শিল্পের জগতে, বিশেষত চলচ্চিত্রে হররের সূচনাকারী কিংবা উদগাতা হিসেবে জাঁ কঁকতোর নাম নিশ্চিন্তেই নেয়া যায়। কঁকতো কবিও বটেন। বিশ শতকে পরাবাস্তববাদীরা, বিশেষত সালভাদর দালি চিত্রকলায় তেমনতর চূড়া স্পর্শ করেছিলেন এবং চিন্তাকেও সেই চূড়াবাসী করেছিলেন। এমনটা ভাবা অন্যায় হবে না যে, এডগার এ্যালান পো কিংবা হুয়ান রুলফা কিঞ্চিত আগেই সেই জমির বীজতলা নির্মাণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’; হাংরি গল্পকার বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’; সেলিম মোরশেদ-এর ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ মনে করিয়ে দেয় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর-এর অত্যাসন্ন আগমন বার্তা এবং গত ৭মার্চ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অকালপ্রয়াণ এই আঙ্গুলিনির্দেশ করে যায় যে, বাংলা কথাসাহিত্যে একটি স্বল্পখোদিত পাথুরে পথকে তিনি অনেকটাই প্রসারিত করেছেন। তাঁর বারোটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’ সেই সাংঘাতাকি সুরে বাঁধা ভীমপলশ্রী। যেখানে বীরসম ও বিভৎস রস কিংবা রৌদ্ররসের মহাকব্যিক প্রকাশ।
গল্পগ্রন্থের নামগল্পে রূপক-প্রতকি-চিত্রকলা-মিথ নির্মাণে নৈয়ায়িকতা বারবার বুঝাতে চায়, সুনির্দিষ্ট-অনির্দেশ্য অপদেবতার অক্টোপাস অচলায়তনকে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সাতমাথা রয়েছে, কিন্তু রূপকের বিচিত্র ব্যঞ্জনা প্রায় প্রতিটি বাক্যে সমকালীন ও নিমচিরকালীন স্বদেশকে বিম্বিত করে রাখে। কেননা, রক্তপাত ও মৃত্যু পৃথিবীর কোনো-না-কোনো কেন্দ্র ও প্রান্তের জন্য এক চিরবস্তু। এ-পৃথিবী যেন রক্ত এবং মৃত্যুর এক মহামিউজিয়াম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ – আত্মত্যাগ – টর্চার-অনন্ত-অপ্রাপ্তি এবং অধিকিন্তু অবমূল্যায়ন ও নিগ্রহ-পক্ষপাত এক চেতনার চিরবস্তু আকারে প্রাসঙ্গিক হয়ে ফুটে আছে ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’ গল্পটিতে।
শুধু বিষয়বস্তুর বিন্যাসে কাললিপ্ত বৈশ্বিক পাঠাতনে দাঁড়াবার ভঙ্গি তাঁর ভাষা ও আঙ্গিকের অন্বিষ্ট। কিন্তু কিছু গল্পে সুস্পষ্ট কালজ্ঞানের সঙ্গে স্বদেশোত্থিত ইতিহাস ও সময়চেতনাকে সাঙ্গীকৃত করতে দেখা যায় তাঁকে। বিশেষভাবে, ‘যেভাবে তিনি খুন হতে থাকেন’ গল্পে ক্রসফায়ারে অনৈতিকভাবে একজন বিপ্লবী তাত্তি¡ককে খুন করার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র হাল-খতিয়ান নম্বরসহ অনুপুঙ্খ তুলে ধরেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে অন্যতম কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা