বন্দনা
রজত বরণ অর্ধচন্দ্র আসমানের কোলে (আমরা) বন্দনা করি তারে, যে মন পবনে দোলে (দেখো) নৌকা যায় যায় রে। চন্দ্রালোকের নৌকা আমার দোরে আইসা হায় জলের উপর দেখো নৌকা ছলাৎ ছলাৎ যায় নৌকা যায় যায় রে। নৌকা আমার প্রাণের দোসর, নৌকা সখা ভাই রে এই দেখি আছে নৌকা, এই তো দেখি নাই রে নৌকা যায় যায় রে। জলে চড়ে ডাঙ্গায় চড়ে ক্ষণেক চড়ে মনে রে ধরতে গেলে দেখো নৌকা আসমানে দেয় উড়া রে নৌকা যায় যায় রে।
ধান্ধা লাগে। তাহার চোখে রঙের ধান্ধা। লাল এতো নিবিড় যে, নীল এতোই গভীর যে, তাহার চোখ মুদিয়া আসে। সূর্য মিয়াও আলো দেয় নির্দয়ভাবে। সওয়ার নিয়ে হাজারো বিজারে নৌকা ধেয়ে যায় নিকলী-দামপাড়া। তাহাদেরই বাদামের বর্ণচ্ছটায় আর সুরুজমিয়ার জ্যোতির ঠেলায় বার বার চোখ মুদিয়া আসে। মনে হইলো নাওয়ের পাল না, স্বপ্নের ঘুড়ি যায় সোয়াইজনীর ঘাটে। তেনারা কি তা’হলে জলঘুড়ি? ত্রিকালজ্ঞ বাবু যথার্থই ভাবিলেন— জলঘুড়ি। জলের উপর উড়ে, তাই জলঘুড়ি। জলঘুড়ি হোক আর পানিঘুড্ডিই হোক, তিনি সত্যিই চক্ষু মুদিলেন। তবে তাতে বয়ে যায় নি কিছু। আমার হাত বান্ধিবা, পাও বান্ধিবা, মন বান্ধিবা ক্যামনে? আমি চোখ মুদিবো, মুখ মুদিবো, কান মুদিবো ক্যামনে? আমার কানে যে ট্রলারের ভটভটি আওয়াজ খোঁচা মারে, টেপ রেকর্ডের গান মাইকের ভেতর থেকে আড়াই মণ ওজন হয়ে আমার কর্ণ কুহরে চেপে বসে। তবে শোনেন মশাই, জ্ঞানীরা বলেন মন বান্ধা সম্ভব না হইলেও মনের উপর পর্দা ফেলা যায়। আপনি কানে আঙ্গুল চাপা দেন, দেখবেন কেমন উঠে গেছে দেওয়াল। ঋষি তথাস্তু করিলেন।
চক্ষু মেলিয়া তিনি হেরিলেন জঙ্গলবাড়ি
রচক তোমার মুখে ছাই, পিঠে কিল, টাকে চাটি। আঁখি মুদিয়া কেউ দেখে নাকি কিছু?
তোমরা তো দেখ খালি চর্মচক্ষু দিয়া। মনের চক্ষু বন্ধ তাই সবুজকে দেখ কালো। যতোই তাকাও এক দৃষ্টে সম্মুখে আসলে দেখ না কিছুই। কারণ তোমাদের মানসচক্ষুর কপাট বন্ধ। সেইখানে তালা। তাই মনের দরজা খুলিয়া চর্মনয়নের দরজা ২টির খিল আঁটিতে হয়। তবেই সকলি হয় দৃশ্যমান।
তিনি দেখিলেন বাড়ি, জঙ্গলবাড়ি। জঙ্গল দ্বারা বেষ্টিত বাড়ি। জঙ্গল দিয়া নির্মিত বাড়ি, জঙ্গল কর্তৃক চিহ্নিত বাড়ি। মসনদে আলা ঈশা খাঁ, মর্জুবানে ভাটি১ ঈশা খাঁ গোঁফে ঘন তৈল মর্দন করিয়া কিঞ্চিৎ মুচকি হাসিলেন। কিন্তু তাঁহার বদন মোবারকে উৎকন্ঠার ছাপ, কপাল কুঞ্চিত।
কি হেতু?
লক্ষণ হাজোটার বড়ো বাড় বেড়েছে।
কে সে জন?
কোচ রাজা।
কোচ বংশীয় সামন্তের কি নেই বারভূঞার ভয়?
হয়তো আছে। কিন্তু হঠাৎই ঈশা খাঁ সামন্তরাজের রাজধানী জঙ্গলবাড়ি আক্রমণ করেন। অকস্মাৎ আক্রমণে লক্ষণহাজো প্রাণভয়ে দারা পরিবার নিয়ে পার্শ্ববর্তী সুসংরাজ্যে আশ্রয় নেন। জঙ্গলবাড়ি হয় ঈশা খাঁর করায়ত্ব। আর ঐ দিকে দেখ সুসংরাজ রঘুনাথ আশ্রয়প্রার্থী কোচরাজের পিঠে হাত বুলাইলেন। কহিলেন, বৎসে ভয় কি তব? দু’য়ে মিলে শীঘ্রই উদ্ধারিবো জঙ্গলবাড়ি। অল্পদিনের মধ্যে রঘুরাজ সত্যিই জঙ্গলবাড়ি উদ্ধারের জন্যে সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে এগিয়ে এলেন। সংবাদ পেয়ে মসনদে আলা ঈশা খাঁ নান্দাইল-নীলগঞ্জের মধ্যবর্তী স্থানে রঘুর সৈন্যকে প্রতিহত করেন। তুমুল যুদ্ধে রঘুরাজ পরাস্ত হয়ে জঙ্গলের দুর্গে বন্দী হন। তবে সুসংরাজের অবশিষ্ট সৈন্যদের চোখে মোটেও ঘুম নেই। তারা নদী নরসুন্দা থেকে খাল কেটে কৌশলে রঘুরাজকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। হ্যাঁ ভ্রাতঃ এইবার বুঝলাম এই খালটির নাম কেন ‘রঘুখালী’।
আরে থামো থামো। ইত্যবসরে হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ইতিহাসের পাতা কিছুটা উল্টে পাল্টে যায়। এ যে মধ্যযুগ গো! মুসলিম নবাব সুবেদার ভূস্বামীগণ নৌকা বাইচের আয়োজন করেন। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চলে নৌশক্তি রাজ্যরক্ষা ও রাজ্যজয়ের একমাত্র উপায়। তাই বাংলার বারভূঁঞাগণ নৌবল নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
মুঘলের বেটা হুমায়ুন-আকবর একের পর এক প্রমাদ গুনিলেন।
মহাপরাক্রমশালী মুঘলরাজ প্রমাদ গুনিলেন? অবিশ্বাস্য!
মোটেও নয়। কারণ এইখানে মগ আসিলো।
হার্মাদ দস্যুরা আসিলো।
তবে সকলেই মুঘল সুবেদারের সাথে যুদ্ধে পরাভূত হইলো। তাদের ছিলো ক্ষীপ্রতা ও কুশলী নৌ-পরিচালনার দক্ষতা।
দাদা এইবার রাখো তো। অনেক শুনলাম। পাতাগুলো একটু ঠিকঠাক করো।
হ্যাঁ, আবার ভাটির রাজা ঈশা খাঁ। তিনি নাও ছাড়িয়া দিলেন নরসুন্দা থেকে সোয়াইজনীর দিকে।
সোয়াইজনীর তীরে এক গোস্বামীর আখড়া। আর ঈশা খাঁর ছিপ নৌকায় আছে ষাট দার। তাই খাঁ সাহেবের নৌ বিহারে আসায় গোস্বামীর আস্তানা হয় ষাটদার আখড়া।
হেঁইও হায় যায়রে খাঁ সাহেবের নৌকা
ষাট মাল্লা দার বায় বৈঠা যে তার চৌকা
যাচ্ছি কোথায় যাবো কোথায় সোয়াইজনীর ঘাটে
দুই পাড়েতে চোখ তার মানবমেলা হাটে
বল হৈ রে হৈ...।
আর একবার হেরিলেন তিনি পরমা সুন্দরী
মূল গায়েন গাহিতে গাহিতে পশ্চাতে হাঁটেন। একটু পর একজন এসে তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে— ও দাদা, কর কি কর কি? তাকাইয়া আছ সামনে হাঁটিতেছ পিছনে? শুনলাম ভূতেরা পিছনে হাঁটে, তুমি কি ভূত?
