যখন একটি অণুগল্প পাঠ করি, তখন এমন এক উচ্চতায় নিবিষ্ট করি আমার মন আর মগজ; প্রকৃতপক্ষে অই রকম হয়েই যায়;—আমার ভেতরে একধরণের অপারশূন্যতার সৃষ্টি হয়; বলা ভাল: আমি আসলে জাগতিক ভর/ বলের মধ্যে থাকি না। থাকা সম্ভব হয় না। আমি আর আমার আশপাশ কর্মহীন হয়ে পড়ে। গল্পপাঠে মনোযোগ দেয়ার সাথে সাথে আমার অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কার্যক্রম থেমে যেতে যেতে স্থির হয়ে যায়। উল্লসিত হয়ে হা হা করতে থাকে ভেতরের কেউ। আর উল্লেখিত এই ভাবাবস্থা না হলে বা না ঘটালে আমার অণুগল্পপাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যায়। আমার চিন্তাসূত্র একটি সূত্রে গুটিয়ে আনতে না পারলে অণুগল্প পড়ে বুঝে উঠতে পারি না। এটা কি আমার একারই সমস্যা? জানি না। তবে— একটি সার্থক অণুগল্পকে বুঝে না ওঠার বিষয়টি যত না অণুগল্পের এখতিয়ারে, তারচেয়ে অনেক বেশি পাঠকের। তার প্রস্তুতির, তার পাঠ্যাভাসের, তার মন আর পরিস্থিতির আনুকূল্যের ওপর নির্ভর করে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
আবার, একটি অণুগল্পকে অণুগল্প হিসেব না দেখে সাহিত্যের যে কোন বিভাগের, হোক গল্প/ছোটগল্প কি একটি ‘রচনা’ হিসেবেই পড়ি, হয়ত উল্লেখিত মানসিক যে বিবরণ দেয়া হল—সে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হত না। কিন্তু অণুগল্প সম্পর্কিত যে ধ্যানধারণা/কৌশল/শৈলী বিন্দু বিন্দু করে মনের ভেতরে জমা হতে হতে টলটলে জলাধারে পরিণত হয়েছে, সে জলাধারে একটি অ-অণুগল্পীয় শব্দ পঙক্তি এমন কি একটি বাড়তি যতিচিহ্নের ছায়া পড়লেও সে জলাধারে অস্বস্তিজনিত ঢেউ ওঠে।
অন্যদিকে, একজন অণুগল্প-না-জানা পাঠক হয়ত গল্পটি পড়ে আনন্দ পেতে পারেন, রসসিক্ত হতে পারেন, যে বিস্ময়/ভাবনা-বেদনাবোধ করেন একটি ছোটগল্প/ উপন্যাস পাঠ করে, অণুগল্প পাঠেও সেটি পাচ্ছেন, পেতে পারেন। তবে কেন পাঠককে আলাদা করে অণুগল্প বিষয়ক সচেতনার কথা বলা হবে? কেন প্রস্তুতি/পাঠ্যাভাস/মন আর পরিস্থিতির আনুকূল্যের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হবে? —প্রশ্নটি গুরুতর সন্দেহ নেই।
ধরি, একজন পাঠকের একটি গল্প/কবিতা/গান বা যে কোন সৃজনশীল শিল্প ভাল লাগছে, আপ্লুত হচ্ছে মন—এর পেছনের কারণটি একজন সাধারণ পাঠক/শ্রোতার জানা নেই কেন ভাল লাগছে এই গল্প/কবিতা/সঙ্গীত। এর নেপথ্যে অই কবি গল্পকার সঙ্গীতকার যে কী ভীষণ দক্ষতার সাথে ভাল লাগার অই বস্তুর ভেতরে প্রবেশ করিয়েছেন নানা উপাদান—সে বিষয়ে কোন ধারণাই থাকে না। এই যে নানা উপাদানের সমাহারে প্রস্তুত করা শিল্পকর্ম, এর ভেতরের মশলাগুলি সম্পর্কে একজন পাঠক/শ্রোতা আগে থেকেই জানা থাকলে অই ভাললাগাটুকু আরও কয়েকগুণ বেড়ে যেত। অই পাঠক/শ্রোতা হতেন অই গল্প-কবিতা-সঙ্গীতের সমঝদার। এই অর্থেই বলা: অণুগল্প থেকে অধিক রসাস্বাদন তখনই সম্ভব হয়—যখন এর ভেতরের করণকৌশল বা অণুগল্পকে ভাল লাগানোর জন্যে লেখকেরা কী কী বিষয়কে ধারণ করেন, প্রয়োগ করেন— সে সম্পর্কে পাঠকের কিছুটা হলেও জানাশোনা থাকে যদি।
অণুগল্প কোন সাধারণ আখ্যান নয়। কোন আখ্যানকে ঢালাওভাবে অণুগল্প বলা হয় না। তবে অণুগল্পে আখ্যান থাকতে পারে। নাও থাকতে পারে। ভাবাশ্রয়ী অগল্প-নাগল্পও অণুগল্পের মর্যাদা পেতে পারে। এখন পর্যন্ত, লক্ষ্য করা গেছে, অণুগল্পের শরীর জুড়ে দশ রকমের উপাদান ঘিরে থাকে। এর মধ্যে উপাদান হিসেবে স্বল্পায়তন, মেদহীন আর বহুস্বর এগিয়ে থাকলেও অন্যান্য উপাদানগুলির কম গুরুত্ব বহন করে—সেরকম না। যেমন রহস্যময়তা, শুরুর ম্যাজিক, বিস্ময় পরিণতি, যতিচিহ্ন, উলম্ফন, বিষয়বস্তু এবং মোচড়/অভিঘাত/টুইস্ট—এসব উপাদানের ব্যবহারের ফলে একটি অণুগল্পের সৌন্দর্য বিকাশিত হয়ে যে মোহনরুপ লাভ করে একজন সাধারণ পাঠক হয়ত সে ভেতরগত রূপের পরিচয় না পেলেও রূপমোহাবিষ্ট হতে পারেন। কিন্তু এই রূপ সৌন্দর্য-সৃষ্টি হওয়ার ভেতরগত কারণটি জানা থাকলে পাঠকের অণুগল্পের সৌন্দর্যমুগ্ধতা শতধারায় প্রবাহিত হত নিঃসন্দেহে।