এ-বিষয়ে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘কার্জন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক’ নামে। বইটি তৎকালীন প্রথম আলো সাহিত্য সম্পাদক রিভিউ করতে দিলেও শেষপর্যন্ত তিনি তা ছাপাতে পারেননি। একই দশকের দুই কথাকারের একই বিষয়ে লেখার তুলনামূলক আলোচনায় বলতে পারি, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর অধিকতর প্রাসঙ্গিক। কেননা, তিনি একজন পাতিমাস্তানের জায়গায় একজন সৎ-নির্ভীক বিপ্লবী তাত্তি¡ককে চরিত্র করেছেন এবং তাঁর মুখ দিয়ে সত্য উচ্চারণ করিয়েছেন। যেমন, ‘বই-পত্রে সারাটা ঘর ঠাসা’ জাতীয় বর্ণনা। কিংবা ‘আমার ৭০ বছরের জীবনে একজনইতো ছিল, এখনোও আছে; আমি কয়জনের নাম বলবো, কার নাম বলব’? কিংবা শুধু একটা সাউন্ড ইফেক্ট দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিতে পারেন অচলায়তনের অন্যায্যতা। তাই গল্প শেষ করেন এভাবে, ‘অনেক রাতে একটা গাড়ী গোগো করতে-করতে বাইরে, অনেক দূরে যেতে থাকে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে গাড়িটি উদাস জমিনের দিকে পা চালায়। কোথায় এটি থামে তা না-বুঝলেও একসময় কোন এক নির্জন রাত ফেঁড়ে কেবল একদিক থেকে কয়েকটা গুলির শব্দ হয়’। আর এভাবেই বস্তুনিষ্ঠতার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সমস্যাকে অনির্দিষ্টতা-নৈর্ব্যক্তিকতার মাধ্যমে কে অপরাধী? আর কে নিরপরাধ? তার সুস্পষ্ট সীমারেখা নিশ্চিত করেন তিনি।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের অন্যতম অভিনিবেশ অতিজাগতিক অনুভূতির দিকে। কখনো-কখনো বাস্তব সমস্যার সঙ্গে মেটাফিজিক্সের মিশেলে এড়িয়ে যান ঐতিহাসিক চরিত্রকে। একটি সুস্পষ্ট টাইমস্কেল বেঁধে দিয়ে কিছুটা টাইপ চরিত্রের মাধ্যমে পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণ করার প্রবণতা বিরল নয় তাঁর টেক্সটে। যেমন, বিহারী বলতেই রাজাকার বুঝানো কিংবা ধার্মিক মানুষের সম্মান পাওয়াকেও রঙ্গ-রসিকতার মানদণ্ডে বিচার করার একরৈখিক মানদণ্ড তাঁকে পেয়ে বসেছে কখনো-কখনো। টেন্ডারবাজি নিয়ে লেখা তাঁর ‘শিস দেয়া রাস্তাটি’ এমন উদাহরণ। কুকুরের কান্নার সঙ্গে রাস্তার কান্না মিশে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসকে। কিংবা একটি রাস্তার নায়ক হয়ে উঠবার উপমা মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘রাজপথের কথা’, ‘ঘাটের কথা’ গল্প দুটিকে। কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের বস্তুগত প্রতিনিধিত্ব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বকল্পিত কালজ্ঞানের জায়গায় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর প্রতিস্থাপিত করেন