না, তবে আমি ভূতের মতো অতীত দেখি। দুয়ে দুয়ে চার। এই তো হইলো চাইর শ বছর আগের কথা। চাইরে চাইরে আট, আট শ। আমি পিছনে হাঁটিয়া আট শ বছর পিছনে গেলাম।
কি দেখিলেন?
আর এক সামন্ত রাজা। দিনাজপুরের সামন্তরাজ ভুবন কৈবর্ত সেনবংশের নিকট পরাস্ত হয়।
তারপর?
তারা প্রাণভয়ে ছুটে আসে নিকলী ও তার আশেপাশে। তাদের সাথে যোগ দেয় স্থানীয় কৈবর্তের দল।
তারা কি একপাতে খায়?
না। দুই দল দুই দিকে যায়। হালচাষ করিয়া একদল হয় হালুয়া কৈবর্ত, মাছ-ব্যাঙ ধরিয়া একদল হয় জালুয়া কৈবর্ত। তবে উভয়েরই শত্রু হয় সাপ, বিষধর সর্প।
কারণ?
সে একই, জঙ্গল। নিকলী ছিলো জল- জঙ্গলাকীর্ণ।
তাহলে উপায়? ও গুরু উপায় বল না …।
উপায় একটাই, যাও মা মনসার কাছে, তারে ভজনা কর। পূজারী তা-ই করিল। সর্পদেবী মনসার বিগ্রহ উঠে আসে বাইচ-নাওয়ের অগ্রভাগে। এরই মধ্যে আরো হাজারো ঘটনা ঘটিলো। আসিলো হাজার পর্যটক, সিলেট থাইকা এগারসিন্ধুর, ইবনে বতুতা, আরো কত জনা। অবশেষে আসিল নিকলী-সুন্দরী।
সে কোন্ জনা?
এক পরমা সুন্দরী। বৈদেশ থাইকা দুই বন্ধু আসে সওদাগরী করতে নিকলী বাজারে। উভয়েই প্রেমে পড়ে তার। কারণ সে তো যে সে সুন্দরী না ভাই। আসমান থাইকা যেন চান্দের আলো গইলা গইলা পড়ে। সেই সুন্দরী প্রিন্টের ঘাঘড়া পইড়া যখন নদীর ঘাটে যায়, মনে হয় সারা শরীর হিজল ফুলে ঢাকা। কাছেই বান্ধা ছিলো দুই সওদাগরের নাও। তারা মুখ হা কইরা সুন্দরীর দিকে বেক্কলের মতো চায়। সুন্দরী কোমর দুলাইয়া ভরা কলস কাংখে নিয়া বিদায় হয়। সওদাগরের বেটারা সব কাম ফালাইয়া সুন্দরীর ধ্যানে মগ্ন থাকে। আর ঐদিকে তাদের ব্যবসায় দেখো লালবাত্তি কেমন পিটিশ পিটিশ জ্বলে। দুইদিন বাদে এই কথা সুন্দরীর কানে যায়। সুন্দরীর মনেও যে পিরীতের আগুন দাউ দাউ কইরা জ্বলে। হাজার হইলেও সওদাগরের পুত। কিন্তু সে স্থির করতে পারে না। নাগর যে দুইজন। সুন্দরী আরেকবার হিজলফুলের ঘাঘড়া পইরা নদীর ঘাটে আসিয়া দাঁড়ায়। তার কাঁচুলীতে শোভা পায় ফুটন্ত দুই কদমফুল।
হে আমার পিরীতের দোসরগণ।
বলো বলো সুন্দরী।
তোমরা নাকি দুইজনেই আমারে পাইতে চাও?
হ্যাঁ সুন্দরী।
কিন্তু এক নারী তো দুইজনের হইতে পারে না।
তা হইলে উপায়?
বাহুতে কি আছে জোর তোমাদের?
কেন, বলো তো সুন্দরী?
সওদাগরের ঘরে জন্ম তোমাদের। সারাদিন খালি টাকা গুন। দুনিয়া জানে তোমাদের আঙ্গুল বড় শক্ত, বাহুর খবর আমরা জানি না।
আছে আছে সুন্দরী, বাহুতেও বল আছে বড়। কও কি করতে অইবো?
আমারে পাইতে হইলে বাহুতে বল দরকার। একথা বলতে না বলতেই দুই দিক থেকে দুই সওদাগরের নৌকাগুলো যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উভয়পক্ষের বৈঠাগুলো বায়ুতে ঠক্ ঠক্ আওয়াজ তোলে। এরা কি লাঠিয়াল, না বৈঠাল? খানিক পর নিকলী সুন্দরীর আঙ্গুল ইশারায় ওরা যুদ্ধে ক্ষেমা দেয়।
রাখো তোমাদের বৈঠালগিরি। আমারে পাইতে চাও, কর তবে বাইচালগিরি। যে জিতবে, সে পাইবে আমারে।
চারদিকে সরগরম তুলে আয়োজন হয় এক বাইচ খেলার। দুই নৌকার কান্ডারী হয় দুই সওদাগর। কারণ, এ যে বাহুবলের পরীক্ষা। কিন্তু হায় কপাল আমার! কেউ কাউরে হারাইতে পারে না। সুন্দরীকে পাওয়ার জন্য দুই সওদাগরই জীবন বাজী রেখে বৈঠা মারে। অবশেষে দুইটি নৌকার গলুই যখন একযোগে সোয়াইজনী ঘাটের ভিজা মাটিকে ছিদ্র করে অর্ধেক ঢুকে যায়, দুই সওদাগর তখন বেসামাল ধাক্কা খেয়ে নদীতে ছিটকে পড়ে। তাদের আর হুঁস থাকে না। তাদেরকে আপনাপন লোকজন নদী থেকে তুলে আনলে সুন্দরী তাদের চোখ তুলে তাকানোর আহ্বান জানায়।
বুঝলাম তোমরা দুইজনেই মরদ বড়। এইবার তবে যাও। তবে মনে রাইখো- প্রতি শ্রাবণ সংক্রান্তির পরের দিন আমি বরণমালা নিয়ে এই ঘাটে অপেক্ষায় থাকবো। যে বাইচ খেলায় আমাকে জিতে নিবে তার গলায়ই আমি পরাবো এই বরণমালা। এইবার তবে বানিজ্যেতে যাও।
গানা-বাদ্য-নৃত্য-খেউড়
শ্রাবণ সংক্রান্তির দুই মাস আগেই পড়ে যায় চিড়া-মুড়ি কুটার ধুম। সংক্রান্তির রাতে মনসার বিগ্রহ উঠবে। মায়ের পূজা হবে। শোন পুন্যবান, এই আয়োজন তো কোনো ধর্মের নয়। ধর্ম নির্বিশেষে সকলেরই ঘরে সোমত্ত কইন্যারা কোমর দোলাইয়া গান গায়।
ঢেঁকির পার আর চিড়া-মুড়ি কুটার ধাপ্পুর ধুপ্পুর শব্দে বাতাসে ঘূর্ণন তৈরি হয়। সেই ঘূর্ণিবায়ু জলেও ঘূর্ণন তোলে। ঘোড়াউতরা-নরসুন্দা-সোয়াইজনী নদীর মিলনস্থল ত্রিমোহিনী, নিকলী গাঁইয়ারা কয় ‘তেমোনি’। এই ত্রিস্রোতের জল ঘূর্ণনে যে কুঁড়ের সৃষ্টি তা-ই ‘পাগল ধবলা’৩। পাগল ধবলার জল মূর্ছনা যে উঠে আসে নর্তকীর নূপুরের নিক্কনে। হিলচিয়া বাজারের পাড়া থেকে বাবুরা নর্তকীদের তুলে আনেন নিজ নিজ নৌকায়। রাতের আসমান ছেয়ে থাকে কালো মেঘে। এই মেঘ জল না ঢেলে আগুনের হলকা ঢালে। ছইয়ের ভেতর মেয়েটি গান গায় আর ঘামে। পেট্রোম্যাক্সের আলোয় তার ঘর্মবিন্দু মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করে। হার্মোনিয়ামের রীডে তার সদা চঞ্চল অঙ্গুলিগুচ্ছের নাচন ও ঝিলিমিলি চুড়ির রিনিকঝিনিকে বাবুদের চোখে ঘোর লাগে। মেয়েটি গায়:
দেখো ফুল বাগানে কতো সঙ্গোপনে আহা ইরানী গোলাপ আজ ফুটেছে যখন তুলে নিতে পারো তারে চায় যদি মন।
গান শুনে চুপি চুপি পাশের নৌকাটি আরো নিকটবর্তী হয়। নতুন গান শোনার জন্য বাইচালরা কান পেতে থাকে। কিন্তু রাতের স্তব্ধতার মতোই গান যেন থেমে আছে। এ মুহূর্তের জন্যে চরাচর নিস্তব্ধ। অন্যান্য নৌকায় পেট্রোম্যাক্স ও হারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলে। নতুন সঙ্গীতের কোনো সম্ভাবনা না দেখে একটি ছেলে ছইয়ের উপর বৈঠা আছড়ে ফেলে। তাতে বাবুদের গাত্রে শুরু হয় অনলের দাহকর্ম। একজন বাবু নেশায় চুর হয়ে বসেছিলেন, নৌকার কম্পনে তার জড়তা কেটে যায়। তিনি আড়ষ্টকন্ঠে বলেন, কে রে শালা? একজন জবাব দেয়, বাবু আমরা, গান শুনতেছিলাম। কিন্তু মেয়েগুলোর জবাব হয় অন্য রকম। মূল গায়নকারিণী আড়মোড়া ভেঙে নিশি লাগাতার বুক চিরে ফের গান ধরে:
মাইঝ রাইতে ঘরের দরজায় টোকা মারে কে? ফিসফিস কইরা ডাকে, ভাঙা বেড়ার ফাঁকে এমন কান্ড করে কি গো কোনো মানুষে? মাইঝ রাইতে...।
এমন সময় একটি দমকা হাওয়া এসে সকলেরই প্রাণ শীতল করে দেয়। মানুষগুলো যেন জলে গাবানো ভাসমান মাছের মতো একযোগে চিলিক দিয়ে উঠে। আর এরূপ স্বস্তিকর মুহূর্তে বাজারী মেয়েদের ধরে রাখাই মুস্কিল হয়। রেখা নামের মেয়েটি ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে তৎক্ষণাৎ। আয়েশের আতিশয্যে সে ঘুঙুর পায়ে নায়ের পাটাতনে গোড়ালী ঠুকে। বাতাস তার ঘাম চেটে নেয়। তবে তার এ কৃতজ্ঞতা সন্দেহাতীত ভাবে কোনো মানবের প্রতি নয়। পবন দেবতার উদ্দেশ্যেই সে আসমানের সুবর্ণরেখার দিকে মাথা তুলে চায়। দমকা বাতাসে তার বসন খসে পড়ে। কিন্তু তার সামনে প্রকৃতই কোনো দেব নাই, এইখানে বসে আছে মানবের হাট। তাই তার কন্ঠ থেকে নিঃসৃত হয় বাজারী সংগীত:
জাগাইও না বন্ধু জাগাইও না কাঁচাঘুমে জাগাইলে পরে বন্ধু কথা কইব না, বাটাভরা পান আছে খিলিভরা চুন বালিশের তলে সিগারেট আছে বন্ধু পিরিতের আগুন।
এই নাওগুলোর মালিক কিছু মুসলমান, মাহিষ্যদাস চাষী পরিবার ও কৈবর্ত সম্প্রদায়। তবে কৈবর্তদের নাওয়ের মাল্লাদের গতর দর্শনীয় বস্তু। গতর তো না, যেন কালো পাথরে খোদাই করা মূর্তি। রাতের বেলায় এই মূর্তি দর্শনে মানবের সত্যিই ভ্রম হয়। এই ক্ষণে রেখার সঙ্গীতে সবাই সম্বিৎ ফিরে পায়। ঢোল ও খোল করতালের আনন্দবাদ্য উচ্চ গ্রামে উঠে। তবে যাহারা গানবাদ্য কিছুই করে না, তারা স্বরচিত পদের অশ্লীল কাব্য বুনে। অকথ্য খিস্তি খেউড়ে সকলে মজা লুটে নেয়। এইভাবে যেন তারা নিশিযাপনের মওকা খোঁজে। ১লা ভাদ্রের আরো একদিন বাকী, তার আগের রাতেই নৌকা বাইচের এইহেন প্রস্তুতি চলে। রাতের অনিবার্য অনুষঙ্গ কৈবর্তের পাথুরে মাল্লারা ছলাৎ ছলাৎ বৈঠা মেরে একবার গোবিন্দপুর গোরক্ষনাথের আখড়ায় যায়, আর একবার যায় ষাইটদার আদুরীনাথ গোসাইয়ের আখড়ায়। আধো আলো অন্ধকারে আখড়া মঠের চূড়ার দিকে তাকিয়ে তারা আশীর্বাদ মাঙ্গে। গোসাই জী কি, জয়!
ঘাটুর ঘাটে
ঐ দিকে মেয়েদের বাপের বাড়ি নাইওরী আসার বিরাম নাই। তারা এসেই বাপের বাড়ির মা-চাচীদের গিরস্থী কামের হাল ধরে। তারা চিড়া কুটে, মুড়ি ভাজে, আর বাইচালদের মধ্যে বিতরণ করে। এক একটা দৌড়ের নাও ঘাটে ভিড়লেই তাদের পান বাতাসা দিয়ে সম্মান জানায়। তবে কিনা এই সব মাইয়ারা আবার ঘাটুর পাগল। তাদের ডাকে ঘাটু আসে। ঘাটু নাই তো কি, আসে পাল্লা গানের নাও, সঙের নাও, কিম্বা পালা গীতাভিনয়ের নৌকা। তবে ছেলেরা কিভাবে নারী সাজিয়া গীতবাদ্য বাজায় তা’ দেখার বিষয়েই বাড়ির মেয়েদের পক্ষপাতিত্ব। নৌকা আসে আর লন্ঠনের আলোয় পাটাতনে শুরু হয় ঘাটুদলের নাচ, মুখোশধারী সঙের অভিনয়, পালাগান। তার সাথে যন্ত্রী বাজায় ঢোল, খঞ্জুরী, কাঁসার বাদ্য। ঘাটু বালক আখিল জিলু ও তার দল এসে একে একে গায় আসর, ভজন, সালাম, সাজন, গেরী, বংশী, গোষ্ঠ, জলভরা, জলরূপ, ফুল তোলা, কুঞ্জ সাজানো, নিদ্রা, স্বপন, কোকিল, বিচেছদ, ভার মধুমাস, সখী সংবাদ ও সন্ধ্যা। তারা চুলে খোপা বেঁধে রঙিন রুমাল উড়িয়ে রাধিকার চটুল নৃত্যে সকলের মন যোগায়। এ গান রাধা কৃষ্ণের প্রেম বিরহের হলেও এইখানে প্রেমও নাই, বিরহও নাই— আছে আনন্দ, কেবলই আনন্দ, নিকলী গেরাম আজ আনন্দলোক:
পালং সাজাও ও প্রেয়সী গো আসব লো তোর মন্দিরে গুয়া কাইটো কুচি কুচি রং দিয়া বানাইও বিড়ি বিড়ি খাইয়া ঢালবো গো পিচকিরি তোমার বাঁকা যৌবনে।
অবগুন্ঠন ভেদ করে একটি মেয়ে গলা বাড়িয়ে ছুড়ে দেয় তার আবদার- ও জিলু ভাই ‘চেংড়া বন্ধুরে’ গাইলা না?
