কমলের অফিসের নিচ দিয়ে যাচ্ছিলাম বলেই ওর অফিসে ঢুকতে হবে এমন কোনো কারণ ছিল না। ও আমার এত ঘনিষ্ঠ না। ওর নামের বানানের প্রথম অক্ষর ব্যঞ্জন বর্ণের ১ম অক্ষর, আর আমার নামের বানানে স্বরবর্ণের ১ম অক্ষর, পরবর্তী অংশ একই। এই মিল ছাড়া আর তেমন কোন মিল নেই আমাদের – তবুও আমরা বন্ধু।
উদ্দেশ্য ছিল – যেহেতু অফিস সময় প্রায় শেষ – ওর অফিসে এককাপ চা খেয়ে টুকটাক গল্প করতে করতে যে যার বাড়ি। কিন্তু ‘সরল অঙ্ক’ কখনোই সরল না।
আজ একটু আগেই বাড়ি ফিরবে বলে কমল তার কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছিল এবং আমাকে দেখেই কার উদ্দেশে ‘চোল্লাম’ বলে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এল। সুতরাং চা’টা নিচে কোথাও খেতে হবে।
কিন্তু গল্পে গল্পে সে চা পানের প্রসঙ্গে গেলই না। ফলে আমরা ১টা গাড়িতে উঠে পড়লাম। যে গাড়িতে উঠলাম সে গাড়িটা যে রুটে চলে, তাতে আমার বাসাটাই আগে পড়বে। আমি নেমে যাব – কমল আরো মাইল দু’য়েক যাবে। ওখানে মডেল টাউন জাতীয় একটা অত্যাধুনিক শহর নাকি হচ্ছে – সে ওখানেই থাকে। আমাকে ২/১ বার যাবার জন্য বলেছিল, যাওয়া হয়নি।
গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। সুতরাং আমরা আরাম করে নড়েচড়ে বসে গল্প জুড়লাম। কিছুদূর আসার পর এক চৌরাস্তায় দেখলাম বেশ উত্তেজিত ট্রাফিক পুলিশ আমাদেরসহ অন্যান্যদের গাড়ি তাদের নির্দেশিত পথে ঘুরিয়ে দিলো। দেখলাম তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আমাদের রাস্তাটা বন্ধ। বেশ কয়েকজন পুলিশ স্বশস্ত্র। ট্রাফিক পুলিশ অনবরত বাঁশি বাজিয়ে হাত ঘুরিয়ে সব গাড়ি এ পথে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধ রাস্তায় একটা জল-কামানের গাড়িও দেখতে পেলাম। হয়তো ঐ রাস্তায় কোনো ঝামেলা বেঁধেছে। আমরা এখন যে রাস্তায় চলেছি – সেটা নিশ্চয় নিরাপদ। কিন্তু ঝামেলা বেঁধে যাবে অন্যখানে, এদিক দিয়ে গেলে অনেক পথ ঘুরে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কমলের এলাকাটা আগে পড়বে এবং ঘুরেটুরে অনেক পরে আমার এলাকায় নামাবে। যাত্রীদের মধ্যে একটা হট্টগোল বাঁধায় ড্রাইভার এবং তার এ্যাসিস্ট্যান্ডের কাছে এমন নিশ্চয়তা পাওয়া গেল।
এ রাস্তার ভিড়ভাট্টা কম থাকায় গাড়ি বেশ দ্রুত গতিতে চলছিল। ভাল লাগছিলো – কিন্তু খারাপও লাগছিলো – কারণ আমার বাসায় ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। জায়গায় জায়গায় গাড়ি থামিয়ে অনেকে নেমে গেল এবং গাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। কমলের এলাকায় পৌঁছে আমার খারাপ লাগাটা চলে গেল। খুবই সুন্দর পরিবেশ। পরিকল্পকদের প্রশংসা করতেই হবে। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম এবং গ্রহের ফেরে ভুল করলাম। নামার কারণঃ ১. সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক সময় বাকি। ২. এক কাপ চা। ৩. কমলের এই এলাকায় অনেকদিন থেকেই আসার ইচ্ছা ছিল।
খুবই অদ্ভুত লাগছে। এমন শহর আমি কল্পনাতেও দেখিনি। একদিকে তাকালাম মনে হলো চ‚ড়ান্ত গ্রামীণ পরিবেশ। একটু হেঁটে অন্যদিকে ফিরে দেখলাম অত্যাধুনিক শহর। অর্থাৎ একই জায়গায় গ্রাম এবং শহরের মিশেল ঘটানো হয়েছে। এটা যে পরিকল্পনা করে করা হয়েছে তা বোঝা যায়। আমি তন্ময় হয়ে এদিক সেদিক দেখতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম কমলকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। যাকগে, এটাতো আর গিজগিজে মানুষে ঠাসা শহর নয় – এরকম পাতলা বসতির শহরে যে কাউকে খুঁজে বের করা সম্ভব।
হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো ছাড়া বাকি অংশ, গাছপালা দেখে মনে হলো প্রকৃতিকে খুব একটা বিরক্ত না করে গড়ে ওঠা একটা শহর। ঝিরঝিরে বাতাস সমস্ত শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছে। এত ভাল লাগছে যে, আমার আর ফিরতে ইচ্ছা করছে না, অসুবিধাও নাই, টেলিফোনে একটা যোগাযোগ করে কমলের এখানেই থেকে যাওয়া যায়। বাতাস আমার চেয়ে বেশি উপভোগ করছে গাছগুলো – তাদের ডালপালা আর পাতার নাচন দেখে তাই মনে হলো। আমি নদীর গন্ধ পেলাম। কাছে পিঠে নদী না থেকেই যায় না।
নারকেল গাছগুলোর দিকে তাকালাম – তাকিয়েই থাকলাম। বাতাস নারকেলের ডালগুলোয় এমন খেলা শুরু করেছে যে, আমার মনে হলো-নারকেল গাছগুলোর মাথা এক একটা নারীর মাথা – বাতাস চিরুনি হয়ে তাদের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে অথবা নারকেলের ডালগুলিই এক একটা চিরুনি, তারা বাতাসের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে।
আমার উল্টোদিক থেকে একজন বোরকাপরিহিতা আসছে। আমি কেন জানি তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। মুখের খোলা অংশ দেখে মা মা ধরনের মনে হচ্ছে। তিনিও আমার দিকে চেয়েই এগিয়ে আসছেন। আমি না চিনলেও উনি যেন আমায় চেনেন। কাছাকাছি হওয়া মাত্র আমাকে অবাক করে বললেন, ‘আমি তোমাকে চিনি- তুমি অমল, দিয়ার বন্ধু। দিয়া তোমার কথা আমাকে বলেছে, দিয়া আমার মেয়ে’। থ’ হয়ে গেলাম। দিয়া আমার বন্ধু-কারণ তার সাথে আমার বন্ধুত্ব আছে। বন্ধুত্বটা এ পর্যায়ের যে, সে আমার উপর যে কোন দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। আমিও দু’একটি বিষয়ে তার উপর নির্ভর করি।
থ’ হয়ে গেলাম এ জন্য যে, শুধু বর্ণনা শুনে এভাবে মানুষ শনাক্ত করা খুবই বিরল গুণ। আর কোন কথা হলো না, উনি এগিয়ে গেলেন – আমি চোখ ফিরিয়ে এগুতে গিয়ে দেখলাম কমল আসছে। পোষাক পাল্টে ফেলেছে। দু’হাতে ২টা গ্লাস -প্লেন পানি না শরবত? কে জানে! কিন্তু বাড়ির বাইরে এভাবে! যা খাওয়াবে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে খাওয়াক!