এই নিবন্ধে মোট চারটি অণুগল্প নিয়ে আলোচনা হবে। প্রতিটি অণুগল্পেই যে বর্ণিত লক্ষ্ণালক্ষণগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, হবে তা নয়। একটা কথা প্রথমে বলে নেয়া ভাল : সব অণুগল্পেই যে অণুগল্পের সব উপাদানের ব্যবহার হবে তা নয়। গল্পানুযায়ী নির্ধারিত হয়ে ওঠে কোন গল্পে কোন উপাদান ব্যবহার করা হবে। তবে স্বল্পায়তন, মেদহীনতা, শুরুর ম্যাজিক, উল্লম্ফন—এই কয়টি উপাদান ব্যবহারে অগ্রগণ্যতা পেয়ে থাকে বেশি। এই উপাদান ব্যবহারের ফলে একটি অণুগল্পকে ‘আখ্যান’ থেকে আলাদা করে দেয়।
কীট [] মুহাম্মদ এস আলম চৌধুরী
আব্দুল মতিন খুবই গোবেচারা ধরনের মানুষ। গ্রামে তার ভালো মানুষীর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। একলা হিসেবে আজ দীর্ঘদিন এই গ্রামে পরে আছে। যদিও নির্দিষ্ট কোন কাজ করে না। তবুও তার চলে যায় এদিক ওদিক ঘুরেফিরে। গাঁয়ের এক প্রান্তে তার ছোট্ট কুটির। তবে সেখানে রাতের অন্ধকার ছাড়া যাওয়া হয়না তার। কোন এক আশ্চর্য কারণে প্রতিনিয়ত লোকালয়ে থাকতে সে স্বস্তিবোধ করে।
কিন্তু এক বিচিত্র সমস্যার কারণে সে সহজে লোকারন্যে দীর্ঘক্ষণ বসতে পারে না। যেখানেই যায় তার কিছুক্ষণ পরই তার আশপাশে বিচিত্র সব পোকামাকড়ের আস্তানা হয়ে উঠে। নাহ, তাকে কিছুই করেনা। তবে যারা তার আশেপাশে যারা থাকে তাদের বিব্রতকর অস্বস্তিতে পড়তে হয়। যারফলে কেউ তার সঙ্গ পছন্দ করেনা। অনেকেই এনিয়ে হাজারো মন্তব্য করলেও কোনদিন মতিনের মুখ থেকে কখনোই কেউ কিছুই শুনলো না। অবশ্য মতিনকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষও কোথাও নেই।
রাতের নির্জনতাকে সাথে করে যখন সে ঘরে ফিরে, তখন চারদিকে ঝিঁঝি পোকার রব উঠে। অনেক্ষণ সে বসে থাকে বাইরে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার চারপাশে ঘূর্ণমান অদ্ভুত সব পোকামাকড়দের। একসময় ঘরে ঢুকে সে। তখন তার সঙ্গীসাথীরা কেউ আর তার সাথে ভিতরে প্রবেশ করেনা। ঘরে সে একা। মাটিতে বিছানা পেতে মাটি আগলে শুয়ে থাকে। এখানেই সে শুয়ে শান্তিতে থাকে। কিন্তু বুকের ভিতরে পুরোনো তীব্র যাতনায় তার শান্তির ঘুম কেড়ে নেয় এক নারীর অবয়ব। যাকে সে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিয়েছে এই ঘরের মেঝেতে। তার শরীর থেকে সৃষ্ট পোকামাকড়েরা মতিনকে স্বস্তি দেয়না কখনোই। তারা বার বার বাধ্য করে প্রিয়তমা স্ত্রীর বুকে শুয়ে থাকতে।
আমি নিজে অণুগল্প লিখতে গেলে গল্পকে ত্রুটিমুক্ত আর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার লক্ষে উপরিউল্লেখিত উপাদান মাথায় রাখি। সে অনুযায়ী লিখি। সবাইকে লিখতেও আহবান জানাই।
এ-গল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সেসব উপাদানের কমতি আছে। আমরা প্রায়-ই বলি যে— অণুগল্পে ‘শুরুর ম্যাজিক’ থাকতে হবে।
শুরুর ম্যাজিকটি কি? অণুগল্পের মুখ্য উপাদান ‘ স্বল্পায়তন’ হওয়ার ফলে কোন রকমেই বাড়তি শব্দচাপ নিতে চায় না। এই শব্দচাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যেই লেখার সময় লেখককে চাপের মধ্যে থাকতে হয়। চাপমুক্ত হওয়ার একটিই উপায়, অবশ্যই গল্পের শুরুতেই কোনপ্রকার শব্দজটে গল্পকে না আটকিয়ে সরাসরি গল্পের অন্দরমহলে ঢুকে যেতে হবে। পাঠক নিজের ঠোঁট নড়ে ওঠার আগেই নিজেকে বারবাড়ি থেকে ভেতরবাড়িতে আবিস্কার করে ফেলবে। ততক্ষণে গল্পের ২০ পারসেন্ট হয়ত অতিক্রম করে গেছে। এটাই হল যাদু। পাঠক গল্প থেকে চোখ তুলতে পারবে না। যখন তুলবে ততক্ষণে গল্প শেষ।
অণুগল্পে ‘শুরুর ম্যাজিক’ নানাভাবে প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে। এর জন্যে আছে পৃথক আলোচনা।
‘শুরুর ম্যাজিক’ তখনি দারুণভাবে মার খেয়ে যায়, যখন গল্পের ভেতরে ভুমিকা চলে আসে। অর্থাৎ ভূমিকার মাধ্যমে গল্প শুরু হলে যাদুর যে তেলেসমাতিত্ব—সেটি আর থাকে না। এই স্টাইলটি ছোটগল্পের ফর্মেটের সাথে যায়। আর অণুগল্পে এই ‘ভূমিকা’ যদি রাখতেই হয় খুব মুনশিয়ানার সাথেই ব্যবহার করতে হবে।
এই গল্পে উল্লেখিত ‘শুরু ম্যাজিক’ নেই। ছোটগল্পের ফর্মেটের মত ক্লান্তিকর বড়সড় ভূমিকা আছে। প্রথম স্তবক—‘আব্দুল মতিন খুবই গোবেচারা ধরনের মানুষ। গ্রামে তার ভালো মানুষীর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। একলা হিসেবে আজ দীর্ঘদিন এই গ্রামে পরে আছে। যদিও নির্দিষ্ট কোন কাজ করে না। তবুও তার চলে যায় এদিক ওদিক ঘুরেফিরে। গাঁয়ের এক প্রান্তে তার ছোট্ট কুটির। তবে সেখানে রাতের অন্ধকার ছাড়া যাওয়া হয়না তার। কোন এক আশ্চর্য কারণে প্রতিনিয়ত লোকালয়ে থাকতে সে স্বস্তিবোধ করে’— এখানে কোন গল্প নেই, গল্পের ভেতরে ঢোকার জন্যে প্রস্তুতি আছে। অণুগল্পে এত প্রস্তুতির কিছু নেই।