চেংড়া বন্ধুরে ঘর তুইল্যা দে নদীর কিনারে ঘর তুইল্যা দে নদীর কিনারে ঘর তুইল্যাছি গো সারি সারি চতুর্পাশে টিনের দেউরী সেই ঘরেতে একলা বাস করি সেই ঘরেতে একলা বাস করি ওগো চেংড়া বন্ধুরে ...।
এসব চটুল সঙ্গীতের পর ঘাটুদল কবিওয়ালা দাশুরায়ের বাণীতে প্রবেশ করে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলায়। কৃষ্ণ ধীরে ধীরে খেয়া নৌকা আনিয়া পাড়ে লাগাইলেন। কিন্তু নদীর পাড় আর নৌকার গলুইয়ের মধ্যে আছে এক ফারাক। গোপবালাগণের সঙ্গে তাঁহার এক গোপন কথা আছে। ষোড়শী ব্রজ যুবতীগণ পুষ্পের ডালা হাতে নিয়া যমুনার রজত সৈকতে দন্ডায়মান, চন্দ্রমন্ডল যেন যমুনার খেয়াঘাটে বহুখন্ড হইয়া নামিয়া আছে।
ষোল বছরের যুবতী/তোমরা যত রসবতী নদীতে আজ তুফান ভারী/একেই আমার জীর্ণতরী তাইতে আমার বিষম ভয়/তরীতে ভর নাহি সয় উলঙ্গ হয়ে যত ধনী/তীরে রাখে বসন খানি তাতেও কিছু পাতল হবে/তরীতে মোর ভর সহিবে।
এমন ধারা বচন শুনিয়া রাধা ও তার সখিগণ রাগে লজ্জায় অপমানে লোহিতবর্ণ ধারণ করিলো।
ছোট লোকের বড় কথা/প্রাণে বড় বাজলো ব্যথা নৌকাতে আর না উঠিব/সাঁতরে নদী পার হইব খেয়ামাঝির বেহায়াপনা/চাইলে দিতাম কানের সোনা কোন মুখে চায় যৌবন দান/পয়সা না নেয় নিবে ধান এক পয়সার খেয়ানী/তোর কেন এত ফোটানী? হাঃ হাঃ হাঃ।
একজন চাকুওয়ালা মাস্তান হাতে লাল রুমাল নিয়ে এসে জলের উপর দেয় লগির বাড়ি। এই শালা বানচোতের দল, বন্ধ র্ক গান বাজনা। তরার ত এই ঘাটে গান গাইবার কথা আছিল না। তরা গান গাইবি লালুর ঘাটে। সেইভাবেই বায়না করা অইছিলো।
বায়নার টেকা এহনও পাই নাই।
ও, টেকার লাইগ্যা এইখানে? বেশ্যারার মত নগদ চাও।
আরে না, তা’ অইবো ক্যারে? খালি না সইন্ধ্যা বাত্তি লাগছে। ভাবতাছি নিশি লাগার আগে আগে ছেড়িরারে কিছু গান শুনাইয়া নেই।
তুমরা কি জান না ‘কারার বাড়ি’তে গান গাওয়া নিষেধ? সোনামিঞা শুনলে সুনা কাইট্টে ফালাইবো।
ইত্যবসরে মেয়েছেলেগুলো এখান থেকে অন্তর্হিত হয়। দু’একজন জোয়ান ছোকড়া ছাড়া এ পাড়ার আর কেউ এখন নেই।
চল্ চল্ তাড়াতাড়ি লালু মিঞার ঘাটে চল্। সকলেই পিঁড়ি চাটাই পাইত্যা বইয়া রইছে।
শুন শামসু ভাই, কারার বাড়ি থাইকা কুনু জিনিস না কইয়া নেওয়া বড় দুঃসাহস। এর খেসারত তুমার দিতে অইবো।
আরে এমুন জিনিস নিতে আইলাম যার জন্য কারো ঠেকা নাই।
হ, খালীজঙ্গলে ঘাটাস বাঘ অইলা।
মুখ সামলাইয়া কথা ক’ পুঙ্গির পুত।
আরে যা’ যা’ মাঙ্গির পুত।
দুইজনের আর তর সয় না। একজন আর একজনকে কুড়াপাখির মতো প্যাঁচিয়ে ধরে জলে ঝাপ দেয়। এই সমস্ত শোরগোলে বড়বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা এগিয়ে আসেন। অপমানের ভয়ে ঘাটুর নৌকাটি ঘাট ত্যাগ করে গাঙ্গের প্রায় মাঝখানে এসে পড়ে। শামসু মাস্তান সাঁতরে এসে নৌকায় ওঠে। পাড়ের ছেলেটিকে বাড়ির লোকেরা চড় থাপ্পর আর ধমক দিয়ে তুলে নিয়ে যায়।
শামসু ভাই, তুমি যাও, আমরা আসতেছি।
তাড়াতাড়ি নাও ভিড়া।
শরীল ত ভিজছেই। তুমি সাঁতরাইয়া যাও লালুর ঘাটে। অত গরম গরম আমরা যাইতে চাই না। একটু নিশি লাগতে দেও। সবারই মঙ্গলের জন্য কই।
শামসু আর কথা না বাড়িয়ে সাঁতরে তীরে ওঠে। ঘাটু বালক নেপাল আর রতন। আখিল জিলুকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করায় মেতে ওঠে। তারা অনেকটা ফিস্ফিস্ করেই বলে, কিরে জিলু তর ত দেখি মুচ উঠতাছে। ডিমান্ড এইবার কমবো তর।
কি আর করুম, বয়স রে ত ধরা মুস্কিল, ছাগলের বাচ্চার মত গাছের গোড়াত তারে বান্ধা যায় না। সে ত খালি লাফায়, ছাগল থাইক্যা শিয়াল অয়, তর তর কইরা গাছের মগডালে উঠে।
বেলেড দিয়া মুচ চাইসা ফালা।
না, ফের উঠবো। তার চাইতে লোমনাশক দে। নিকলী বাজারেই পাওয়া যায়। হাঃ হাঃ হাঃ।
ঘাটু দলের ছেলেরা আবার গান ধরে। তখন চারধারে নিরবতা।
কে দিলো পিরীতির বেড়া আমার লিচুর বাগানে লো সই লিচুর বাগানে ছোট ছোট লিচুগুলি আমার মুখে বধূ দেয় তুলি আমি দেই বধূর মুখে...।
শুন কই মজার কথা, আলোমতি প্রেমকুমারের দলের গানে আলোমতি সাজছিলো আখিল জিলুর মতো এক সুন্দর পোলা। সারা রাইত দলের গান শুইনা সমঝদারের দল নেশার মত চুর অইয়া থাহে। কেউ বুঝতেই পারে না, হে পোলা না মাইয়া। ইস্কুল ঘরের সামনে প্যান্ডেলের বেড়ার যে বাঁশটায় ধইরা আলোমতি সারা রাইত গান গায়, পরের দিন সকালে সেই বাঁশ লাখ টেকার ডাকে ওঠে। কেডা নিবো কেডা নিবো, এই নিয়া তুমুল কান্ড। আর গেরামের মাতবরের পোলা দৌড়াইয়া যায় আলোর লগে দোস্তি পাততে। কিন্তুক তারে পাইলে ত। ভোরের আলো ফুটবার আগেই প্রেমের আলো উধাও। গেরামের পোলাপান মঞ্চ ভাঙে আর গান গায়, আমি আলো চলছি একা বাইয়া….। আর গাঁয়ের রাখাল তো পায় কৃষ্ণেরই স্বভাব। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী উম্মে কুলসুম ইস্কুলের বারান্দায় পা দিলে রাইতে শোনা দলের গান রাখাল তার কন্ঠে তুলে আনে:
জল খাইতে গিয়াছিলাম দীন ভিখারীর বাড়ি, কে জানি জল আইনা দিলোরে বন্ধু মানুষ কিনা পরী রে....।
উম্মে কুলসুম শুনেও না শোনার ভান করে কোনোমতে শ্রেণীকক্ষে সেঁধিয়ে যায়।
নৌকা আর দাঁড়াশ সাপ, দুই ভাই আসে