সে তার ডানদিকে ইশারা করলো আমি আমার বাম দিকে রাস্তা ছেড়ে নেমে গেলাম। নিকেল করা রেলিং ঘেরা চমৎকার একটা খাল। বর্ষাকালে পানি জমতে পারে – এখন শুকনো। খালটা প্রাকৃতিক, শহর কর্তৃপক্ষ শুধু বৃত্তের মতো করে রেলিং করে দিয়েছে। দুই পাশ দিয়ে দু’টো সিঁড়ি নেমে গেছে। কোন ব্রেক না দিয়ে টানা – আমার মনো হলো ৮০/৯০টা ধাপ তো হবেই। নিচে দেখলাম কয়েকজন শিশু দৌড়াদৌড়ি খেলছে। কমল আমার হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বসতে বললো। বসতে গিয়ে চমকালাম অথবা থমকালাম, পায়ের নিচে পুরু ফাইবার গ্লাস দিয়ে খালের ভিতরের দিকে এক ফুট কার্নিশ মতো করে পুরো খালটা ঘেরা। পা ঝুলিয়ে বসা যায়। বসলাম। গ্লাসে চুমুক দিলাম। ঝিরঝিরে বাতাস শরীর জুড়িয়েছিলো এখন শরবত প্রাণটা জুড়িয়ে দিলো। কমল বুঝে শুনেই গ্লাস হাতে বাইরে খোলা জায়গায় আমাকে আপ্যায়ন করছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে জলপান বাড়ির ভিতরের চেয়ে উত্তম। এ এলাকায় অন্যান্যরাও এমন করে কিনা কে জানে।
ঢকঢক করে গ্লাস শেষ করে কমল ‘আসছি’ বলে উঠে গেল। এলাকাটা ভাল করে দেখবো বলে আমিও উঠলাম। শহর আর গ্রামের এই মিশেল বিশেষ এলাকায় এবার ২/৪ জন মানুষ দেখতে পেলাম – এদিক সেদিক নিজেদের মতো করে চলাফেরা করছে। আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ৫/৬ জনের একটা দল আমার দিকে আসছে। দলটির একজন মধ্যমণি আছে বলে মনে হলো – কাছাকাছি হতেই ভীষণ চমকে গেল দলটির মধ্যমণি। ভাল করে খেয়াল করে আমিও চিনলাম মানুষটিকে – ইমরুল। আমাকে দেখে তার চমকানোর কারণ বুঝলাম না।
ইমরুল আমার চেয়ে বয়সে বড়। সে আমাদের এলাকায় অনেকের জন্য ত্রাস। দারুণ সুদর্শন ও অসম্ভব সুন্দর হাসির এই মানুষটির সাথে আমার যতবার দেখা হয়েছে – “ছোট ভাই কেমন আছো?” বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। আমার দেখার দুর্ভাগ্য কোনোদিন হয়নি। কিন্তু শুনেছি বহু হৃৎপিন্ডের স্পন্দন সে থামিয়ে দিয়েছে। তাকে দেখে ভয় পেতাম কিন্তু কোনোদিনই ‘মুচকি হাসি’ আর ‘ছোট ভাই কেমন আছো’ ছাড়া অন্যকিছু ঘটেনি। শুনেছি সব সময় তার সঙ্গে একটা বড় স্ক্রু-ড্রাইভার থাকে। কারো পক্ষে ধারণা করা সম্ভব না এটা মারণাস্ত্র – অথচ প্রয়োজন হওয়া মাত্র এই স্ক্রু-ড্রাইভারের লম্বা অংশটুকু সে অবলীলায় ঢুকিয়ে দেয় অন্যের হৃৎপিন্ড বরাবর। মরবার আগে গোঁ গোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না মানুষটি। সে সব সময় থাকে সন্দেহের বাইরে।
নিজ এলাকা ছেড়ে এখানে কেন সে? নিশ্চয় বড় ধরনের ঘটনায় কেচে গেছে। হয়তো নতুন এই এলাকা তার জন্য নিরাপদ। তাহলে তো আমাকে দেখে চমকানোর কারণ তার গোপনীয়তা! চমকে উঠে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল না ‘মুচকি হাসি’ না ‘ছোট ভাই কেমন আছো?’ কিছু কথা হলে তো বোঝানো যেত তার গোপনীয়তা ফাঁস করার কোন দায় আমার নাই। অল্প সময়ের ব্যাপার হলেও চোখে পড়লো তার সুদর্শনভাবের কোথাও একটা ভাটা পড়েছে – কী সেটা ধরতে পারছি না। মনটা ভীষণ বিষণ্ন হয়ে গেল। মনে হলো এই এলাকা এক্ষুনি ছেড়ে চলে যাই। কমলকে বলে বাই বাই। কিন্তু কমলকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।
কেউ ‘অমল অমল’ বলে চিৎকার দিচ্ছে। নারী কণ্ঠ। জোর বাতাস উঠেছে- কণ্ঠস্বরটা ধরতে পারছি না। হঠাৎ দেখলাম একটা বিল্ডিৎয়ের জানালায় একজন আমাকে দ্রুত হাত ইশারায় ডাকছে। দৌড়ে ও দিকে গেলাম। দিয়া। উপরে ডাকছে। দিয়া এখানে থাকে নাকি! দু’একেই এখানে এসে উঠেছে বোধ হয়। বেশি দিনের ব্যাপার হলেতো আগেই খবর পেতাম। তাই হবে, এজন্য কিছুক্ষণ আগে ওর মাকে দেখলাম।