এবং কাঠগড়ায় দাঁড় করান কর্পোরেট কালজ্ঞানাশ্রিত নতুন সমাজ বদলের কায়া-কঙ্কাল। কিন্তু নিমইতিহাস তাঁর কথাকাহিনিতে কালাতিহাস হয়েই থাকে। কেননা, প্রান্তিক ইতিহাস নিমইতিহাস থেকে আরো প্রাসঙ্গিক জ্যান্ত-ইতিহাস আকারে আকৃতি দান করবার মতো কোন উপাদানিক কারুকৃতি তখনও তাঁর কব্জিতে আসেনি মনে করি। অথচ তাঁর মহাকাব্যিক ভঙ্গি, মন্থর বয়ান, চিত্ররূপময়তা, ডিটেলিং, ড্রামাটিক ডিসকোর্স অন্য এক অনাস্বাদিত অঞ্চলের দিকে ধ্যানসহ ধাবিত করে আমাদের।
গল্পের ভিতর টোটেম স্তম্ভের মতো কোন প্রাণীর পরাবিগ্রহ স্থাপন-করা কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের একটি প্রধান প্রবণতা। ‘শিস দেয়া রাস্তাটি’ গল্পে যেমন হাজির হয় সূরা-কাহকের পথ পাহারা-দেয়া কালসচেতন কুকুর তেমনি ‘সর্পকাল’ গল্পেও আবহজীবের জিঘাংসাসহ জারি আছে সাপের গুজব ও মিথমিশ্রিত বয়ান। ‘সর্পকাল’ গল্পটিও প্রতীক-প্রবণতায় আচ্ছন্ন। মূলত নব্বইয়ের দশকে সেনা ও স্বৈরাচারী শাসনকাল প্রতীকায়িত হয়েছে সর্প-কবিতা-প্রার্থনার ত্রিমুখী তরিতার অন্ধকারাচ্ছন্ন অবয়বে। বাইবেলে বর্ণিত রিপু ও রিরংসা প্রতীক সাপ ‘তৎকালীন স্বৈরশাসকের কবিতাশ্রিত কীর্তিকলাপ এবং ধর্মব্যবসার ধ্বজা; এই তিন তরিকার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার খলতান্ত্রিক খোলস উন্মোচন এই গল্পের গন্তব্য।
ষাটের দশকে শিল্পের জগতে শক-থেরাপি অনেক আলোড়ন তুলেছিল। বিশেষভাবে যৌন-আবেদন সৃষ্টির ক্ষেত্রে। তাঁর আনেকটা অধঃক্ষেপ অগোচরে রয়ে গেলেও আরেকটা আজও দৃশ্য ও দৃষ্টিগোচর হয়। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের ভাবজগতেও তেমন তরিকার সুস্পষ্ট আলোড়ন আস্বাদ্য। মানসভ্রমণের ভঙ্গি তাই তাঁর অনেক গল্পকে করেছে অলংকারবহুল এবং বয়াননির্ভর এবং স্বল্পসংলাপী। চরিত্রের সংলাপ সেখানে মানসভ্রমণপ্রসূত। চরিত্রের হয়ে ব’লে দেন লেখক নিজেই। শক-থেরাপির সমকালীন কায়াবদলের কথা আমরা পাই কবি-গল্পকার-জনসংস্কৃতি গবেষক সুমন রহমানের ‘কানার হাটবাজার’ গল্পে। সেই গল্পের একটি অধ্যায় ‘আগুনের বিনোদন’-এর সঙ্গে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের জগতকে মিলিয়ে নিতে পারি আমরা। ‘এখানে চিহ্ন সংগ্রহ করা হয়’ গল্পের প্রবণতা প্রসঙ্গে এ-কথাগুলো বললাম। অন্য গল্পের জন্য তা অনিবার্য বটে। নব্বইয়ের দশকে অন্যতম কবি শামীম কবীরের জগতের সঙ্গে যুগলবন্দি হয়ে যায় কখনো-কখনো কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের জগত। তেমনটা স্পষ্ট হয় যখন তিনি শামীম কবীরের একমুখী ব্রিজের চিত্রকল্পের মতো বলেন, ‘এখানে একটাই রাস্তা, যা দিয়ে শুধু ঢোকা যায়; কিন্তু বেরোতে পারবেনা কেউ’।