যে নৌকাটি গত কয়েকমাস যাবৎ ব্রজলাল সূত্রধরের বাটাল ও রাম দায়ের চাটান এবং হাতুরীর ধুন্দুমার পিটুনী খেয়ে খেয়ে নিজেরে প্রস্তুত করে, সে একটু পরেই জলের উপর গুত্তা খেয়ে নামবে। তার শরীর এখন টান টান। দাঁড়াশ সাপের মতো শিরদাড়া সোজা। প্রদোষ মাস্টার এসে কিছুক্ষণ পর পর তদারক করে যান। ইহা নির্মাণের আগে ব্রজলাল প্রতিটি তক্তার কাছে জ্বলন্ত কুপিবাতি এনে রেখেছে। যখন যে কাঠের কাছে বাতি নিভে যায়, সেই কাঠ আর সে নৌকা নির্মাণে ব্যবহার করে নাই। ‘দোষী’ বলে কাঠটি পরিত্যক্ত হয়েছে। লোকদের ধারণা এতে আছে জ্বীনপরী দেও দানবের আছর। না হলে বাতি নিভবে কেন? তখন এ বাতিল করা তক্তাটির স্থান হয়েছে মা-বোনদের চুলার গহ্বরে।
একদিনের এক মজার ঘটনা। মাষ্টার বাড়িতে সেই দিন জ্বালানী নাই। রান্নার সময় হয়ে আসে। গিন্নী-মা কাজের ঝিকে পাঠায় ব্রজলালের কাছে। সে এসে ব্রজলালকে অনুরোধ করে একটি বাতিল কাঠ চিড়াই করে দিতে। ব্রজলাল বলে, আমার কাছে সকল কাঠই ভালো, আপাতত কুনু দোষী কাঠ নাই। ইচ্ছা হয় এই ¯তূপের উপর বাতি ধইরা দেখতে পারো। হুকুম পেয়ে কাজের বেটি সমস্ত তক্তার ¯তূপকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে একটাও দোষী কাঠ পায় না। বাইরে এ সময় কোনো বাতাস নাই যে, এমনিতেই কুপিটা নিভে যাবে। কিন্তু ঐ বেটি নাছোড়বান্দা। তাকে রান্না করতে হবে। ঘরের সকল জ্বালানী পুড়ে শেষ হয়েছে। বাইরে যা-ও কিছু পড়েছিলো তা’ গত তিনদিনের একটানা বিষ্টিতে ভিজে জবজবা হয়েছে। সে বলে সূত্রধরকে- ও ব্রজলাল দা, আমি তুমার গত ১ দিনে নৌকায় লাগানো তক্তাগুলা পরীক্ষা করবো, বাতি নিভলে কিন্তু খুইলা দিবা। ব্রজলালের অন্তরে ছিলো আত্মবিশ্বাসের প্রাচীন দেয়াল। এইখানে ধস নামে না। তাই সে নির্দ্বিধায় মেয়েটিকে সংযোগ দেয়া কাঠ পরীক্ষা করার অনুমতি দান করে। মেয়েটি অভয় পেয়ে একটা দুইটা কাঠের কাছে কুপি ধরতেই কোনো না কোনো কারণে কুপিটা নিভে যায়। কাঠটি দোষী হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। ব্রজলাল সূত্রধরকে বাধ্য হয়েই অনেক কসরত করে একটি তক্তা খুলে লাকড়ি বানিয়ে মেয়েটির হাতে তুলে দিতে হয়। তাতে মেয়েটি লাগাতার ভাবে সকলের আহার জুগিয়ে যাওয়ার ব্রতকে সমুন্নত রাখতে পারে।
কিন্তু এতে করে ব্রজলালের মনে খটকা লাগে। কি করে তা’ সম্ভব? সে তো নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে সকল আচার অনুষ্ঠানই পালন করেছে। সেদিন ব্রজলাল বিশ্বকর্মার উদ্দেশ্যে, তার ভাষায় ‘বিষকরম’ এর নামে ভক্তি ও পূজা অর্চনা করে। এ পূজায় তার সকল সহযোগী মিস্ত্রীও অংশ নেয়। আম্রপল্লব শোভিত ঘট ও মিষ্টান্ন, কলা, বাতাসা- এসব ভোগ সামগ্রিতে পূজাস্থান ঝলমল করে ওঠে। দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলে এ আচার অনুষ্ঠান। বিশ্বকর্মা দেবশিল্পী। তারা জানে বিশ্ব নির্মাতা, অলংকারের স্রষ্টা, দেবতাদের বিমান গঠক। যে লংকা নগরী নিয়ে আজ লংকাকান্ড বাঁধে তা বিষকরমেরই সৃষ্টি। সকল শিল্পী ও নির্মাতার মতো ব্রজলালরা বংশ পরম্পরায় বিষকরমকে মনে করে এসেছে পরম গুরু। কিন্তু কেবল নৌ-নির্মাণের আগেই নয়, নির্মাণ কর্ম শেষ হলেও তারা এ ধরনের পূজা অর্চনা করে থাকে। এসব ভাবতে ভাবতেই ব্রজলাল সূত্রধরের হাতে প্রদোষ মাস্টারের নৌকা নির্মাণকর্ম সাঙ্গ হয়।
বাঘ সাজিল রে, তর্জন গর্জনে বাঘ সাজিল রে- উত্তরে শিউরে বাঘ দক্ষিণে লেঙ্গুর সাবের পুতে ধইরা রাখছে দোনালী বন্দুক।
ষাটধারের সূত্রধরেরা বিদায় হলে এবার আসে দামপাড়ার কুমার ঈশ্বর। কুমারের হাতে আছে ঈশ্বরের ছোঁয়া। তাই ঈশ্বরের হাতে তারা নৌকা অলংকরণের কাজ করে। তা’ ছাড়া শ্রাবণ সংক্রান্তির আগের রাতে মানুষের উঠানগুলো জুড়ে থাকে মা মনসার মূর্তি, পঞ্চনাগের ক্ষুুদ্র ক্ষুুদ্র বিগ্রহ। কুমার নারায়ণ আচার্য ভক্তি ভরে মা-মনসার মুখে রঙের তুলি বুলায়। তার আছে নানা রঙের কৌটা আর তিশির তেল। নারায়ণ মায়ের ঠোঁটে এঁকে দেয় লাল আঁচড়। মায়ের দুই দিকে দুই নাগিনী, পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। তবে ঠোঁটে লাল আঁচড় কাটতেই মনে হয় বুঝি বা নড়ে উঠবে বিষহরি।
‘জয় বিষহরি গো, জয় বিষহরি, চাঁদবেনে দন্ড দিলো তোমার কৃপায় তরি গো।’
নারায়ণ নয়া নাওয়ের দুইপাশে এঁকে দেয় কটিঘর, তাতে নানা রঙের পদ্মফুল, দুই গলুইয়ের নিচেই বড়ো বড়ো চোখ, বৃক্ষ লতাপাতার ছবি, বাঘ সিংহ ঘোড়া, পক্ষি, পরী, মৎস্য, হংস আর পুষ্পমাল্য। মনপবণের নাও। নইলে কি এতো দ্রুতগামী? চোখের নিমিষে মাইল কে মাইল পার হবে। সাপের মতো মেরুদন্ড সোজা করে। পেছনে চোখ আঁকা থাকলেও এ চোখে সে তাকায় না। তার যে পিছনে তাকানো বারণ। নিমপাতার জল, ধুপধোয়া আর সোনা রূপার জল ছিটিয়ে পবিত্র করে, লোকেরা ডাঙ্গা থেকে জলে নামিয়ে দিলে সামনের অনন্ত চরাচরে সে চোখ মেলে ধরে। এই তো কেবল প্রস্তুতি। তাকে আগাতেই হবে। কখন যে গন্তব্যে পৌঁছবে কেউ বুঝতেই পারে না। দু’পাশের সারিবদ্ধ মানবকুল বিস্ময়ে চোখ বড়ো করে। ভাবে বিধাতার দান নয়ন বুঝি সার্থক এই ক্ষণে। গো বৎস যেমন ভূমিষ্ট হয়েই এক চক্কর লাগায় সারা পাড়া জুড়ে, এ নৌকাও তেমনি এক চক্কর দেয় সারা থলা জুড়ে। আহারে দৌড়ের নাও, ক্যামুন কইরা বাইয়া যাও, আমারে নিয়া যাও!
সোনার বান্ধাইলা নাও পিতলের গুড়া, পিতলের গুড়া ও রঙ্গের ঘোড়া, দৌড়াইয়া যাও রে...।
প্রদোষ মাস্টারের হাত ইশারায় নৌকাটি মাঝপথে থামে। দুলাল চেয়ারম্যান আর কফিলউদ্দিন এসে মাস্টারকে বাহবা দেয়। উভয়েরই কথা এক- অতো সুন্দর নাও অনেকদিন পরে দেখলাম মাস্টার, বানাইছে কেডা?