সিঁড়ি না লিফট? সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। বাতাস আরো প্রবল হয়েছে। দিয়া যা বলল সেটা হল তার কাপড় ছাদে শুকোতে দেয়া আছে আনতে হবে – এতক্ষণ বোধহয় বাতাসে উড়ে গেল ! সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল তার সব চেয়ে প্রিয় ড্রেস ধুয়ে ছাদে শুকোতে দিয়েছে, কিন্তু ব্যালকনি রেখে ছাদে কেন? লিফট দিয়ে উঠা উচিত ছিল – আমি পিছিয়ে পড়লাম, দিয়া ছাদে পৌঁছে গেছে। আমি যখন পৌঁছালাম তখন দিয়া ‘আমার ওড়না উড়ে ’ গেল বলে কান্না মতো জুড়েছে। অথচ আমি তার গায়ে ওড়না দেখতে পেলাম – তাহলে! ওর হাত যে দিকে ইশারা করছে সেদিকে তাকিয়ে দেখি সত্যি একটা কাপড় প্রবল বাতাসে পত্ পত্ করে উড়তে উড়তে দূরে সরে যাচ্ছে। ‘ওটা এনে দাও – এনে দাও’ বলে চিৎকার এখনো থামেনি। আমি বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালাম, দেখলাম ও হাঁটু মুড়ে বসে আছে বগলদাবা করা সালোয়ার-কামিজ, পোশাকের তৃতীয় অংশ এই মাত্র দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। আরে বাবা তোর গা থেকে তো আর ওড়না উড়ে যায়নি। এতো ব্যা ব্যা কেন? বিরক্ত লাগছে। আমার দিকে পেছন ফিরে বসা ওর কামিজের নিচে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে ব্রা। পেছন থেকে কোন তরুনীকে এত বিশ্রি দেখায় আগে জানা ছিলনা। ওকে আমার ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিতে ইচ্ছা করলো। সেটা কখনোই সম্ভব না বলে আমি ওর কাছে গেলাম। কাঁধ থেকে কামিজ সরিয়ে দিলাম কামড় – চিৎকার থেমে গেছে। এক হাতে ওকে ধরে রেখে আরো একটু জোর বাড়ালাম দাঁতের। ও আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ব্যথা অনুভ‚তির প্রকাশ নেই চোখে। আমি দাঁতের চাপ আরো বাড়ালাম – মাংস কেটে বসে যাচ্ছে তবুও কিছু বলে না। ছেড়ে দিলাম – ওর কাঁধে আমার দাঁতের দাগ বেশ কেটে বসে গেছে। আমি ভ্যাম্প নাকি! ওর কাঁধ আর আমার কর্তন দাঁতের মধ্যে আমার মুখের লালা একটা সুতা মত তৈরি করেছে। মুখ আর একটু সরাতেই লালার সুতাটা ছিঁড়ে গেল। ওকে আমার দিকে ঘোরালাম। নিচের ঠোঁটে কামড় দিলাম। একবার। দু’বার। তৃতীয় বার ঠোঁট থেকে নীচে নামলাম। ওর থুতনিটা আমার মুখের ভিতর হারিয়ে গেল। ওর মুখটা একটু ফাঁক হয়ে গেছে দাঁত দেখতে পাচ্ছি। মাথাটা একটু পিছন দিকে হেলে গেছে – চোখ দুটো বোঁজা।
আমার রাগটা পড়ে গেছে। ও ওর ওড়নার শোকও আপাতত ভুলেছে। এখন আমাকে যেতে হবে। আমি সিঁড়ির দিকে এগুলাম। দিয়া ওপরেই থাক বা নামুক আমার জানার দরকার নাই।
নিচে নেমে খোলা জায়গায় এসে দেখলাম বাতাসের তীব্রতা! কমলকে না বলেই যেতে হবে। কিছু দূর এগুনোর পর হঠাৎ তিনজন মানুষ আমার পথ আটকে একটু আড়াল মতো করে জানালো আমি নাকি ভীষণ বিপদে আছি। আমার উপস্থিতি কারো জন্য হুমকি হয়েছে। আমাকে এখান থেকে ফিরতে দেওয়া হবে না। যতক্ষণ ওরা না চায়। ভরকে গেলাম। আমি যে ইমরুলের আর ‘ছোট ভাই’ নাই তখনই তার চেহারা দেখে বুঝেছিলাম। এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে তার সুদর্শনভাবটা কেন আমার বেখাপ্পা লেগেছিলো। তার একটা চোখ বাম না ডান মনে করতে পারছি না – মণি সাদা ছিল, চোখের মণির কালো অংশটা না থাকায় তার সুদর্শনত্ব হারিয়ে গেছে। হয়তো প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে।
জিজ্ঞেস করলাম আমাকে কী করতে হবে? ওরা তিন’জন বললো – এই এলাকার সবাই তার ভক্ত – কিছুক্ষণ আগে আমার ব্যাপারে একটা সভা হয়েছে। সভার সিদ্ধান্তটাতো জানালোই। এরা তিন’জন দয়াপরবশত আমাকে সাহায্য করতে চায় – আমি নাকি ভাল মানুষ। তাদের কথা – এ এলাকা থেকে বের হয়ে যাবার পথ ৪টা। ৩টা পথ পাহারাদার রেখে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। খোলা আছে একটা পথ – ওরা আমাকে সেই পথ দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে। যদিও জানাজানি হলে ওদের বিপদ হতে পারে। আমার বিশ্বাস ছিল ওদের মধ্যমণির সাথে দেখা হলে আমি ব্যাপারটা সামলাতে পারবো। ওরা বলছে – না আরো বিপদ বাড়বে। আমি তখন তাদের ৪র্থ পথটি দেখাতে বললাম। ৪র্থ পথ বলতে ওরা আমাকে যেখানে নিয়ে গেল – দেখে আমার হৃৎপিন্ড থেকে সমস্ত রক্ত ঝপাৎ করে পায়ের দিকে নেমে গেল – আমার হৃৎপিন্ডের বাপের ক্ষমতা নাই – সেই রক্ত নিজের ঘরে টেনে ফেরত আনে।