দ্বিতীয়ত, গল্পের ভেতরে ভাষার গুরুচণ্ডালীও আছে। সাধু ও চলিত ভাষার সহঅবস্থানকে যেমন গুরুচণ্ডালী বলে, একইভাবে একটি গল্পের ‘ভাষা ও মেজাজ’ একই রকম না হলে গুরুচণ্ডালীর অপবাদে গল্পের মুখে চুনকালি পড়ে। এই গল্প জুড়ে আমি ব্যাপক চুনকালি দেখতে পেয়েছি। যেমন—
ক। গাঁয়ের এক প্রান্তে তার ছোট্ট কুটির। খ। তখন চারদিকে ঝিঁঝি পোকার রব উঠে। গ। তার শরীর থেকে সৃষ্ট পোকামাকড়ের... ঘ। বিব্রতকর অস্বস্তিতে পড়তে হয়। ঙ। চারপাশে ঘূর্ণমান অদ্ভুত সব পোকামাকড়দের… চ। ঘুম কেড়ে নেয় এক নারীর অবয়ব…
এইসব পংক্তিগুলো এবং এইসব পংক্তিতে ব্যবহৃত ‘রব’ ‘সৃষ্ট’ ‘বিব্রতকর’ ‘ অস্বস্তিতে’ ‘ঘূর্ণমান’ অবয়ব’ শব্দের সাথে—
‘আব্দুল মতিন খুবই গোবেচারা ধরনের মানুষ। গ্রামে তার ভালো মানুষীর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। একলা হিসেবে আজ দীর্ঘদিন এই গ্রামে পরে আছে। যদিও নির্দিষ্ট কোন কাজ করে না। তবুও তার চলে যায় এদিক ওদিক ঘুরেফিরে। গাঁয়ের এক প্রান্তে তার ছোট্ট কুটির। তবে সেখানে রাতের অন্ধকার ছাড়া যাওয়া হয়না তার। কোন এক আশ্চর্য কারণে প্রতিনিয়ত লোকালয়ে থাকতে সে স্বস্তিবোধ করে’— এই বর্ণনার সাথে যায় না।
গল্পের প্রথম প্যারার মধ্যে আছে রূপকথাভিত্তিক আবহ।
গল্পের মেজাজ ও ভাষা একজাতীয় না হলে অণুগল্প সে-পুকুরে হাবুডুবু খাবে যে- পুকুরে জল কম, কাদা বেশি।
‘গল্পের মেজাজ আর ভাষা দুটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা।
গল্পের মেজাজ কী হবে আগে সেটা ঠিক করতে হবে। আর চিন্তা করে এটা ‘ঠিক’ করা সম্ভব নয়। লিখতে লিখতেই সব ঠিক হবে।
গল্পের মেজাজ রোমাণ্টিক ও ধ্বনিময় হতে পারে। ঘরোয়া বৈঠকি হতে পারে। সহজ ঠাণ্ডাও হতে পারে।
কাব্যিক হতে পারে। হতে পারে নৈব্যক্তিক।
ভাষা-ই গল্পের মেজাজ তৈরি করে। মেজাজ পাঠকের মনে আবেগের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে ঐ গল্পের জন্যে ভাষাকে সুনির্দিষ্ট করে।
চলিত আর সাধুর মিশ্রণ যেমন দূষণীয়, একই ভাবে গল্পের মেজাজ আর ভাষা ভিন্ন হলে গল্পের ‘ ম্যাচিং’ ঠিক থাকবে না –গল্পের জন্যে এটা বড় ধরণের ধ্বস।
সুতরাং, গল্পের মেজাজ ও ভাষা অনুযায়ী গল্পের শব্দ -বাক্য রচিত হয়। গল্পের উপমা, চিত্রকল্প আর পংত্তির আকার ছোট -বড় হয়। পাল্টে যায় যতিচিহ্নের ব্যবহার।
আর এভাবেই সৃজন হয় গল্পের ছন্দ। গল্পছন্দ। আর এই ছন্দের নির্মাণ হল বিচিত্র শব্দভুবন থেকে সংগৃহীত গল্পের মেজাজ মাফিক সঠিক নির্ভুল উপযুক্ত শব্দনিচয়কে ফুলের মত তুলে আনা’ [ অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে ]
‘কীট’গল্পটি বর্ণনামুলক হওয়াতে লেখক আসলে গল্পের ভেতরেই ঢুকতে পারেননি। গল্পটাকে আমি গল্পের ‘থিম’ হিসেবেই নিলাম। থিম কখনও গল্পের মর্যাদা পায় না, পেতে পারে না । থানকাপড় কখনও পোশাকের মূল্য পায়?
অণুগল্পের নামে এই রকম অনেক ‘থিম’ আমরা অহরহ দেখতে পাই।
আসল কথা হচ্ছে— থিমকে গল্পে রূপান্তর করতে হয়।
গল্প একটি বানানোর বিষয়। গল্পকে না বানালে গল্প বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না—বাস্তবতা বিবর্জিত মনে হবে। গল্পকে জীবনমুখী করার জন্যে ভাষা, কারিগরি জ্ঞান, আর লাগে কল্পনা বিলাস। সেখানে জানাশোনা মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া কোন বাস্তব আখ্যান খুব প্রয়োজন—এমন নয়।
গল্প বানাতে হয়, গল্প সাজাতে হয়।
লেখকের প্রতি তিনটি পরামর্শ থাকল— শুরুর ম্যাজিক ব্যবহার হোক। অণুগল্পকে ‘থিম’ থেকে বের করে নিয়ে আসুন। বিষয়বস্তু অনুযায়ী গল্পের ভাষা হোক। গল্পের মেজাজ ও ভাষার মধ্যে মেলবন্ধন হোক।
সাদা কবুতর [] খালেদা খানম
গঙ্গাধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ইলেকট্রিক পোল ফেলে বসার জায়গা। বর্ষার ভ্যাপসা গরমেও আরাম লাগে। এখানে বসলে চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসে যে কোন সময়।
সাধন পাল ঝিমোচ্ছিল একটু খানি। টুবাই এলো দৌড়ে দৌড়ে।” দাদু, দাদু, কোথায় গিয়েছিলে আজ?”