প্রদোষ : আর কেডা? আমরার ব্রজলাল মিস্ত্রী।
দুলাল : এই বুড়ার হাতে এখনও কত সৌন্দর্য।
কফিল : এরেই কয় নয়ার নয় গুণ, পুরানের আঠার গুণ।
দুলাল : মাস্টার, নৌকা ত গড়াইলা, এলাকার ইজ্জত থাকলেই অয়। আমরার নৌকা বাইচ ৫০০ বছরের পুরানা। এর লগে জড়াইয়া আছে নিকলী গেরামের মান সম্মান। তুমি ত নৌকার মালিক, কুনু রহম বিবাদের আশংকা থাকলে কও।
প্রদোষ : না চেয়ারম্যান সাব, আমার জানা মতে সব ঠিক ঠাক আছে। তবে আইন শৃঙ্খলার ব্যাপারে আপনে কফিলউদ্দিনরে জিগাইতে পারেন।
কফিল : এইবারের ব্যবস্থা আরো পাকাপোক্ত চেয়ারম্যান সাব। ৭ দিন ধইরা কমিটির লোকের ঘুম আর খাওন দাওন হারাম। খালি থলা ঠিক করে আর ভলান্টিয়ার বদলায়। শেষ পর্যন্ত দিছি সব কলেজ ইনিভারসিডির পোলাপান।
দুলাল : আরে তারার ত রক্ত গরম। কুন সময় কি কাম কইরা বয় কেডা জানে? তা’ ছাড়া ওরা কি সব বাড়িতে আছে?
কফিল : কি কন চেয়ারম্যান সাব, গত রাইতের মধ্যে সবারই বাড়ি ফিরা সারা। বাকি আছিলো তানসেন, শুনলাম সেও আইজ সকালে একদল বন্ধু লইয়া বাড়ি ফিরছে। ঐ দিকে সুমন মিয়ার দল সপ্তাহ ধইরা মুচে তা দেয়। গচিহাটা থাইকা আইছে টুটুল। আপনে কুন চিন্তা কইরেন না, ভলান্টিয়ার বাহিনীতে সব ধরনের মানুষই আছে।
দুলাল : শুন, যুগ এহন পাল্টাইয়া গেছে। আগের মজা এখন আর নাই। কি মাস্টার, তুমি কিছু কওনা ক্যারে?
প্রদোষ : কি আর কইয়াম। নৌকা বাইচে নিকলীতে এহন আর একটা মেলা বয় না। আর উৎসব শেষ অইয়া যায় ১/২ দিনের মধ্যেই। বাপ দাদার কাছে শুনছি পুরস্কারের লোভ ছাড়াই শত শত নৌকা আসতো বাইচ করার লাইগ্যা। কে জিততো কে হারতো, তার কুন ঠিক ঠিকানা ছিলো না। হাইরা গেলেও আনন্দ ছিলো। তারা আসতো ঠিক পয়লা ভাদ্রতেই। আর এহন মন্ত্রী মিনিস্টাররে আনবার লাইগ্যা এই তারিখটাও আমরা ঠিক রাখবার পারি না। তারার সময় মতো এহন ঠিক করা অয় বাইচের তারিখ। এইটা কি ঠিক কন চেয়ারম্যান?
কফিল : শুনেন মাস্টার সাব, কমিটির লুক হিসাবে কই। পুরস্কারের টেলিভিশন কিম্বা টেপ রেকর্ডার বাইচালদের হাতে তুইলা দিতে গর্ব হয় ঠিকই, কিন্তুক মন ভরে না। খাশীর পলট খেইল দেখার মজাই আছিলো আলাদা। ষাঁড়ও পুরস্কার দেওয়া অইতো। আমার মনে আছে ছোড বেলার কথা। বাওনবাইড়ের এক বিজয়ী দলরে সুন্দরবন থাইকা আনা হরিণ পুরস্কার দেওয়া অইছিলো। কী সুন্দর হরিণ! সেই কথা জীবনে ভুলতে পারি না। আর ইয়া বড়ো পিতলের ডেকচি পুরস্কার পাইয়া নরসিংদীর দল তা’ ঢোলের কাঠি দিয়া বাজাইতে বাজাইতে ঘরে ফিরে। সারা পথে কতো আমুদফূর্তি!
দুলাল : তবু প্রদোষ সরকাররে ধন্যবাদ যে, বহুকষ্টে সে নৌকা বাইচের স্মৃতিডা এহনও ধইরা রাখছে, কেবল লাউন্দ-করগাঁও কুনু কতা না, সে এহন সারা কটিয়াদি-নিকলীর গর্ব। আমরার সকলের সম্মিলিত স্বপ্ন মাস্টারের চোখে মুখে খেলা করে, ঠিকরাইয়া পড়ে।
প্রদোষ : চলেন চেয়ারম্যান। এইবার যাত্রার আয়োজন করি।
উভয়ে : চলেন, চলেন।
পরথমে কাটিলাম বৃক্ষ, মন পবণ নাম হায়রে মন পবণ নাম তারপরে গড়াইলাম মাস্তুল, কাটিয়া এক ধাম হায়রে কাটিয়া এক ধাম। ইন্দ্রিয়ের গজালে ঠুইকা দিলাম তারে জুরা গাং শালিকের মতো নৌকা দিতে চায় যে উড়া।
যে নাও প্রদোষ মাস্টারের অঙ্গুলি হেলনে এতোক্ষণ থেমে ছিলো তা ধীরে ধীরে পাড়ে এসে লাগে। প্রথম জলযাত্রার নিমিত্ত তারা কোনো এক ভাগ্যবতীর জন্য ইতিউতি করে তাকায়। লাবন্যময়ী লিলির জানা ছিলো যে, এ কাজে শেষ পর্যন্ত তারই ডাক পড়বে। সেই কারণে তার প্রস্তুতির কমতি ছিলো না। সে উত্তমরূপে সাজগোজ করে কপালে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে অপেক্ষা করছিলো যাত্রা-আচারের জন্য। তার হাতে একটি কাঁসার থালা। থালায় সাজানো ধান দুর্বা চাল তেল সিঁদুর আম পাতা ও একটি ছোট্ট ঘট। নায়ের বাইচালরা পোতাগ্র ঘুরিয়ে কিনারে আনলো। লিলি এর উপর স্থাপন করে তার সাজানো থালা। চারদিকে সুঁইপতন নিস্তব্ধতা। লোকেরা গলুইয়ে জল ছিটিয়ে আর দুধ লেপে সম্পন্ন করলো যাত্রারম্ভ। তারপর বেধে দেয়া হলো লাল সালু ও নতুন গামছা। লিলি থালা হাতে পুনরায় পাড়ের উপরে উঠে দাঁড়ালো। বাইচালরা জলদেবীর উদ্দেশ্যে গেয়ে উঠলো: মাগো জল্লাই জল্লাই!