একটা নদীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি – ওপার দেখা যায় না – আবহাওয়া ভাল থাকলে হয়তো দেখা যেত। আকাশ কালো। উদ্দাম বাতাস, ঢেউ-এর উপর যে কর্তৃত্ব শুরু করেছে! বাতাসের আদেশে ঢেউগুলো একটা সাথে আরেকটা ধাক্কা দিয়ে ফাটাস ফাটাস তালি বাজাচ্ছে। ওরা বলছে আস্তে করে পানিতে নেমে যেতে – সাঁতরে নাকি ওপারে পৌঁছাতে পারলেই আমি নিরাপদ।
গিনেস রেকর্ডধারী কোন সাঁতারু কিংবা নির্ভীক কোন নৌকারুও এই নদী এই মুহূর্তে পার না হয়ে অপেক্ষা করবে। আর আমি তো শান্ত পুকুর ছাড়া কখনো সাঁতার কাটিনি।
মৃত্যু! নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে আমার জন্য। কিন্তু এত কাছে থেকেও কমল কিংবা দিয়া কিছুই জানবে না।
পালাতে হবে। যেভাবেই হোক এই ৩ জন মানুষ এবং অন্যান্যদের চোখ এড়িয়ে পালাতে হবে। এখন তো মনে হচ্ছে গিজগিজে মানুষে ঠাসা শহরই ভাল। মানুষের দেহের সব সৌন্দর্য্য মাথার চুল। শহরের প্রধান সৌন্দর্য্য গিজগিজে মানুষ। অনেক মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া খুবই সহজ।
একটা সম্ভবনা মাথায় এলো – বিরূপ আবহাওয়া তো ওদের জন্যও ক্ষতিকর – ওরাও নিশ্চয় নিরাপদ জায়গায় চলে যাবে-যদি দেখে যে আমি নদীতে নেমে গেছি। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি নদীর পানিতে পা ডোবাবো – যদিও সঙ্গে সঙ্গে ঢেউগুলোর খাদ্যে পরিণত হবার সম্ভাবনা আছে। তবু পানিতে নামার ভান করে যদি সফল হই – ওরা সরে গেলে আমি পালাবো। কিন্তু পালাবো কোথায়?
বৃষ্টি নামলো – ওরা তিন’জন আমাকে ইশারায় পানিতে নামার তাগিদ দিচ্ছে- তাড়াতাড়ি করতে বলছে। বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে দুই হাতে মাথা ঢেকে একপা দু’পা করে পেছনে সরছে।
গুড! আমি নিশ্চিত ওদের চোখে ধুলো দিতে পারবো – পরে যা হয় হোক, ঝড়ের দাপট আরো বেড়েছে – সঙ্গে বৃষ্টি। আমি নদীর পাড়ে উঠলাম। টাল সামলাতে পারছিনা। পাড় থেকে নিচে নামার সময় পা হড়কে গেল। পড়ে গেলাম – মনে হলো ইমরুলের স্ক্রু ড্রাইভার আমার বুকের ভিতরে ঢুকে গেছে। উঠলাম, নদীর পাড়ের কারণে ওদের দেখতে পাচ্ছি না – মানে ওরাও আমাকে দেখছে না। পানি থেকে হাত দুয়েক ওপর দিয়ে মাথা নিচু করে দিলাম ডানদিকে দৌড়। দৌড়ানো যাচ্ছে না – খুব বেশি না ১০/১৫ গজ হবে হয়তো – খুব সাবধানে উঁকি দিলাম। বাতাস আর বৃষ্টির জন্য পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না। অস্পষ্টভাবে দেখলাম – ওরা তিন’জনই আছে কিন্তু ওদের দৃষ্টিটা আমি যেদিক দিয়ে নেমেছি সেদিকে।
প্রাথমিক সাফল্য পাওয়া গেছে দেখে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। ঝড় আর নদী যদি আমাকে না খায় – ওরা আর আমায় ধরতে পারবে না। এখানেই বসে থাকি। ওরা যদি পাড়ে না উঠে তবেই শতভাগ সাফল্য। আরো নিরাপদ হবার জন্য আমি ডানদিকে খুব কষ্টে এক’পা হাফ’পা করে আরো গজ বিশেক গেলাম। তারপর মাথা উঁচু করলাম সরাসরি। কেউ নাই। চলে গেছে অথবা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। দেখুক আর না দেখুক এখানে আর থাকা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আবার ঠাণ্ডা লাগা যোগ হয়েছে। আমি উঠে এপারে চলে এলাম। দৌড়ে সব চেয়ে কাছে যে বিল্ডিং সেটার মধ্যে ঢুকে গেলাম। বৃষ্টি থাকুক – ঝড়টা কমে এলেই আমি পালাবো। তার আগ পর্যন্ত এখানে লুকিয়ে থাকতে হবে। কেউ কোথাও নেই, নিশ্চয় যে যার ঘরে।
খামাখা ইমরুল ভেবে বসলো – আমি তার এখানে থাকার ব্যপারটা বলে বেড়াবো। আর আমার ভোগান্তি শুরু হলো। লম্বা চওড়ায় এই বিশাল বিল্ডিং- এর কোন দিকে যাবো? একটা লিফটের দরজা খুলে গেল, একজন লম্বু ভাই বেরিয়ে এলো আমাকে অদ্ভুুত দৃষ্টিতে দেখে চলে গেল। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই আমি ওর ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কোন কিছু না ভেবে একটা বাটন দিলাম টিপে – দেখি না কী হয়! আমি বুঝতে পারছি এটা উপরের দিকে উঠছে। উঠছে তো উঠছেই। লিফট যখন থামলো আর দরজা যখন খুললো তখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম – শহীদ হয়ে স্বর্গে এসে গেছি। ইমরুল কী স্ক্রু ড্রাইভারটা সত্যিই আমার বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো!