“অনেক দুরে দাদু “
” অনেক মানুষ জমেছিলো? অনেক হাততালি পড়ছে, কি জাদু দেখিয়েছো আজ? “বড় বড় চোখে জিজ্ঞেস করে ।
” ঐ যে রুমাল থেকে কবুতর “
” আজও কবুতরটা উড়ে গেল? তুমি আমাকে একটা সাদা কবুতর এনে দেবে দাদু “
” জাদু কবুতর ধরতে নেই যে! স্কুল গিয়েছিলে আজ? “
” আজ জানো স্কুলে দিদি মনি জিজ্ঞেস করে, তুমি বড় হয়ে কি হবে? আমি বলেছি, আমি দাদুর মতে জাদুগর হবো, অনেক বড়, “
” তাই? “
গল্প ফুরায় না।
দশটার ট্রেনে নিখুঁত ভীড়। অপিস টাইমে গিজগিজে লোক। মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে, মানুষের পকেটের ওজন বেশি। সাধন পালের হাতের কাজও বেশি। কিন্তু লাইনে এখন ছেলে ছোকরাদের বেশি আনাগোনা। তারা দলে কাজ করে।
নিপুণ হাতে ব্লেডটা চালিয়েছিল সাধন। ট্রেনটা স্লো হয়ে গেছে, কিন্তু কে যেন বলল পকেটমার!!
“মার, মার, আরো মার “। শালা বুড়ো বয়সে ধর্মের নাম নেবে নাতো পকেটমারি, মার শালাকে। “
ঠোঁটের কাছে ফেটে গেছে। ট্রেনটা চলে গেলে মারটা কমে যায়। লাইনের নতুন ছেলেগুলোকে দেখেছে সাধন, তারাই মুখে মেরেছে। রক্ত ঝরছে, পিপাসা পাচ্ছে খুব, কেউ যদি একটু জল দিতো মুখে ।
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে বসে টুবাই ভাবছিলো, দাদু এখোনো এলো না, হয়তো অনেক দূরে গেছে! হয়তো অনেকগুলো সাদা কবুতর উড়েছে ।অনেক হাততালি পড়েছে। জাদু কবুতর নাকি ধরতে নেই, কিন্তু অনেক উড়লে একটা ধরতে ক্ষতি কি! সে অনেক বড় জাদুগর হবে।এক সাথে অনেক সাদা কবুতর ওড়াবে ।টুবাইর ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।
দাদু আসছে? হ্যাঁ দাদুই তো, অনেক অনেক সাদা কবুতর দাদুর সাথে উড়েছে, উড়ে উড়ে আসছে সবাই । কিন্তু কাউকেই ধরা যাচ্ছে না ।
‘সাদা কবুতর’ নামে এইগল্পটির মধ্যে ক্রিয়াপদের সমস্যা আছে। কোথাও কোথাও সঠিক শব্দের ব্যবহার হয়নি। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে—‘দশটার ট্রেনে নিখুঁত ভীড়’।
লেখাটি সুখপাঠ্য। লেখাটিকে আরো সুখপাঠ্য করা যেতে পারত—এই সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠতে পারলে। এছাড়া যতিচিহ্নের ব্যবহার সঠিক হয়নি, সময়োপযোগী হয়নি। যতিচিহ্নকে গতিচিহ্নের মত ব্যবহার করার সুযোগ ছিল, করা হয়নি। এসব-ই একটি গল্পকে সুখপাঠ্য করার ফর্মুলা।
যতিচিহ্নের ব্যবহার গল্পকে অন্যমাত্রা এনে দেয়—
আমরা যারা গল্প লিখি, যতিচিহ্নের ব্যবহার-কে এমন এক জায়গায় নিয়ে ফেলেছি— অনেকেই মনে করি লেখকের প্রচন্ড স্বাধীনতা রয়েছে—তা রয়েছে— অস্বীকার করব না, কিন্তু লেখকের রুচিবোধ এবং কমনসেন্সে যদি ঘাটতি থাকে তবে একটি গল্পের শরীর নষ্ট করার জন্যে অন্য কিছুর দরকার পড়ে না— যতিচিহ্নই যথেষ্ট। যতিচিহ্নের যথেচ্ছ ব্যবহার দোষণীয় তো বটেই , চোখের শীতলতা নষ্ট করে দেয়।
এইগল্পটিও চোখের শীতলতা নষ্ট করে দিয়েছে। বিশেষকরে [“ “ ] ব্যবহার আমার মনকে বিষাক্ত করেছে। তাই বলে এই যতিচিহ্নটি যে ব্যাকরণসিদ্ধ হয়নি— তা বলছি না। তবু …
অন্যদিকে—‘লেখক যখন একটি গল্প লেখেন তখন তিনি একটি ‘গল্প’ই বলতে চান। লেখার মাধ্যমে এই বলা। এই জন্যে তাকে কথক, গাল্পিক বলা হয়। লেখাই যেখানে গল্প বলার একমাত্র উপায় সেখানে লেখা ছাড়া আর কীইবা করার আছে!
এ-ক্ষেত্রে গল্প বলিয়ে গল্পলেখক আখ্যান নির্বাচন, চরিত্র নির্বাচন, কাল নির্বাচন করে ৩ টি ভঙ্গিতে তাঁর গল্পটি বিধৃত করেন:
ক। গল্পকার অন্য কারো গল্প শুনে নিজে অথবা অন্য কারো মুখে গল্পটি বলতে অথবা বলাতে পারেন ।
খ। সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে গল্প লিখতে পারেন। বিষয়টি এমন— চোখের সামনে যা কিছু দেখছেন লিখে চলেছেন, ঘটনার চরিত্রের উথান পতনে লেখকের মনে দাগ কাটে না। থাকেন— নিরাবেগ নিঃস্পৃহ প্রতিক্রিয়াহীন। এখানে লেখক শুধু বিমানবিক বর্ণনাকারী। কিছুতেই তিনি টলেন না, কোনকিছুই তাকে স্পর্শ করে না। এই লেখক সিদ্ধান্ত দেন না, শুধু পরিস্থিতি তুলে ধরেন, বাস্তবতার বয়ান দেন।
গ। গল্পকার একটা ‘মেসেজ’ দেয়ার জন্যে স্ব-আরোপিত গল্পজাল বুনতে পারেন। এইসব গল্পে সবকিছুই পূর্ব-পরিকল্পিত। পাঠককে নিয়ন্ত্রণ করার সুক্ষন নীতি কাজ করে লেখকের মনে। পাঠকের মনে মেসেজটি আমূল প্রোথিত করাই লেখকের মূল উদ্দেশ্য। এই সব গল্পে অল্পমনস্ক পাঠকগণ ধৃত হন লেখকের ইচ্ছে-ফাঁদে। তবে বোদ্ধা পাঠক ঠিকই সযত্নে এড়িয়ে চলতে সক্ষম হন। তারা গল্পের রসটি গ্রহণ করে ছিবড়ে ছুঁড়ে দেন’। [অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে]।
আলোচ্য গল্পটি ‘খ’-কে অনুসরণ করে লিখিত হয়েছে। গল্পের লিখিত স্টাইল অনুযায়ী ৩টি উল্লম্ফন দাবি করে। কিন্তু আমি কোন উল্লম্ফন পাইনি। যেমন— প্রথম অংশের বর্ণনা দেয়ার পর—‘গল্প ফুরায় না’ বলা হয়েছে। এই বাক্যটি উল্লম্ফন নয়।
.
