেতে, আমার ভাই অবু ঘটক হল চিত্র সাংবাদিক, আর চলচ্চিত্র জগতে আমাদের পরিবারের সব চেয়ে বড় মানষ ঋত্বিক তো সব অর্থেই চলচ্চিত্রে নিজের জায়গা নিজের হিম্মতে করে রেখে গেল। বিজন চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেন, ঋত্বিকও করল। তবে চলচ্চিত্রে এ পরিবারের প্রথম অভিনেতা আমার বাবা মনীশ ঘটক। ১৯২৩-২৪ সালে অসম্ভব রোগা শরীর এবং ছয়ফুট চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্য নিয়ে তিনি নীতিন বসুর কোন স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে চোর সেজে নারকেল গাছে উঠেছিলেন ও নেমে ছিলেন।
এ ভাবেই চলচ্চিত্র পরিবারের মধ্যে ঢুকে যায়। আর, যতজনের নাম লিখলাম, হিতেন চৌধুরী ও নীতিন বসু ছাড়া সকলেই মৃত। বাবা ছাড়া কেউই বৃদ্ধও হতে পেলেন না।
কি ছবি দেখেছি, কি মনে পড়ে, তার মধ্যে গিয়ে লাভ নেই। অতীতের কথা বর্তমানের পাঠকের ভাল লাগবে না।
কি দেখেছি তা বলব না। কি দেখতে ইচ্ছা করে তাই বলতে পারি। সর্বদাই মনে হয়, পেশাদারী সাহিত্য যেমন (অধিকাংশ), চলচ্চিত্রে তেমনি দেশ ও মানুষ থাকে অনুপস্থিত। চলচ্চিত্র তো এক প্রভূত ক্ষমতাশালী মিডিয়াম। যে দেশে (দুই বাংলায় যেমন) নিরক্ষর মানুষ বেশি, সে দেশে চলচ্চিত্র মানুষকে অজানিতেই রক্তে রক্তে প্রভাবিত করতে পারে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে যা যা দেখেছি তা এই রকম– । নকশাল আন্দোলনে ধৃত বন্দীদের ওপর যে অকথ্য, অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়, তা প্রেসের মাধ্যমে অণুমাত্র প্রকাশ পায়, তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, তারকুন্ডে কমিশন ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু প্রকাশ পেল। তাছাড়া মুখে মুখে খবর চলত, গোপন থাকেনি। এমন কাজ করা চলে তাই কেউ জানত না। কেন না ব্রিটিশ সরকারও এমন উন্নত পর্যায়ে নির্যাতন চালায় নি। কিন্তু শিক্ষিত বা বুদ্ধিজীবী মহল এও দেখল দেশের সবার সঙ্গে, যে এমন অত্যাচার করা চলে কিন্তু অপরাধীর কোন শাস্তি হয় না। এই একই সঙ্গে গত দশ-বার বছরে উন্মত্ত হিংসা, খুন, ইত্যাদি, অথাৎ নগ্ন ভায়োলেন্স উপজীব্য করে বহু চলচ্চিত্র তৈরি হল। যার প্রতীকী উদাহরণ “শোলে”। এ সব ছবিতে সেন্সর ও ফমুর্লা মেনে শেষে পুলিশ অপরাধীর শাস্তি বিধান করল, পাপের পতন ও পুণ্যের জয় ঘোষিত হল। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জের উঠতি তরুণ, যারা অর্ধশিক্ষিত-স্বল্প-শিক্ষিত-অশিক্ষিত, তাদের মানসে ওই অবিবেকী ভায়োলেন্সটি ছাপ কাটল, ফর্মুলার সমাধান দাগ কাটল না। কেননা সিনেমা যখন দেখে, দর্শক জানে, এটা সিনেমা। বাস্তবে খুনীতে-পুলিশে গভীর আঁতাত এবং পুলিশ প্রকৃত অপরাধীকে ধরছে এমন অভিজ্ঞতা কারোই ঘটে নি। অতএব ওই সুস্থ সমাধান বর্জনীয়। এমন চলচ্চিত্র একের পর এক দেখতে দেখতে তিন রকম প্রতিক্রয়া মনে স্থায়ী হয়:
এক. ভায়োলেন্সে অহেতুক আসক্তি জন্মায়। এবং এ কোন রাজনীতিক উদ্দেশ্য প্রাণিত ভায়োলেন্স নয়। সিনেমার ভায়োলেন্স-এর Build up হয় দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার দেখিয়ে। চলচ্চিত্রকার এ কাজটি যত detail-এ করেন পাপের পতন, পুলিশ কতৃক অপরাধীর শাস্তি বিধান, সেগুলি তত যত্নে সারেন না। ফলে,-
দুই. পুলিশ বা বিচারক বা ভাগ্যদেবতা দ্বারা নৃশংস অপরাধীর শাস্তিবিধানের ব্যাপারটি বাস্তবের সঙ্গে মেলে না বলে দর্শক ওটিকে সহ্য করে যান মাত্র। ভায়োলেন্সের ব্যাপারটি কিন্তু তাঁর বাস্তবের সঙ্গে মেলে। ফলে,-
তিন. মানব জীবন ও মানব শরীর সম্পর্কে এক চূড়ান্ত পাশবিক মনোভাব জন্ম নেয়। যন্ত্রণা ও নির্যাতনে জন্মায় আসক্তি। মানুষকে নানাভাবে মারা চলে, কেন না মানুষ বস্তুটাই মূল্যহীন।
এমন মানসতার অন্যতম পরিচয় দেশের বহু জায়গায় আজকাল নতুন মজায় দেখা যাচ্ছে। মানুষকে অন্ধ করে দেওয়া এবং অন্ধ করে দেবার সপক্ষে প্রবল জনমত কোন মানসতা থেকে জন্ম নেয়? তাতে চলচ্চিত্রের অবাধ, বর্বর ও নিরর্থ ভায়োলেন্সের অবদান কতখানি?
ভায়োলেন্স আমার প্রিয় বিষয়। অর্থপূর্ণ ভায়োলেন্স। যে ভায়োলেন্সের ফলে সমাজে অগ্রগতি ঘটে। যে ভায়োরেন্সের প্রকাশ ঘটে বিদ্রোহে-বিপ্লবে। সে কথা থাক।
আমার তাই, অনেক কম দেখা ছবি থেকে কিছু কিছু, ছবির কথা মনে পড়ে। নিজের দেখা জীবনের সঙ্গে মেলাই। আমাদের দুই বাংলায় কি তরুণের বিদ্রোহ কম? “ইফ” এর মত ছবি হয় না কেন? “ইফ” হতে পারে যদি এ ভূখণ্ডেও কিছু হতে পারত।
আখ-চাষী কৃষ্ণাঙ্গ নিয়ে যদি “কুয়েমাদা” হতে পারে, উপদ্বীপের কৃষিভিত্তিক জীবন আশ্রিত তেমন ছবি কেন হয় না? “ব্যাটল অফ অ্যালজিয়ার্স” দেখেছি আর অন্য একটি ছবি, (“আর্জেন্টিনা”?) তার শেষে ছিল চে গুয়েভারার মৃত দেহ ঘিরে সনাক্ত প্যারেড।
মজনুশাহ, তিতুমীর, নীল চাষী, লুসাই, সাঁওতাল, এ সব বিদ্রোহের যথাযথ ছবি হলে তাতেও ভায়োলেন্স থাকবে, কিন্তু, তা মূল্যবোধ ফিরাবার ভায়োলেন্স, মানুষকে পশু বানাবার নয়। গত দশ-বার বছরে দুই দেশে অনেক সার্থক আত্মদান ঘটেছে। ভোজপুরের জগদীশ প্রসাদ বা বাংলাদেশের সিরাজ সিকদারকে নিয়ে ছবি দেখতে ইচ্ছা করে। একদা রসেলিনি তো “ওপন সিটি” করেছিলেন। এ সব ছবিতে দেখতে ইচ্ছা করে। আর এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ঋত্বিকের কথা। স্বীয় মিডিয়ামের জন্য মরতেও রাজী থাকবে যে চিত্রনির্মাতা, সে-ই কোনদিন চলচ্চিত্রের অপরূপ ভাষায় অন্য মূল্যে ও অর্থে ভায়োলেন্সকেও উপস্থাপিত করবে। আমি সে ছবি দেখব না। অন্যরা দেখবে, দেখবে কি?
# পাঠ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ধ্রুপদী (নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলনের মুখপত্র) পঞ্চম সংখ্যা আগস্ট ১৯৮৫ থেকে দেশলাই টিম কৃর্তক সংগৃহিত ।