স্বর্গ কখনো দেখিনি। এই প্রথম, দেখবো কি করে আগেতো আমি মরিনি। পৃথিবীর সাথে একটা সাদৃশ্য পেলাম, আমি গলফ খেলার মাঠে এমন ঘাস, উচু নীচু মাঠ আর ছোট ছোট জলাশয় দেখেছি। কিন্তু হুর পরীরা কই? সত্তর হাজার না কত যেন থাকার কথা আমার জন্য। কেউ আমাকে রিসিভ করতে এগিয়ে এলো না। যদিও বেশ অনেক পরী দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি ঢলাঢলি করছে। আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। যাক ওরা না আসুক ফাইনাল ডেসটিনেশনে তো পৌঁছে গেছি। এরপরতো আর ‘পর’ নাই। কিন্তু শরীর নিয়ে স্বর্গে এলাম! শরীরটাতো পৃথিবীতে রেখে শুধু আত্মা নিয়ে এখানে আসে সবাই। এর আগে আমার জীবদ্দশায় যে ক’টা কেস সামলেছি তাদের শরীরতো আমরা পৃথিবীতে রেখে দিয়েছি। অবশ্য আমি কখনো আত্মাও দেখিনি; না নিজের না অন্যের। শুধু আমার নিজের শরীরটা বাথরুমে দেখেছি অনেকবার।
এবার একটা পরী আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে আমার হাত ধরে একপাক ঘুরলো আমাকেও ঘোরালো। আমার কানের ভিতর কেমন ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে – বুঝতে পারছি এটা পরীদের ভাষা – এ ভাষাতো তাহলে আমাকে শিখতে হবে। ওরাই কী শিখিয়ে দেবে? আরো কয়েকজন পরী এলে আরো ভালো হতো। ভোঁ ভোঁ শব্দগুলো জোড়া দিয়ে ভাষাটা বোঝার চেষ্টা করছি। হঠাৎ ভাষাটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি ওদের ভাষাটা শিখে ফেললাম!
কিন্তু এ কী শুনছি – ‘অমল তখন তুমি ওভাবে কেন চলে এলে’। আরে এতো দিয়া! সে কখন মরলো! দিয়া বলে চলেছে ‘ঝড় বৃষ্টি থামার পর আমি জানতাম তোমাকে এখানে পাব।’ যাহ্ বাবা আমরা কেউ মরিনি! পৃথিবীতেই আছি! এ শহরের মানুষই এই বিশাল বিল্ডিংয়ের মাথায় এমন স্বর্গ বানিয়েছে!
আবার আমার ভয় করতে লাগলো। ‘ইমরুল ভয়’। দিয়াকে এগুলো বলা যাবে না। নায়কোচিত ভাবনা না, ও যদি আমাকে প্রত্যাখান করে এই ভয়। তারচে এই ভাল যে আমি এখন পর্যন্ত জানি যে, আমার বিপদ জানলে ও আমাকে কোথাও লুকিয়ে রেখে বাাঁচাবে।
দিয়া আর কাউকে ডাকতে গেল বোধহয়। আমি সটকে পড়লাম। পরে ওকে বুঝিয়ে বললেই চলবে।
এবার যে ঘরটার মধ্যে ঢুকলাম সেটাও একটা লিফট। তবে আগেরটা মত নয়। লিফটের ভিতরে একজন আছে। নামছি, কোথাও একটা গরবর আছে মনে হতে পায়ের দিকে তাকালাম। দেখি লিফটের মেঝে দু’ভাগ। ফাঁসি কাষ্ঠের প্ল্যাটফর্ম মনে হচ্ছে – হঠাৎ দু’দিকে সরে গেলে! নীচে – অনেক নীচে ঝপাৎ!
এতো ইমরুলের কারসাজি! চিৎকার দিলাম – ‘থামাও এটা- আমি যাব না। সঙ্গের লোকটি নির্বিকার। একটা কিছুতে হাত দিলো লিফটা থেমে গেল। দরজাটা খোলা মাত্র আমি লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ঘামছি আমি। আমার ভেজা কাপড় চোপড় কখন শুকিয়েছিলো জানিই না। বিল্ডিংয়ের ভেতরে আমি এখন কত তলায় সেটাও বুঝছি না।
এবার আর লিফট না। সিড়ি খুঁজে নিয়ে নামছি। খুব দ্রুত কয়েক তলা নেমেছি। দেখি আমার সামনের পায়ের নিচে সিঁড়ির ৫/৬ টা ধাপ নাই। যাহ্ বাবা নামবো কি করে! পিছনে তাকালাম একজন মধ্যবয়স্কা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে – আমাকে ক্রস করছে – আরে মাঝের কয়েকধাপ সিঁড়ি নেই এতো দেখেইনি! পড়ে যাবে বলে ধরতে গেলাম। দেখি ‘নেই ধাপে’ পা দেওয়া মাত্র সিড়িটা আমার দৃষ্টিগোচর হলো – পরেরটাও তাই – তার পরেরটাও তাই। মহিলা অবলীলায় নেমে যাচ্ছে। এটি আমার দৃষ্টি বিভ্রম! না অন্য কিছু!