আমি হলে উল্লম্ফন দিয়ে গল্পের দু’ভাগের মধ্যে যে জোরা দেওয়ার চেস্টা হয়েছে, জোড়া লেগেছে ঠিকই, কিন্তু দাগ রয়ে গেছে। আমরা একটা দাগপড়া গল্প পাঠ করলাম। দাগপড়া গল্প বা দুর্বল ভাষার কারণে অনেক গল্পে ঝাঁকুনি খেতে খেতে যেতে হয় পাঠককে।
এই গল্পের মূল আলোচ্য বিষয় হল— গল্পের কথক বিষয়ক সমস্যা। এই গল্পের কথক কে? গল্পথেকে চরিত্র থেকে কথক কোন কৌণিক দূরত্ব থেকে অবলোকন করছেন— সেটা গুরুতর বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে।
লেখকের সাধারণ বর্ণনা ‘গঙ্গাধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ইলেকট্রিক পোল ফেলে বসার জায়গা বর্ষার ভ্যাপসা গরমেও আরাম লাগে। এখানে বসলে চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসে যে কোন সময় সাধন পাল ঝিমোচ্ছিল একটু খানি। টুবাই এলো দৌড়ে দৌড়ে ’।– এই বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি- লেখক গল্প থেকে খুব কাছেই আছেন। উনি ঘটনাটি স্বচোখে দেখছেন। অইত সাধন পাল বসে আছে, ক্লান্ত শ্রান্ত। হঠাত গল্পের মধ্যে টুবাই এসে পড়ল। টুবাই দৌড়ে আসার কারণেই সাঁট করে গল্পের কথক কৃষ্ণচুড়া গাছের আড়ালে চলে গেলেন।
তারপর দাদু নাতির কথা স্পষ্টভাবে শুনতে লাগলেন কথক।পুরো ব্যপারটি লেখকের চোখে দেখা, নিজের কানে শোনা। ‘খ’ নিয়ম পালিত হয়েছে।
‘গল্প ফুরায় না।‘—এইভাবে এই পংক্তির মাধ্যমে শেষ হল গল্পের প্রথম অংশ/ভাগ। এই পুরোভাগে কথক আর গাছের আড়াল থেকে বের হলেন না। চুপে চুপে সব দেখলেন, শুনলেন। পাঠকদের জানালেন।
এরপরের অংশ ট্রেনের ভেতরের ঘটনা। এখানেও উল্লম্ফন নেই।
সাধন পকেট কাটছে ব্লেড দিয়ে। ধরা পড়েছে। গণপিটুনি খাচ্ছে। গল্পের কথক অনেক লোকের ভিড়ে সাবধানে দেখছে পুরো ঘটনাটি।
এরপর আবার দৃশ্যান্তর। এই অংশেও কোন উল্লম্ফন নেই।
আবার সেই পোল। টুবাই-প্রধান শেষ অংশে কিছু ব্যতিক্রম আছে। এই অংশে লেখক চারপাশের ঘটনা শুধু না টুবাইয়ের মনের ভেতরে ঢোকার একটা চেষ্টা করা হয়েছে—‘কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে বসে টুবাই ভাবছিলো’—এইভাবে।
তারপর টুবাই হয়ে টুবাইয়ের মনোজাগতিক কিছু ভাবনাচিন্তা আমরা জানতে পারি এইভাবে— ‘দাদু এখোনো এলো না, হয়তো অনেক দূরে গেছে! হয়তো অনেকগুলো সাদা কবুতর উড়েছে। অনেক হাততালি পড়েছে। জাদু কবুতর নাকি ধরতে নেই, কিন্তু অনেক উড়লে একটা ধরতে ক্ষতি কি! সে অনেক বড় জাদুগর হবে। এক সাথে অনেক সাদা কবুতর ওড়াবে’।
এরপর আবারও নিকট দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটি অব্জারবেশন—‘টুবাইর ঘুম পেয়ে যাচ্ছে ‘। যদিও এই লাইনটি আলাদা করা দরকার ছিল— হয়নি।
শেষ প্যারাটি বেশি উত্তেজক। লেখক বা কথক আবারও সরাসরি টুবাইয়ের চিন্তা জগতে প্রবেশ করে। একই সাথে গল্পের পরিণতি আর বাস্তব- অবাস্তবের মাঝখানে অবস্থান করে লেখক বলছেন—দাদু আসছে? হ্যাঁ দাদুই তো, অনেক অনেক সাদা কবুতর দাদুর সাথে উড়েছে, উড়ে উড়ে আসছে সবাই। কিন্তু কাউকেই ধরা যাচ্ছে না।
যেন কবুতর-ই শুধু না, এইগল্পের আত্মাটিও উড়ে উড়ে আসছে। পাঠক উড়ে আসার পাখা ঝাপটানির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। গল্পের সাফল্য এখানে।
তবে যে উদ্দেশ্যে এই কথাগুলি বলা তা হচ্ছে— পুরো গল্পের তিনটি অংশের মধ্যে কোনপ্রকার উল্লম্ফন না দেয়ার ফলে গল্পের মাঝখানের ফাটল লক্ষ্য করছি, যে প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ করেছি। এই ফাটলই এই গল্পের প্রধান দুর্বলতা।
তাছাড়া কথকের অবস্থানগত বিভিন্ন দূরত্বও একেকটা’চোখে-দেখা-যায় না’—দাগের সৃষ্টি করেছে। ঘটনা থেকে দূরে, কাছে, চরিত্রের মনে-মগজে ঢোকার জন্যে যে মিহি ও মসৃণ পথকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেটি হয়নি।
সতীনাথ ভাদুরী গল্প উপন্যাসের গদ্যের বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন—এক পূর্ণমুহূর্ত থেকে আর-এক পূর্ণমুহূর্তে যাবার সময় [বাক্য থেকে বাক্যান্তরে, স্তবক থেকে অন্য স্তবকে] পাঠকের মন ঝাঁকানি না-খায়। গাঁথুনি আর জোড়ের দাগগুলি যেন হঠাত দেখলে বোঝা না যায়। ‘সাদা কবুতর’ পড়ে আমার মনে পড়ে গেল।
উজানগাঙের মাঝি [] মামুন মেহমুদ
– এই যে মরা নদী, দেখো জলছাড়া কেমন শূণ্য নিঃস্ব ভগ্ন! বিশ্বাস করো, তুমি ছাড়া আমার দশা-ও এর বিপরীত হবেনা। রাত ফুরালে হাস্নাহেনা যেমন শুধুই লতানো একটা গাছ, তুমি ছাড়া আমিও একটা নশ্বরতার খোলস মাত্র।
তুমি হাসছো? হেসো না। বাজে বোকো না! মেনে নিলাম কোন এক ভরাবর্ষায় মরা নদীর বুক জলে ভরে উঠবে। স্রোতের অপর প্রান্ত থেকে উজানে নাও ভাসাবে কোন এক মাঝি।
আমন্ত্রণ জানাবে উজানগাঁয়। স্বপ্ন দেখাবে জলখেলার, জড়িয়ে নিতে চাইবে জলমায়ায়। কিন্তু চাতক ঘোলা জলে চুমুক দেয়না, জানো তো?
ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। নিতুর চুল উড়ছে। ওড়নাটা টেনে নিয়ে আবার বাতাসে ভাসিয়ে দিল। বললো, ওড়নাচিঠি পাঠিয়ে দিলাম বাতাসে, উজানগাঙের মাঝি জানুক আমার এক সোহাগ আছে। তারে নিয়েই এই মরা গাঙে ঘর বাঁধবো। সে যেন জ্বালাতে না আসে।
অারিক কাঁদতে চায়নি, দু’চোখ বাঁধ খুলে দিয়েছে। আন্তরিক অবুঝ হতে চায়নি, এই মেয়েটা কাদামাটি বানিয়ে ফেলেছে। এখন চাইলেও আত্মার নিজের মত থাকতে পারেনা। গলে পড়ে কলিজা, শিরা-উপশিরা।
মাত্র কয়েকটা দিনেই যে স্বপ্ন নিতু মনে বুনে ফেলেছে তা যে ফুল হয়ে ফুটবেনা সে কি তা জানে?
শেষবারের মত যেদিন ওকে কেমো দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আন্তরিক বুঝেছিল এটাই নিতুর শেষ যাওয়া। ও আর ফিরবে না।
বাসের জানালা দিয়ে ওর ওড়নাটা বাতাসে উড়ছিল। চিৎকার করে যেন বলছিল, উজানগাঙের মাঝি আমায় নিয়ে যাচ্ছে। আটকাবে না তুমি? কাপুরুষ! আটকাতে পারো না তুমি?
আন্তরিক নদীরপাড় এসে দেখলো নদী জলে টৈ-টুমুর। রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল। বর্ষা এসে গেছে।
কাব্যাক্রান্ত গল্প
কাব্যাক্রান্ত গল্প—গল্পই। এই ধরণের গল্পের ভেতরে যে গল্পটি থাকে সেটাকে উদ্ধার করে পরম্পরা সাজানো বিরাট পরিশ্রমের কাজ। গাদার ভেতরে সূচ হারিয়ে যদি বলা হয়— খোঁজ, তবে কেমন ঝক্কির ব্যাপার হয় সে-ই জানে যাকে বলা হয়। বাস্তবে অবশ্য কেউ বলে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। কিন্তু সাহিত্যে যে বলে—সে ত দেখতেই পাচ্ছি।
এই প্রকারের গল্প আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। গল্পকাররা হয়ত পছন্দ করেন বলেই এমন লেখেন। তাই এড়ানো সম্ভব না।
প্রতিটা মানুষের মধ্যে, লেখকের মধ্যে কবিতা, কবিত্বের আলোকণা গুপ্ত থাকে বলে আমার মনে হয়। এরই উৎসারিত আলো কখনও কখনও ঝলকে ওঠে লেখাপত্রে; তা সে যা-ই লেখুক না কেন। কবিতা আমাদের মজ্জাগত। আমাদের সাহিত্যে কবিতার আগমন প্রথমে। গদ্য এসেছে অনেক পরে—এই সেদিন। আমাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে প্রাচীন সামাজিক আইন কানুন পর্যন্ত কবিতায় লিখিত ছিল। আমরা, পুরোজনগোষ্ঠী কবিতাক্রান্ত ছিলাম। এই কবিতা আমাদের অন্তর্গত শোণিতের ভেতরে খেলা করতে করতে প্রজন্মান্তরে বাসা বেঁধেছে। এইজন্যেই নাটকের ভেতরে আমরা কাব্য পাই, উপন্যাসের ভেতরে কাব্য পাই, গল্পের ভেতরে কাব্য পাই। এমনকি চিত্রশিল্পের মধ্যেও কবিতা খুঁজে বেড়াই।
আমার নিজস্ব মতামত হল : অণুগল্প বলি, ছোটগল্প বা উপন্যাস বলি—সে কাব্যআক্রান্ত হবে কিনা নির্ভর করছে সেই অণুগল্প/ ছোটগল্প / উপন্যাসের ‘বিষয়বস্তু’র ওপর । অর্থাৎ বিষয়বস্তুই মুলত নির্ধারণ করে দেয় গল্পের ভাষা কি হবে।
অণুগল্পের ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় আছে, এভাবে লেখা-ই ডিমান্ড করে। আমরা এর নাম দিয়েছি—ভাবঅণুগল্প। ভাবঅণুগল্পের মধ্যে অনেক শ্রেণিভাগও আছে । তার মধ্যে এই ধারার ভাবঅণুগল্প আসলে অগল্প-নাগল্পের উদাহরণ।
একথা ঠিক, কাব্যের মতোই, নাগল্প -অগল্পের পাঠক তেমন হয় না । তবে এটা চাই, সবাই অগল্প- নাগল্প লিখুক। নিরীক্ষা চলুক অণুগল্পের এই ধারাটিকে কেন্দ্র করে। পাঠক সমৃদ্ধ হোক অণুগল্প। সবাই জানুক—এইরকমও হয়। আরও জানুক অণুগল্প—অনেক রকম, অনেক ধাঁচের, অনেক স্বাদের, অনেক আঙ্গিকের। অণুগল্প বিশদ, অণুগল্প ভিন্ন থেকে ভিন্নতর
… ‘হাজার পাখি হাজার হাজার ফুল একেক ফুলের একেক রকম গন্ধ, একেক পাখির একেক রকমের ডাক। সব নিয়ে বন, সব নিয়ে জীবন’.
আলোচনার জন্যে নির্বাচিত এবারের গল্পটির নাম কাঠটগরের ফুল। প্রথমে গল্পটিকে ৫ ভাগে ভাগ করে নেই। সবার বুঝতে সুবিধা হবে।
কাঠটগরের ফুল
[প্রথম অংশ ]– অ্যাই শালা খান…
– চোওওওপ শালা! একদম চোপ।
নিতাই দোকানের সামনেটা ঝাঁট দিচ্ছিল, তেড়ে গেল রসিকের দিকে।
রসিক রুদ্রমূর্তি থেকে নিমেষে ভেজা বেড়াল হয়ে গেল, মুখে সটান মুচকি হাসি।
– তবে বিড়ি দে একটা।
নিতাই ঝাঁট দিতে লাগল পাত্তা না দিয়ে।
– অ্যাই নিতাই! নিতাই! দে না বিড়ি!