কেউ কেউ স্মরণ করে পানিপীর খোয়াজখিজির কিম্বা বদর পীরের নাম।
যাত্রাকালে লও আল্লার নাম ওরে সাধু ভাই, ভাইরে যাত্রাকালে লও আল্লার নাম কি যাত্রা ছড়াইছ মাগো না করিও মানা নৌকা দৌড়ে যাইতে মাগো না করিও মানা....।
এ গানের সাথে মাঝখানের পাটাতনে দাঁড়ানো ঢুলির বাদ্য উচ্চনাদে উঠে এবং সারিগায়কদের পায়ের ঘুঙুর ঝুমুরতালে কেঁপে কেঁপে উঠে। শিরখারালী বা শিরমাঝি গলুইয়ে ঝাঁকুনি দিতেই ষাটজন মাল্লার রঙিন বৈঠা একযোগে আসমানকে সালাম জানিয়ে জলের বুক বিদীর্ণ করে। শুরু হয় মৌসুমের পরথম জলযাত্রা। এইবার সাইরদারগণ গলা ছেড়ে যাত্রা পর্বের গান ধরে:
যাত্রা করে দেও মা কালিদহে যাইগো ও ফুল, ফুল আনিয়া দেও মা কালিদহে যাবোই যাবোই যাবো আমি ওরে গুণের ভাই, কালিদহে যাবোই আমি।
পেছনে সারিবদ্ধ নারীপুরুষের চোখে মায়ানগরীর ধান্ধা লাগিয়ে বৈঠাগুলো জল ভাঙে ছলাৎ ছলাৎ! হর্ট হর্ট পবনের না/মণিমালার দেশে যা। নৌকায় অসুরশক্তি ভর করতেই দুইপাশে তৈরি হয় কুয়াশার ধূম্রজাল। জলে ভাসমান সর্পবৎ নৌকা চলে শাঁৎ শাঁৎ! এক সময় এ হয় এক ক্ষীণকায়া সরলরেখা, তারপর বিন্দু। এ বিন্দুটিও দূরে মিলিয়ে যায়। অপেক্ষমান মানুষ চোখের পিটুটি সরিয়েও তা আর দেখতে পায় না।
পাল্টা-পাল্টি কথা
প্রদোষ মাস্টারের নৌকা বের হতেই চারদিক থেকে অন্যান্য নৌকাও ছুটে আসে। নৌকা আসে শিংপুর, অষ্টগ্রাম, থানেশ্বর, বাদলা থেকে। নৌকা আসে তাড়াইলের উইল্লা, সুনই ও সেকান্দরনগর থেকে। আসে ডাঙ্গেরগাঁও, কেশবপুর ও গুড়ই থেকে। এমন কি নেত্রকোণার মদন, ফতেহপুর, গোবিন্দশ্রী ও কদমশ্রী থেকে। এ অনন্ত চরাচরে চৌদিক থেকে নৌকা ছুটে আসে একটি বিন্দুর দিকে। তারা জলের উপর এক প্রকান্ড পদ্মফুলের ডিসপ্লে তৈরি করে। কিন্তু ডাঙ্গার উপর চক্ষুষ্মান নরনারীগণ এ দৃশ্য উত্তমরূপে ঠাহর করতে না পারলেও মহাকাশযানে উড়ে যাওয়া ল্যান্ডস্কেপের আলোকচিত্রীর লেন্সে তা ধরা পড়ে। এই সব নায়ের বাইচালরা যখন তালের সোমে বৈঠা মারে তখন নাওয়ে দাঁড়ানো খাড়া পরালিরা বৈঠা মারে তালের ফাঁকে। তাতে চমৎকার এক ঐক্যতান সৃষ্টি হয়। এ সময় একটি নৌকার হালধরা শিরমাঝি পেছনের প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সইতে না পেরে জলে ছিটকে পড়ে। তখন নৌকাটি একই স্থানে দাঁড়িয়ে কক্ষপথে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। এ যেন ঝড়ো বাতাসে ফুটন্ত কমলের একটি পাঁপড়ির জলে পতন। জলে ফুলের পাঁপড়ি পড়লে বাতাসের ঝাপটায় যেমন জল তিরতির কাঁপে, তেমনি এখানেও জলের কম্পন তৈরি হয়। এরই মধ্যে দু’ একটি নৌকা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবির লড়াইয়ের মতো পাল্টা গানে মত্ত হয়। অতঃপর ওরা হয় নৌকা এক ও নৌকা দুই। এ দুই নৌকা বুদ্ধির খেলায় ঝগড়াটে শাশুড়ি ও পুত্রবধূর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়:
নৌকা এক : কালকা খাইছলি মাছের মাথা আজকা খাইবি কি?
আরে তর ঘরে রঙিলা বিলাইরে।
নৌকা দুই : খিড়কি ঘুচাইয়া আমারে নেও গো নয়া নাগর
এক পয়সার কেচকি মাছ বিলাইয়ে খাইল
এর লাইগ্যা নিঃশত্তুইরা৮ আমারে মারিল গো।
নৌকা এক : অতি ঠমকে চলে বউ নারী গো
তর মুখে সদাই রঙের কথা
চুল দেখি আউলা ঝাউলা পিঠে দেখি মাটি।
নৌকা দুই : গোয়াল ঘরে ধুমা দিতে বলদে মারছে লাথি গো।
নৌকা এক : ও বউ সদাই রঙের কতা
বউ গো মশুইর কেন লড়ে?
নৌকা দুই : রাউ কইরো না চাও কইরো না শাশুড়ি গো বিলাই ইন্দুর মারে।
দ্বিতীয় নৌকাটি যেন নিজেরই ফাঁদে আটকা পড়ে। হৌরী কর্তৃক পুতের বউয়ের পরকীয়া লীলার রহস্য উদ্ঘাটন করে প্রথম নৌকাটি গর্ব ভরে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এ যেন পূর্ববিজয়। তবে বিজয়ের আনন্দের চেয়ে নিরেট আমোদফূর্তিই এখানে মুখ্য। এ সব চটুল গানের আসর সত্যি সত্যিই জমে ওঠে। আর একটি নৌকা থেকে ভেসে আসে গান: রংগিলা ভাসুররে/ভাসুর তুমি কেন দেয়র অইলা না/তুমি যদি অইতা দেয়র খাইতা বাটার পান/রঙে রসের কথা কইয়া জুড়াইতাম পরাণ। তবে থলায় দাখিল হওয়ার তাড়াহুড়ায় তার এ গান ক্রমান্বয়ে চাপা পড়ে। সবার যাত্রা এখন বাইচের প্যান্ডেলের দিকে। নৌকাগুলো তাই দ্রুত ধেয়ে চলে।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
কয়েক মাইলব্যাপী বাঁশের খুঁটি পুতে আর বেড়া দিয়ে প্রস্তুত হয়েছে বাইচের সীমানা। এই বেড়ায় গুন টেনে সাঁটানো হয় রংগিন কাগজের নিশান। বাতাসের দোল খেয়ে এই নিশান উড়ে পত্পত্। স্টার্টিং ও এন্ডিং পয়েন্টে দাঁড়ায় আয়োজক কমিটির জবরদস্ত কর্মীগণ। এরই মধ্যে প্রত্যেকটা নৌকার গতিপথ লাল নিশান টাঙ্গিয়ে আলাদাভাবে নির্দেশ করা হয়, যাতে একটার গায়ে আর একটা না লাগতে পারে। তারপর নৌকাগুলোতে পৃথক নম্বর দিয়ে একজন করে কমিটির লোক ওঠে নাওয়ে। সাধারণত তিনি কারো চা-তামাক পান করেন না। যদি তাতে কখনো নিরপেক্ষতা হারান এই আশংকায়। যদিও বিচারকবৃন্দ বসে আছেন আর এক সীমানায়, তাতে কি, এইখানে বাঁশী মুখে বসা আছেন স্টার্টার সাহেব। একটু পরেই তিনি ঈসরাফিলের শিঙার মতো বাঁশী ফুঁকে সবার ভেতরে কিয়ামতের দাপাদাপি লগিয়ে দেবেন।
ছোট ছোট হাজারে বিজারে নৌকা, লাখে কোরলে নৌকা ছেয়ে আছে বাঁশের বেড়ার দুই পাশে। আর নৌকার উপরে মানুষ, মানুষের ঘাড়ে মাথা, মাথার উপরে ছাতা। আর ঐ কিনারের কার্গোতেও জনতার অন্ত নাই। তবে এর উপরের মঞ্চে বইসা আছেন সম্মানিত আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ। শাখামৃগের মতো মানুষ ওঠে বাড়ির ছাদে ও গাছের মগডালে। একজন দার্শনিক গোছের ব্যক্তি ভাবেন- তাহা হইলে কি বাবা ডারউইনের কথাই ঠিক? এই মানুষেরা জলে ভিজে, রোদে পুড়ে। কিন্তু এই সময়ের জন্য তারা যাযাবরের বংশধর হয় না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে একই বিন্দুতে কিম্বা বাদুড়-বানরের মতো ঝুলে থাকে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায়। এরই ফাঁকে দেখা যায় দু’জন বৃদ্ধ ছৈ-এর উপর দাঁড়িয়ে আসরের নামাজ আদায় করেন। ভলান্টিয়ার ও আয়োজকদের ঠেলায় দর্শকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তারা মাইকে একের পর এক ঘোষণা দেয়, ঘোষণার ফাঁকে রেকর্ডের গান বাজে। কিন্তু লোকজন বিরক্ত হয়ে বলে আপনেরা যান ত ভাই, আপনেরার নাও দৌড়ানি দেখবার দরকার নাই। একজন জবাব দেয়, এইডা কি কন ভাইজান, খালী আপনেরাই বাইচ দেখবেন, আয়োজকরা দেখতে পারবো না, এইডা কুন্ ধরনের গণতন্ত্র? কি জানি ভাই, জিগান কার্গোতে গিয়া, গণতন্ত্রের মানসপুত্র বইয়া রইছে।