সিঁড়ির ব্যাপারে ভরসা হারিয়ে ফেললাম। ফিরে উপরে উঠে আবার লিফট খুঁজছি। পাচ্ছি না। ‘এল’ প্যাটার্ন ‘ইউ’ টাইপ নানান রকমের করিডোর ঘুরে একটা পেলাম। বাটন টিপে ভিতরে ঢুকে বোকা বনে গেলাম। এটা লিফট না সুইচরুম বুঝলাম না। আমার মনে হল কোন এয়ারক্র্যাফটের কক্পিটের ভিতরে ঢুকে পড়েছি। যে দরজা দিয়ে ঢুকলাম সেটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। ‘ইমরুল প্যানিকের’ চেয়ে এ কিছু না ভেবে দিলাম একটা বাটন টিপে। কিছুই ঘটল না – আরেকটা বাটনে হাত দিতে যাব – মনে হলো পায়ের নীচটা সচল হলো। বসে পড়লাম, ক্লান্তি! এটা লিফটই নীচের দিকে নামছে। কিছুক্ষণ নামার পর থামলো – অপেক্ষায় আছি, দরজা খুললো না – ছোট ঘরটা আবার সচল হলো – কী ঘটছে বুঝতে পারছিনা – আর কোন বাটনে হাত দিতেও ভয় হচ্ছে, গুঁউ মত আওয়াজ হচ্ছে হঠাৎ বুঝতে পারলাম ছোট ঘরটি এবার বামদিকে যাচ্ছে – লিফটতো জানতাম উঠে আর নামে। এতো দেখি সমতলেও চলে! যা ঘটে ঘটুক। ইমরুল সীমানার বাইরে কোথাও রেখে আসুক।
থামল – দরজাও খুললো। বেড়িয়ে এলাম, বাইরে খোলা মাঠ দেখতে পাচ্ছি। বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর আকাশ বেশ পরিষ্কার। কিন্তু দিনের আলো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ জায়গাটাকে একটু বেশী গ্রাম গ্রাম মনে হচ্ছে – মাটির ঘরবাড়ি। নেয়ে ওঠা গাছগুলোকে মনে হচ্ছে কিশোরী।
মাটির তৈরি ঘরবাড়িগুলো পর পর অনেকগুলি, দুপাশেই – মাঝখান দিয়ে মাটির রাস্তা কাদা নাই – ভেজা ভেজা শুকনো। সামনে একটা বাগান। বাগানের পর ফাঁকা মাঠ, জলাশয়ও চোখে পড়লো। ওদিকেই হাঁটা দিলাম। আবার শক্ খেলাম – একটা বাড়ির সদর দরজায় একটা গ্রাম্য মেয়ে ঘোমটা মাথায় ভয় ভয় চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। পরের বাড়ি থেকে আর একজন। পেছনে তাকালাম একই রকমভাবে প্রত্যেকটা বাড়ির দোরগোড়ায় একজন করে সবাই ভয়ে ভয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু ভয়টা ওদের কী কারণে! আমি কী এদের কাছে গ্যালিভার হয়ে গেছি নাকি? সাইজতো আমার মতোই। পা চালালাম যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়া যায়। আর একটু হাঁটলেই বাগানটা শেষ হয়ে খোলা মাঠে পড়বো।
পথ পথিকের সৃষ্টি করেনা – পথিকই পথের সৃষ্টি করে’ এই সূত্র মেনে মানুষ প্রতিনিয়ত যেদিক দিয়ে হেঁটে গেছে পথটা এঁকেবেঁকে সেই রকমের তৈরি হয়ে আছে। আমি পূর্বসূরির পথ ধরে চলছি। পেছনে আর তাকাতে ইচ্ছা করছে না। একটা মোরগ মাটি থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছিল। দেখলাম মানুষের ত্যাগ করা মল-তার উপর বৃষ্টি পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থ্যাক থ্যাকে একটা অবস্থা, দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে। মানুষের মলে যত দূর্গন্ধ অন্য কোন প্রাণীর মলে বোধহয় এত দূর্গন্ধ হয় না। মোরগটা দেখি এটা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।
মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে আবার কোঁকর কোঁকর করে আমার দিকে তেড়ে এল। আরে বাবা আমি কি তোর খাবারে ভাগ বসাতে গেছি। মানুষ যা ত্যাগ করে সেটা আবার গ্রহণ করে নাকি? আমার রাস্তাটা ছাড় আমি চলে যাই। তোর খাবার তুই খা। মোরগটা আমাকে তেড়ে ঠোকরাতে এলো। ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি! ‘যাহ্ যাহ্’ লাফ দিয়ে জায়গাটা পেরিয়ে এলাম – মোরগটা কিছুটা দূর তেড়ে এসে থেমে গেল। চোখ ফিরিয়ে এগোতে যাব – মনে হলো আরো কিছু দেখেছি। ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। ধরাস করে উঠলো বুক। ইমরুলের সেই ৩ জন। সঙ্গে আরো কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ যোগাড় করে নিয়ে আমার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। এবার আমি ঝেড়ে দৌড় দিলাম। ওরাও দৌড়াতে শুরু করেছে। এবার আর রেহাই নাই।
আর পারছি না, মনে হলো ওদের হাতে ধরা দিয়ে মরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু এ লোক থেকে সে লোকে যাবার পথ কেন মৃত্যু! লিফটে করে তখনকার মতো যদি স্বর্গে যাওয়া যেতো! ঘ্যাচাং করে ইমরুলের স্ক্রু ড্রাইভার বুকের ভিতরে ঢুকে মৃত্যু! এটা কোন ভাবেই মানা যায় না। সুতরাং দৌড়াও যত পারো দূরত্ব বাড়াও- তাহলেই হবে। এঁকে বেঁকে সমতলে দৌড়াচ্ছিলাম। এক জায়গায় এসে দেখি পথ শেষ – একটা ঢালু জায়গা – অনেকটা ঢালু নিচে আবার বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ ঢালু জায়গা দিয়ে দৌড়ে কেন হেঁটেও নামা যাবে না। দ্রুত ডানে বামে তাকালাম – ডানদিকে বেশ খানিকটা দূরে মনে হলো একটা সিঁড়ি মত, ডানদিকে দৌড়ালাম। এর মধ্যে কিছুটা সময় নষ্ট হওয়াই ওদের সাথে দূরত্বটা যতটা বাড়িয়ে ছিলাম সেটা আবার কমে এসেছে- সিঁড়িটা দিয়ে যখন নিচে নামছি তখন মনো হলো একসাথে যদি ৪/৫ ধাপ টপকাতে পারতাম। কিন্তু ওঠার সময় ২/৩ টা সিঁড়ি একসাথে ভাঙ্গা যতটা সহজ নিচে নামার সময় তা অনেক কঠিন। দ্রুত নামছি কিন্তু প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে! ব্যাপার কী! আরে একটাতো স্কেলেটর – ধাপগুলো উপরের দিকে উঠে আসছে। এটা দিয়ে নামা যাবে না। আমি যত নামছি – সিঁড়িগুলো আমাকে উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। লোকগুলো আমাকে এখুনি ধরে ফেলবে। কিছু করার নাই। কিন্তু এটা দিয়েই আমি নিচে নেমে যাব। প্রাণপণ। নিচে যখন পৌঁছালাম ওরা তখন স্কেলেটরের মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে – কিন্তু ওদের মধ্যে কোন ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। আমি কী তবে ওদের আওতার বাইরে এসে গেছি!