দশটা বেজে গেছে। খদ্দের আসতে শুরু করেছে এক-দুজন করে। রসিকের ডাক তাদের কথায় চাপা পড়ে না গেলেও, নিতাই আমল দিল না।
[২য় অংশ]শহরের রাজপথ যথেষ্ট গরম হয়ে গেলে বা কাকগুলো ডালে বসে ধুঁকতে শুরু করলে, নিতাই গদি ছেড়ে ওঠে। ওর ঘড়ি লাগে না।
দোকানের শাটার বন্ধ করে স্নান করতে যায় নন্দীপুকুরে।
[৩য় অংশ ]
গামছা সাবান আর মগ নিয়ে এদিক ওদিক দেখে নিল নিতাই। রসিক নেই ধারেকাছে।
[৪ র্থ অংশ ]
নন্দীপুকুরে বেলা দেড়টায় কেউ বিশেষ থাকে না। খাঁ খাঁ করছে রোদ। তাপজ্বালা জুড়ালে ঘর থেকে বেরোবে মানুষ। এক-দুজনই শুধু এই রোদে জলে ডুব দিতে আসে। বাইরের জ্বালা ভিতরের জ্বালায় যাদের তফাৎ কিছু লাগে না।
[৫ম অংশ]
মাথার ওপর চড়া রোদ নিয়ে ধীরেসুস্থে ঘাটে বসল নিতাই।
– কই? এদিকে এসো!
মগে জল নিয়ে নিজের মাথায় ঢালতে ঢালতে কথাগুলো কাঠটগরের গোড়ার দিকে ছুঁড়ে দিল।
– দেরী করছ কেন? খিদে পায় নি নাকি?
রসিক অভিমানে ভরা মুখ নিয়ে গুটি গুটি এগিয়ে এলো,
– দুটো ভাত বেশী দিবি বল?
– দেব।
– ডাল?
– দেব।
– তরকারী?
– দেব।
কথা চলতে থাকে। রসিকের চুলে সাবান ঘষে নিতাই, তারপর পিঠে। এইসময়টা খড়খড়ে হাতটা মা’র মতো কোমল হয়ে যায় – নিতাই জানে রসিকও বোঝে সেটা।
গল্পউপন্যাসে কিছু ফুটিয়ে তোলার জন্যে লেখক চরিত্রেরর ভেতরগত বিষয়াদি তুলে ধরতে গিয়ে বা প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় লেখক যা করেন—বর্ণনার পর বর্ণনা দিতে যান। সুচারু দক্ষায় ডিটেইলের ব্যবহার সুনিশ্চিত করেন। অর্থাৎ লিখিত বিষয়টি সার্বিকভাবে পাঠকের কাছে যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে সে-চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেন না। আর এভাবেই বিশ্বস্ততা রক্ষা করতে গিয়ে গল্পের অবয়ব যায় বেড়ে।
গল্পউপন্যাসের ক্ষেত্রে এই বিশ্বস্ততা জরুরি শুধু নয়, এটা লেখকের সক্ষমতাচিহ্ন।অন্যদিকে, অণুগল্পে বর্ণনার/চরিত্র/সংলাপের মধ্যে বিশ্বস্ততা খুঁজে বেড়ানো দুঃসাধ্য একটি কর্ম। অণুগল্পে অধিক বর্ণনা বিষবৎ। অণুগল্পে বিশ্বস্ততা/বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা/রক্ষা করার দরকার পড়ে না।
তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে—অণুগল্পে কি ঘটনা/ চরিত্র ফুটে ওঠে না? পাঠকের চোখের সামনে কি ঘটনার পরম্পরা ছায়াছবির মত ভেসে ওঠে না? মনে কি হয় না—হাত বাড়ালেই চরিত্রদের ছোঁয়া যাবে বা একটি সন্ধ্যাকাশ, একটি টুপটাপ শিশির পড়া রাত্রি, শব্দতোলা একটি নদী, বাদুরের ডানা ঝাপ্টানি কি আমরা শুনতে পাই না, অণুগল্পে?
অবশ্যই পাই। অণুগল্প পাঠে চোখকাননাকসহ সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি বরং আরও সতেজ হয়, তীব্র হয়। গল্প-উপন্যাসে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বর্ণনার ঢেউ তুলে পাঠককে সুড়সুড়ি দেয়া হয়। অণুগল্পে সুড়সুড়ি দেয়ার কোন সুযোগ নেই। এখানে দিতে হয় ধাক্কা। ধাক্কার পর ধাক্কা। শব্দ দিয়ে ধাক্কা। মোক্ষম শব্দের ধাক্কায় ইন্দ্রিয়র ঘুম ভেঙে গেলে তারা স্পর্শ পায়, গন্ধ পায়।চরিত্র উঠে দাঁড়ায়।
সুতরাং অণুগল্পে শব্দই হচ্ছে জাগিয়ে তোলার হাতিয়ার।অণুগল্পে একটি শব্দই একটি বর্ণনার রূপ ধরে আসে। অণুগল্প বর্ণনার নয়, শব্দের খেদমত করে। এইজন্যেই বিশ্বস্ততা বা বিশ্বাসযোগ্যতার তেমন জোরালোপনা নেই অণুগল্পে।
বরং অণুগল্পেরর প্রধান উপাদান উল্লম্ফনের মুনশিয়ানা ঘিরে থাকে বলে পরম্পরার বিশ্বস্ততার সূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। যেতে বাধ্য হয়।
এই গল্পটিতে আমরা উল্লম্ফন দেখতে পাই।আর উল্লম্ফনের চমৎকার ব্যবহার তখনি ঘটে যখন গল্পের ‘অন্বয় বা সম্পর্ক’কে সুদৃঢ় আর সাযুজ্য করা সম্ভব হয় । যথাযথ অন্বয় বা সম্পর্ক স্থাপন না করা গেলে গল্পে ‘যে কথাটি বলা হয়নি—পাঠক ধরে নেবে’/ ‘ভেবে নেবে’ অথবা লেখক যে আড়াল/দেয়াল নির্মাণ করেন শব্দ থেকে শব্দে/পংক্তি থেকে পংক্তিতে/ স্তবক থেকে স্তবকে –পাঠককে দিয়ে সহজেই ‘স্থান ও সময়ের’ পাড়ি দিতে চান বলে যে উল্লম্ফন দিতে হয়, তার জন্যে প্রসঙ্গ / অন্বয় / সম্পর্ক/নির্মাণ করতে হয়। সেটি ‘সাঁকো’ হিসেবে কাজ করে। পাঠক সেই সাঁকো বেয়ে বেয়ে গল্পের ভেতর থেকে শেষপাড়ে চলে আসে কোন শূন্যতার অনুভব না করেই।
আলোচ্য গল্পটিতে উল্লম্ফন আছে কিন্তু উল্লম্ফনের সাঁকোটি নেই। সাঁকোবিহিন একটি সরু খালও পাঠক পাড়ি দিতে চান না।
উল্লম্ফন দেয়ার যেসব জায়গা আছে অণুগল্পে, তার মধ্যে প্রধান হল—সময়ভিত্তিক আর স্থান ভিত্তিক উল্লম্ফন। আরও অনেক প্রকারের আছে। কিন্তু এই গল্পে দেখতে পাই সময় ও স্থান দুটোই আছে।
স্থান— নিতাইয়ের দোকান, নান্দীপুকুর।
সময়— সক্কাল বেলা, দুপুর বেলা।
গল্পটিতে মোট ৫টি স্তর আছে। এই ৫টি স্তরের সাথে লেখক সাঁকো নির্মাণ করেছেন কি না দেখা যাক।
১। সকাল বেলার ঘটনা। সংলাপ আছে যদিও খুব দুর্বল সংলাপ। ‘খদ্দের’ শব্দটি থাকাতে বোঝা যাচ্ছে এটি দোকান। কাল-সাধারণ বর্তমান। এখানে ‘ রুদ্রমুর্তি/ ভেজা বেড়াল’—উপমা হিসেবে বহুচর্চিত।‘সটান মুচকি হাসি’— বিষয়টি আমি বুঝতে পারিনি।
.