মহাকাব্যিক থেকে কাব্যিক এবং কাব্যিক থেকে হঠাৎ চম্পুর দিকে ধাবিত হয়ে গেছে যেন কখনো-কখনো কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের ভাষাভঙ্গি। ‘এ তবে ছায়ার গল্প’ অনেকটা এ-রকম কিংবা কাব্যনাট্য যেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পক্ষপাত এবং বেহাত-বিপ্লব (!) বার বার ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর চেতনালোকে, চিন্তায় ও চিত্রকল্পে বিপ্লবী রাজনীতির পক্ষে ইস্পিত ও সুস্পষ্ট। তবু আশাভঙ্গের বেদনা কিছু বেমি। কেননা, বাংলাভাইয়ের উত্থান, গ্রেনেড হামলা, ধর্মব্যবসা তাঁকে বিচলিত করে। কিন্তু কখনো-কখনো তিনি ধার্মিকতা ও ধর্মপ্রাণতার সঙ্গে সাংস্কৃতিক ভেদবুদ্ধি এবং ধর্মব্যবসাকে কিছুটা গুলিয়ে ফেলেছেন। যেনবা সবার সমস্যার সঙ্গে সমানতালে চলেনি তাঁর টেক্সট ও টিটকারী। কেননা, একজন কবিও তাঁর কথাকাহিনিতে টাইপ চরিত্রাকারে চিৎকৃত। এ-যেন ব্যর্থ কবিত্বের গল্পকার গরিমায় গোসা ও ঝাল মেটানো। অথচ সৎ-অসৎএর বাইরের কোনো নির্ণায়ক বিন্দুর দেখা তিনি তখনো পাননি যেন। কিন্তু সুস্থতা-সততা ন্যায়পরায়ণতার আকাক্সক্ষার তীব্রতা তাঁকে দ্রষ্টা থেকে দার্শনিকতা এবং প্রোফেসির সন্ধানি করেছে সর্বদা স্বগুণান্বেষী সুফিস্টদের মতো। ‘এ তবে ছায়ার গল্প’ তেমনি এক পথান্বেষী পর্যটন।
চিরায়ত রুশ সাহিত্যে প্রভাব পরেনি এমন কথাসাহিত্যিক পুরো পৃথিবীতেই বিরল। আর সে কারণেই ‘মৃত্যুজনিত শোকপ্রণালী’ প’ড়ে যায় লেভ টলস্তয় ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’ গল্পটির কথা। মনে পড়ে ডায়লজিক পলিফোনির কথা এবং অবশ্যই দস্তয়েভস্কিকে। কিন্তু কিছুটা ফারাক আছে। এক্সটেনশন আছে। টলস্তয় মানুষের মৃত্যুর পরের তুচ্ছতাকে তুলে ধরেন। আর কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর চেতনাপ্রবাহরীতিতে পূর্বাপরকে নানা ভঙ্গিতে পর্যালোচনা করেন। নানা রকমের বিক্রিবাট্টাসহ হাজির করেন নিমনিকট-নিমঅতীতকে এবং সব চেনাজানা ছকবাঁধা রাজনীতিকে তুলোধুনো ক’রে সুস্পষ্ট স্বপ্নসহ বাসা বাঁধেন ‘অনাস্থা সেতুর ধারে’। বলছিলাম কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের ডায়লোজিক পলিফোনির নিজস্বতা নিয়ে। দস্তয়েভস্কি থেকে কোথায় তিনি আলাদা? কেমন তাঁর আলাদাত্বের আঙিনা? দস্তয়েভস্কি কখনো একটি চিঠির মাধ্যমে, কখনো দীর্ঘ সংলাপে কাহিনির পূর্বজের ধরে টান দেন। আবার কখনো আলাপচারিতার আদলে একজনকে ‘সৌতি’ এবং অন্যজনকে ‘শোনক’ বানিয়ে কাহিনির বিস্তার ঘটান। কিন্তু ঠিক তেমনটা নয়, বরং তারোধিক তরিকার তল্পিবাহক হন কথাকার কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। তিনি একটি মব কিংবা জটলার জটিল মনোভঙ্গিকে বয়ানের