একজনকে দেখলাম স্কেলেটরের রেলিংয়ের গোড়ায় হাত দিয়ে কী করছে। আরে স্কেলেটরটা থেমে গেল! শালারা- আবার দৌড়।
লম্বা প্রাচীর ঘেরা একটা এলাকার পাশ দিয়ে দৌড়াচ্ছি। প্রাচীরটা শেষ না হলে লুকানোর কোন জায়গা পাব না। এটা বোধহয় বিল্ডিংগুলোর পিছন দিক। এক জায়গায় এসে ছোট একটা অপ্রশস্ত গেট পেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কেউ নাই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হালকা একটা দিনের আলো আছে। এখানে কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে। পিছনে আর কাউকে দেখলাম না। অর্ধসমাপ্ত একটি বিল্ডিংয়ের ভিতর ঢুকে পড়লাম। বিল্ডিংটার নিচের ২ তলা কমপ্লিট। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোর দিয়ে দৌঁড়ে একটা জায়গা এসে লুকানোর জায়গা খুঁজছি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। দেড় মানুষ উঁচুতে একটা খালি জায়গা পেয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়লাম। পায়ের নিচে লোহা-লক্কর জাতীয় কী আছে, অন্ধকার থাকায় বুঝতে পারলাম না। এখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না মনে করে বেশ আশ্বস্ত হলাম।
কোন কারণে ডাক্তার ইনজেকশন করতে চাইলে প্রথমে মনে হয় ডাক্তার বোধহয় কামান দাগতে চলেছে – ইনজেকশন দেওয়া হয়ে গেলে মনে হয় ‘ওঃ এতো কিছুই না!’ আমার এরকম অনেকবার হয়েছে। আজ বিকেল থেকে যা কিছু ঘটে গেল – এখন একটু নিরাপদ বোধ করায় সেই রকমই মনে হলো এবং ভীষণ ক্লান্ত হওয়ায় আরামদায়ক বিছানা ছাড়াই আমি ঘুমিয়ে গেলাম। ‘কখন ঘুমিয়েছি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি – কোথায় আছি’ – ঘুম ভাঙ্গার পর এগুলো ভাবার কোন সুযোগ পাওয়া গেল না – কারণ নিচে বেশ কয়েকজনের চাপাকণ্ঠস্বর আমাকে আবার আতঙ্কিত করে তুলল। এটা স্পষ্ট যে আমি এখানে এসে ঘুমিয়ে পরার পর এরা এখানে এসেছে। খুব সাবধানে মাথাটা উঁচু করলাম – দেখলাম ৭/৮ জন নানান বয়সের সাদা কালো মানুষ। সকলের হাতেই অস্ত্র। কোন শব্দ না করে খেয়াল করছি। এরা কারা? দুই’জনকে দেখলাম ছোট দুটি কম্পিউটার নিয়ে – দ্রুত ফটাফট বাটন টিপে কী সব হিসাব করছে। বাকিরা নিজেদের অস্ত্রগুলো মনে হয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। আমার হাত-পা-ঘাড় সব খিল ধরার মত অবস্থা – একটু নড়াচড়া করা খুবই জরুরি। খেয়াল করলাম গতরাত থেকে আমি যার উপরে শুয়েছিলাম, ওগুলো সব বিল্ডিংয়ের কঙ্কাল। কঙ্কালগুলো এই বিল্ডিংয়ের উপর জোড়া দিয়ে মাসল লাগিয়ে আরো উঁচু করার অপেক্ষায় আছে মনে হয়। নিজের অজান্তেই শব্দ করে ফেললাম – খটাখট।
সবগুলো চোখ আমার উপর। ওরা আমাকে ধরে নিচে নামালো। মুখ বেঁধে ফেললো। ভেবেছিলাম হাত দুটোও পিছমোরা করে বাঁধবে – সেটা করলো না। বসিয়ে রাখলো। আমার হৃৎপিন্ড এত জোরে চলছে যে আমি তার শব্দ শুনছি। যখন ভয়হীন নিশ্চিত জীবনযাপন করতাম তখনকার কথা মনে পড়ছে – অনেক অপূর্ণতাসহও কত সুন্দর সে জীবন! আবার ফ্রি জীবন পাব? না এখানেই সমাপ্তি।
কম্পিউটার নিয়ে যে দুই’জন ব্যস্ত ওরাও উত্তেজিত। বাকিরা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে, আমাকে লক্ষ্যে রেখেছে কিন্তু কোন কথা জিজ্ঞেসও করেনি।
আরো কিছুক্ষণ পর হঠাৎ এক’জন এসে ঘরটির মধ্যে ঢুকলো এরাও যেন আশ্বস্ত হলো। আমি দেখলাম ইমরুল। আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে নিজের লোকদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভালভাবে না বুঝলেও আমার মনে হলো এরা বড় ধরনের কোন মিশন সাকসেসফুল করতে তৈরি হচ্ছে।
ওদের কথা বার্তায় কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। সারা শহর জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন গ্রুপ একই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা এখান থেকে পরিচালিত হচ্ছে। কম্পিউটারম্যান দুই’জন ইমরুলের নির্দেশেই সবগুলো গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে – কম্পিউটারের মাধ্যমে। অন্যরা ইমরুলের কাছে যা রিপোর্ট করলো তা হলো এই যে, এই জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই – দু’বার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা চেক করে গেছে। তাদের ভিতর এদের নিজস্ব লোক থাকায় দু’বারই তাদের ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছে এবং আরো চেকিং হতে পারে।
এরা সম্ভবত নির্দিষ্ট একটা সময় বেছে রেখেছে – সে পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। হায়! দুষ্ট গ্রহের ফেরে পড়ে আমি এদের মধ্যে কীভাবে এসে পড়লাম!