২। নিতাইয়ের দোকান ছাড়ার সময় চিহ্নিত করা হয়েছে। দোকান থেকে কোথায় যায় তার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই পুরো অংশটুকুই রোজকার ঘটনা। ফলে কাল হওয়ার কথা—
নিত্যবৃত্ত বর্তমান। হয়েছেও তাই। ‘দোকানের শাটার বন্ধ করে স্নান করতে যায় নন্দীপুকুরে’ খুব গুরুত্বপুর্ণ পংক্তি। যা দিয়ে পরর্বর্তী ঘটনার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। তবে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে ‘দোকানের শাটার বন্ধ করে স্নান করতে যায় নন্দীপুকুরে’ নিত্য বৃত্ত বর্তমানের সাথে সাথেই যখন আমরা পরবর্তী ৩ নং অংশটি পাই—
‘গামছা সাবান আর মগ নিয়ে এদিক ওদিক দেখে নিল নিতাই। রসিক নেই ধারে কাছে’ তখন পাঠক হিসেবে আমি ঘাবড়ে যাই। ঘাবড়ে যাই এই কারণে যে, আমাকে কোন সাঁকো না দিয়েই বলা হল—দে দে লাফ।
এই নিঃসঙ্গ পঙক্তিটি গল্পের জন্যে মারাত্মক এই কারণে যে এটি আমাকে কোনরুপ অন্বয় বা সম্পর্ক না ঘটিয়ে দোকান থেকে নদীঘাটে এবং সাধারণ বর্তমান থেকে নিত্য বর্তমানে ঠেলে দিয়েছে।
৪। এই অংশটি নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। -‘এই কিছু নেই’ ভাবনাটি মারাত্মক। ‘কিছু নেই’ এমন শব্দ/ পঙক্তি / স্তবক অপ্রয়োজনীয়। প্রকাশ্য মেদ। এই অংশটি না থাকলেও ক্ষতি নেই।
৫। ৫ম অংশটি গল্পের শেষ অংশ। এই অংশের শেষ স্তবকটি গল্পের প্রাণ। বিস্ময়পরিণতি। ঠিক আছে।
.
অণুগল্পের একটি প্রধান বিষয় ইঙ্গিত। ইঙ্গিতে ইঙ্গিতে গল্প শেলাই হয়। কিছু ইঙ্গিত সাধারণত লম্বা উল্লম্ফনের জন্যে হয়। হয়ত গল্পের শুরু বা মাঝামাঝিতে থাকে। গল্পের শেষাংশে প্রসঙ্গটি এনে পুরো গল্পটিকেই কমপ্যাক্ট করে ফেলা হয়। অর্থাৎ গল্পটি ফ্রেমবন্দী করা হয়। এই গল্পটিতে সেই অসাধারণ লম্বা উলম্ফনটি দেয়া হয়নি। ফলে গল্প যেতে যেতে শেষ হয়ে গেছে। আর ফিরে আসে নি।
.
এইজন্যে গল্পটিকে কি দুর্বল বলা যায়! হয়ত। হয়ত না।
অণুগল্প যদিও স্বল্পায়তনের হয়ে থাকে কিন্তু এর অর্থ এই নয়, অণুগল্প সম্পর্কিত আলোচনাটিও সংক্ষিপ্ত হবে। বরং এটাই বার বার প্রতীয়মান হয়ে ওঠে, একটি ৩০০ শব্দের অণুগল্পের পূর্ণ আলোচনা করতে ৩০০০ শব্দের প্রয়োজন পড়ে। প্রসঙ্গান্তরে সেই বহু উল্লেখিত সেই বক্তব্যটিই ঘুরেফিরে আসে—অণুগল্প এক আশ্চর্য বস্তু। এমন ছোট অথচ দানবীয় শক্তির আধার সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ভেতর কত খানি লুকায়িত আছে— জানা নেই—কিন্তু অণুগল্পে যে পুরোমাত্রায় আছ— সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কতখানি আগুন অণুগল্প ধারণ করে বসে আছে— ভাবতেই শিহরিত হতে হয়। দাবানল লাগাতে এর জুড়ি মেলা ভার। এর প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ এমন কি যতিচিহ্ন পর্যন্ত একেকেটি অগ্নিকণার ভূমিকা পালন করে। একটি লক্ষ্যভেদী অণুগল্প শত বছরের জমাট অন্ধকারকে আলোকিত করার সক্ষমতা নিয়ে বেঁচে থাকে। তার এই বেঁচে থাকা, তার যে ‘নাই’-এর মাঝেও আছের ঘোষণা বা, অনুগল্পের ভেতরের নানাবিধ অস্তিত্বের এই যে, দূরন্ত চলাফেরা—একে অনুভব করার মন থাকতে হয়। দেখে নেবার চোখ থাকতে হয় আর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে মুত্তাকি হতে হয়। অন্যথায় একরাশ ফাঁকিতে পড়ে যাবে লেখক ও পাঠক জীবন।
অণুগল্পের জয় হোক।