মাধ্যমে, চ‚র্ণ সংলাপে সমন্বিত করেন। একে আমরা বলতে পারি, মব-মনোগত-মেথড কিংবা সোজা বাংলায় যৌথস্বরসংযুক্তি যা ঠিক ‘বহুস্বরসঙ্গতি’ নয়। অন্যান্য গল্পের তুলনায় যা ‘মৃত্যুজনিত শোকপ্রণালী’ গল্পে অধিক অনুসৃত। একইভাবে দেখতে পাই, ‘জল যখন লাল বর্ণ নেয়’ গল্পে। এই গল্পে উঠে এসেছে কপ্তাই বাঁধের কারণে বিপর্যস্ত আদিবাসী জীবন এবং তাদের রক্তদানের ইতিহাস। গল্পটির সঙ্গে নামকরণে এবং হত্যায় মিল খুঁজে পাওয়া যায় নব্বইয়ের দশকের অন্যতম গল্পকার মাহবুব মোর্শেদের ‘নদীর রঙ মচকা ফুলের মতোই লাল’ গল্পের। যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যার কথা বলা হয়েছে। ‘জল যখন লাল বর্ণ নেয়’ গল্পটি একাধারে পাহাড় কাটা, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ, আদিবাসী ঐতিহ্য সংহার এবং সেটলারদের ভোগলিপ্সু মনোভঙ্গির সমালোচনামুখর।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রবণতা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে শুরু করে তৎপরবর্তী তিরিশ-বত্রিশ বছর পর্যন্ত সময়কালের চালচিত্র ধরা পড়েছে তাঁর এই গল্পগ্রন্থে। কাউকেই তিনি ছেড়ে কথা বলেন নি। এমনকি যে প্রগতিশীল-বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি তাঁর পক্ষপাত, সেই সীমিত সচেতন অংশের সীমাবদ্ধতার প্রতিও তিনি তাঁর লেখনীকে লেলিয়ে দিয়েছেন জ্ঞাতসারে। বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা সেরা গল্পগুলির একটি ‘যুদ্ধলগন’। যুদ্ধের পরবর্তী তিরিশ-বত্রিশ বছর পর সেইসব রাজাকারের ক্ষমতালাভ এবং তৎজনিত জিঘাংসা, বেহাতবিপ্লবের রাহুগ্রাস এই গল্পের সারোৎসার। ‘আসুন বাড়িটা লক্ষ করি’ গল্পের বুনন মনে করিয়ে দেয় স্থাপনাচিত্রের রক্ত-মাংসমিশ্রিত অন্দরমহল। যে অন্দরমহর মূলত কর্পোরেট পৃথিবীর হতাশ্বাসেভরা হেরেমখানা। ক্ষমতা অনেক বস্তুপোকরণ দিলেও মানুষের মর্ম ও মমতাও যে কেড়ে নেয়, তারই তত্ত¡তালাশ আছে এই গল্পে। চিরপরিচিত নারীনিগ্রহ, ভোগবাদী সমাজের চিত্র চমৎকার চিরক‚টের মতো আমাদের হাতে গুঁজে দিয়েছেন গল্পকার।
কথাকবি হিসেবে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর একইসঙ্গে গদ্যের কঠিন-কঠোর-হাতুড়ি হানেন এবং উঁচুদরের-সূ²স্তরের কাব্যিক রসাস্বাদনের যোগ্য রসমাধুরীর যোগানও দেন। অনেকটা বোদলেয়ারীয় ক্লেদ ও কুসুমের যোগনির্যাসই তাঁর তরিকা। নিকটাতীত এবং নিমনিকটের সমস্ত ক্ষরণ ও রক্তলাভার স্রোতে ভেসে যাওয়া বাংলাদেশ যেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর-সোহনপুর-ঝর্ণাতলা অঞ্চলের জলখেলির খরাধারায় আবহসঙ্গীত শোনায়। বাজিতপুর ও চট্টগ্রাম তাঁর বেড়ে ওঠা; বিকাশ এবং রূপকল্প রূপায়ণের