বুট জুতার আওয়াজ আসছে বাইরের বারান্দার দিক থেকে। এদের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা দেখা দিল। ইমরুল শান্ত। মুখ বাঁধা অবস্থায় আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। একজন একটা ব্যাগ খুলে টপাটপ এক একটা কাপড় প্রত্যেকের দিকে ছুড়ে দিলো। প্রত্যেকে সেগুলো লুফে নিয়ে পোশাকের উপরেই পোশাক পরে ফেললো – এবং পরমুহূর্তে দেখা গেলো এরা সবাই সৈনিক বনে গেছে।
একজন দৌড়ে দরজার কাছে গেল, হাতে একটা তালা। খোলা দরজার পাল্লাদুটো ভেজিয়ে দিয়ে ছোট ফাঁক রেখে একহাত দিয়ে বাইরে দিকে লোহার বালাদুটোই তালাটা পরিয়ে টিপ দেয়া চেষ্টা করছে- পারল না- বাইরের বারান্দাটা ‘এল’ প্যাটার্নের, ৫/১০ সেকেন্ডের মধ্যেই বুটধারীদের দেখা যাবে। পাল্লাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে-দেখতে পেলাম লোহার আংটা দুটোয় তালাটা ঝুলছে – খোলা অবস্থায়। চাপাকণ্ঠে ইমরুল বলল -‘এ অবস্থায় ওরা ফিরে গেলে গেল – না হলে ফায়ার।’
আমি প্রায় অনেকক্ষণ দম বন্ধ করেছিলাম। এসে গেছে – দরজার ফাঁক দিয়ে আমি দেখলাম ওদের ইউনিফর্মও এদের মত। এরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে দু’পাশে সরে গেছে। অস্ত্র তাক করা দরজা বরাবর।
ওরা ঢুকে গেল সরাসরি। প্রচণ্ড শব্দে আমার কান ফেটে গেল। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। খুলে দেখি ৮/১০ জনের মত মেঝেতে নিথর পড়ে আছে। এরা লাশগুলো টপকে গুলি করতে করতে সামনের দিকে চলে যাচ্ছে সবাই। ঘরটির মধ্যে আমি এখন একা।
আমার হাত খোলা ছিল মুখের কাপড়টা খুলে ফেললাম। বিকট চিৎকার বের হয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। একবার সামনে একবার পিছনে দৌড়ালাম। গোলাগুলির শব্দ চলছেই। একবার ভাবলাম কাল সারারাত যেখানে ঘুমিয়েছিলাম সেখানেই উঠে লুকিয়ে থাকি। গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি – কিন্তু বেশ দূর থেকে আসছে। মনে হচ্ছে গুলির শব্দ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।
ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বারান্দাটা যেখানে ‘এল’ প্যাটার্ন-এ বাঁক নিয়েছে সেখানে এসে অনেকগুলো লাশ দেখতে পেলাম, বারান্দায় – খোলা মাঠে। সবগুলোই ইউনিফর্ম পরিহিত।
অনেক সামনে বড় গেট দেখা গেল, মূল গেট, বাইরে রাস্তা। অনেক মানুষ অনেক গাড়ি। গোলাগুলি থেমে গেছে। সবাই উল্লাস করছে। কিন্তু সুশৃংখল। পটাপট যে যে গাড়িতে পারছে উঠে বসছে, গাড়িগুলো ছেড়ে যাচ্ছে – মনে হয় শহরের কেন্দ্রের দিকে।
আমিও ধীরে ধীরে গেটের দিকে যাচ্ছি। পা দুটো ভারি, জুতা খুলে ফেললাম। ফোস্কা পড়ে গেছে। জুতা হাতে হাঁটছি। দেখলাম অনেকগুলো গাছের পাতাসহ ডাল ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পাতাগুলো এখনো সজীব। অন্যসময় হলে ভাবতাম এগুলো কোনো দুষ্টু ছেলেমেয়ের দুষ্টামি – কিন্তু এখন আমি জানি এগুলো এলোপাতাড়ি গোলাগুলির ফলাফল। উল্টোদিক থেকে আমার দিকে একজন মহিলা আসছে। সাথে দু’টো শিশু। পায়ের নিচে শীতলবোধ করায় তাকিয়ে দেখি পানি। মানুষের বানানো লেক থেকে বাঁধানো জায়গায় পানি উপচে উঠেছে। খুব আরামবোধ করলাম।
ভদ্রমহিলা কোমড় ভেঙ্গে শিশু দুটির মাথার লেভেলে মাথা নুইয়ে একবার ডানে একবার বায়ে তাকিয়ে কি যেন বলে আবার কোমড় সোজা করে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা হাসছে। শিশু দুটিও পরম আনন্দে হাসছে। মধুর দৃশ্য! ওরা যখন আমাকে ক্রস করছে – ভদ্রমহিলা আমার দিকে একটু মাথা নুইয়ে যে ভাব প্রকাশ করলো তার অর্থ বোধহয় “ভাল তো!”
আমাদের মাঝখানের দূরত্ব বাড়তে থাকলো, আমি ভাবছি ভদ্রমহিলাকে কোথাও দেখেছি। মনেও পড়ে গেল। কাগজে তার ছবি বহুবার দেখেছি।
গেটের বাইরে এসে গেলাম। ডানদিকেও গেলাম না বামদিকেও গেলাম না। রাস্তাটা পার হয়ে মাঠে গিয়ে পড়লাম। হাঁটছি। মাটিটা ফাটাফাটা, মনে হচ্ছে বৃষ্টির জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। খালি পায়ে ফাটা শক্ত মাটিতে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তবু আমাকে তো হাঁটতেই হবে।
কোন আদর্শের পতন হলো আর কোন আদর্শের জয় হলো কে জানে? আমার মতো সাধারণের তো জয়ী আদর্শেই জীবনযাপন করতে হবে।