রন্ধনশালার মালমশলা। একটি সুনিদিষ্ট জনগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণের শ্রেণী ফুটে উঠেছে তাঁর গ্রন্থে সমগ্রতাসহ। জেলেপাড়ার জীবন মনে করিয়ে দেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণকে। আর তাদের সংকল্পের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন বাউল-শান্তু-বৈষ্ণবদের সাধনামার্গ এবং টিকিধারী টর্চার সেলের সেনাকুঞ্জ। ‘হারুনকে নিয়ে একদা এক গল্প তৈরি হয়’ গল্পটি তাই একজন জাতপাতবিরোধী যুবকের করুণকাহিনি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের লাঞ্ছনাবিধুর রুদ্ধবীণার অন্ধকারে কাঁদন জেগে ওঠার কাব্যিক কথামালা। অথচ অনেকবেশি গদ্যনিষ্ঠ। কিছু গল্পে তিনি বর্ণনার পর বর্ণনায় সংলাপকে সংহার করেন। আবার আরেক মাত্রায় নিখুঁত নাট্যকারের মতো কথ্যবুলি, প্রবচন, কালোক্যাল বাকভঙ্গিকে ব্যবহার করেন ভাষা সংস্থাপনার্থে।
ভক্তিবাদী বাংলার মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি ক’রে গড়ে-ওঠা নকল মাজার ব্যবসার আড়ালে থাকা খুনী, নারী পাচারকারী, দেহব্যবসায়ী সমকামীদের বিশ্বস্ত-চিত্র তুলে ধরেছেন কথাকবি; তাঁর ‘অচিন রোশনাই’ গল্পে। যা থেকে বিশ্বাসী-মানুষ পেতে পারেন ‘সাধু সাবধান’ বাণী।
‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’ গ্রল্পগ্রন্থে নাম-গল্প থেকে শুরু ক’রে সমাপনী গল্প ‘এ তবে ছায়ার গল্প’তে পৌঁছালে পাঠক দেখতে পাবেন, নামগল্পে যে-যুবকমৃত্যু মিউজিয়ামে প্রবেশ করেছিল সেই মিউজিয়াম আসলে বাংলাদেম প্রান্ত এবং কেন্দ্র; স্থানিকতা ও অস্থানিক; শুধু ইউনির্ভাসাল এবং পার্টিকুলারের সহাবস্থান। একটি দেশকে দেখবার এবং দেখাবার এই ভঙ্গি বুঝাতে সক্ষম হয় যে, এটি কোন গ্রল্পগ্রন্থ নয়, বরং আদ্যোপান্ত একটি উপন্যাস। যে উপন্যসে সুনির্দিষ্ট কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই, নেই কাহিনির ধারাবাহিকতা। কাহিনির ধারাবহিকতা বইন করে ঐতিহাসিক কালপর্ব-পরম্পরা। যেখানে মৃত্যু ও রক্তের মিউজিয়ামে জার্নি করিয়ে লেখক এক পারগেটরিতে পৌঁছান। যা লেখকের এবং এই জনগোষ্ঠীর কাক্সিক্ষত-কাম্য সুধাস্বপ্ন। অনেকটা মহাভারতের অবয়বে ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’- ব’লে পাঠককে প্রস্তুত করা এবং কীভাবে, তা খতিয়ে-দেখানো এবং সবশেষে অনেকটা সশরীরে স্বপ্নসহ স্বর্গারোহনের ঈপ্সিত ইঙ্গিতবাহী উপন্যাস এটি। একাধিকবার এই গ্রন্থ পড়তে পেরে যে-রসাস্বাদন হলো তেমনান্দ পাবার আশ্বাস দিয়ে পাঠককে বলতে চাই, বাংলা কথাসাহিত্যে এটি নবসংযোজন। না-পড়লে বঞ্চিত হবেন কথাকবি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর বেহেশতবাসী হোন। খোদা হাফেজ।