এ দিকে দুই তিন নৌকার জটলায় শুরু হয়ে যায় হাতাহাতি। মাইরের জন্য একটা বৈঠা উঠাতেই পিছন থেকে একজন তা খপ করে ধরে ফেলে। তবে গালিগালাজের বিরাম নাই। এই খিস্তির রেশ পড়ে একটি নিরপরাধ হিজড়ার উপর। সে শুধু বসে বসে বিড়ি ফুঁকছিলো। এই লোকটির বকুনির জবাবে কিছু বলতে গেলেই উল্টো ধমক আসে, চুপ কর চেটকাডা মাউগ! হিজড়াটি আর কথা না বাড়িয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। রুজি রোজগারের ধান্দায় ছোট ডিঙ্গি নিয়ে যে ফেরীওয়ালা দ্বিপ্রহরের আগেই থলায় প্রবেশ করেছিলো সে দ্রব্যাদি বিক্রি করতে হিমশিম খায়। বুট-বাদাম, প্রত্যুষের ঠাণ্ডা পিয়াজু-ছোলা আর পান-সিগারেট দিতে দিতে তার নাভিশ্বাস ওঠে। এমন কি তার সহকারীরও শরীরে ঘামের দাপটে কারো আর সওদা নিতে রুচি হয় না। জলের উপর ভেসে বেড়ায় অগণন পলিথিন ব্যাগ। শিশুদের বাঁশীর পোঁ পোঁ আর ক্যাট্ক্যাটির শব্দে এক মহা হুলুস্থুল পড়ে যায়।
আর বাড়ির আঙিনায় নদীর পাড়ে যে নাইওরী মেয়েছেলেরা ভিড় করে আছে, তাদের থলার কাছে এসে দেখবার কিছু নাই। নৌকায় উঠতে তাদের বারণ আছে। তবে দেখবার না থাকলেও দেখাবার আছে অনেক কিছু। এতোক্ষণ তারা ডজন খানেক গরু জবাইয়ের মাংশ বানানো প্রত্যক্ষ করছিলো। বাইচের আগে আগে পড়ন্ত বেলায় হাতে প্রাচীনকালের বাজুবন্দ, পায়ে মল, গলায় মোটা ধাতব হার পরে তীরে হাঁটাহাঁটি করে। এসব ধাতব দ্রব্যে বিকালের সোনারোদ পড়ে চিক্চিক্ করে উঠে। রোদের ঝাঁজ, খড়ের গাদার ভেজা গন্ধ, লক্ষ হাজার ডিঙ্গি নৌকার আলকাতরার ঘ্রাণের মধ্য দিয়েই স্টার্টার তার বাঁশী ফুঁকে দেয়।
স্টার্টারের বাঁশী ফুঁয়ের সাথে সাথে সারা গ্রাম চিলিক দিয়ে উঠে। সাজ সাজ রব পড়ে যায়। একটা শাঁ শাঁ শব্দ ওঠে জলে ডাঙ্গায় সর্বত্র। মাইকে ধারা ভাষ্যকার তার ভুল-শুদ্ধ, আঞ্চলিক-মান ভাষায় ধারা বর্ণনা করতে থাকে: হ্যাঁ ভাই, ইহা ত নয় দৌড়ের নাও, যেন আরবীয় টাট্টু ঘোড়া! সোনার ময়ূর সামনে লইয়া পংখীরাজের মতো এগিয়ে আসতেছে কেশবপুরের নৌকা, তার পিছনেই আছে থানেশ্বরের নাও ভাই। আরে সে যেন ঘোড়দৌড়ের দুল্দুল। দেখা যাক কে জিতে, কে হারে! কমেন্টেটরের হাজারো আগামবাণী সত্ত্বেও সবার চোখে ধূলো দিয়ে প্রথম হয়ে যায় ডাঙ্গেরগাঁওয়ের নৌকাটিই। কারণ এ ছিলো হাজার মানুষের অনুমান ও মানসিক পক্ষপাতিত্ব। জানা গেছে এ নৌকাটি কোনোদিন হারে নাই। লড়াইয়ের ষাঁড়ের মতো প্রতিবছরই সে প্রতিপক্ষকে ক্ষীপ্রতার ঘায়ে কূপোকাৎ করে আসছে। বাইচ শুরু হওয়ার আগে এই নিয়ে বাজিও হয়, দেহিস্ আমি কইলাম ডাঙ্গেরগাঁওয়ের নাওডাই ফাসটো অইবো। কর পণ, ধর বাজি, না জিতলে কি দিবি, বউ, টেকা পয়সা, না আস্তা একটা দৌড়ের নাও, হাঃ হাঃ।
নাও দৌড়ানি শেষে ডাঙ্গেরগাঁয়ের নৌকা পুরস্কারের টেলিভিশন নাওয়ের গলুইয়ে শক্ত করে বেঁধে আর সকল বাইচালের গলায় একটি করে মেডেল জড়িয়ে ঘাটের দিকে যায় মানুষের আশীর্বাদ কুড়াতে। তার পেছনে পেছনে আসে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানীয় কেশবপুর ও থানেশ্বরের নৌকা শিল্ড এবং কাপ উঁচিয়ে। পোতের অগ্রে বসা সাইরদার ইব্রাহিম ও কুদ্দুস। আজ সারাদিনই তারা গেয়েছে নিমাই-সন্যাস, কৃষ্ণলীলা, জলভরা, কুঞ্জসাজান। যাত্রা পর্বে গাওয়া হলেও ঘাটে এসে ভিড়তেই তীরে অপেক্ষমান রমণীকুলের অনুরোধে তারা আবার এ সব গানেরই চর্বিত চর্বন করে:
যাত্রা করিয়া যাদুর মুখে দিলো পান ঘরের তে না বাহির হইলো পুন্যমাসী চান।
এই পয়ারটি গাওয়ার সাথে সাথেই কয়েকজন বাইচাল মিজান নিকলীয়ার বাহু ও চিবুকে স্পর্শ করে সামনে বাড়িয়ে ধরে। সে কেবল একজন দক্ষ বাইচালই নয়, সুঠাম দেহী, অনন্য দেহ বল্লরীর অধিকারী ও দক্ষ সাঁতারু। তাকে এইভাবে টেনে হেঁচড়ে লাইম লাইটে ফেলে দেয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় পাড়ের নারীসকল হেসে কুটিকুটি। এদেরই অরণ্যে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিলো মদিনা নামের মেয়েটি। মিজানকে নিয়ে এমনতর টানাটানিতে সে লজ্জায় লাল হয়। তার মুখমন্ডলে ঘাম জমে, কর্ণযুগলে গরম ভাপ লাগে যেন। তার রাঙ্গা চোখ পড়ে না আর কারো চোখে, এমন কি মিজানও তাহা দেখতে পায় না।
তবে মদিনা যে লজ্জায় লাল হইয়াছে ইহারও কারণ আছে। মিজান-মদিনা একে অন্যের পরাণ-পংখি। জলের সাথে সখ্য করে মিজান বাইচাল বেড়ে উঠে। সে সওদাগরের পুত না, কিন্তুক পিরীতের কারবারী। শিশুকালেই প্রান্তরের এক মাথা হইতে বৈঠা মেরে অন্য মাথায় নৌকা চালনা ছিলো তার খেলা। এই ভাবে অযথাই দিনে কয়েকবার বৈঠা শান দিয়ে সে তার বাহু গঠন করে। পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনই এই বাইচ প্রত্যক্ষ করতো মদিনা বেগম। মিজানের পেশীর দিকে তাকিয়ে মদিনা এক সময় সম্মোহিত হয়। কিসের যেন এক আকর্ষণ।
একটু ডাঙ্গর হইলে সে পাড় থেকে মিজানকে ডাকতো: ও মাঝি, আমরে নাওয়ে তুলবা?
এহন না।
কুন্ দিন?
যহন সময় অইবো।
প্রত্যেক দিনই তো এক কথা কও।
তারপর হইতে মনে মনে মদিনার প্রতীক্ষার প্রহর।
তবে এখন প্রতীক্ষা সবার গান শুনবার। এইখানে গায়েন ও সাইরদারগণ মধ্যযুগের চন্দ্রাবতীকে ভুলে যায় না। তাঁরই ‘দেওয়ান ভাবনা’ থেকে পয়ার কেড়ে নিয়ে ওরা গায় নতুন সঙ্গীত:
কইও কইও কইও গো দূতি কইও বন্ধের আগে আমারে নি তালাশ করে কইট্টেদির বাজারে গো।। কইও কইও কইও গো দূতি কইও বন্ধের আগে আমার কাঙ্খের কলস পইড়া গো রইছে সোয়াইজনীর পাড়ে গো।।
একজন এসে বলে, ও মিয়া বাইচাল, সাইরদার ভাইগণ, তাড়াতাড়ি গানা বাজনা শেষ করো, জোড়া খাশী জবাই অইছে, খাওন দাওন শেষ করতে অইবো।
কিন্তু এ কথায় মেয়েরা আর চেংড়া ছেলেরা জানায় প্রতিবাদ, না ভাইসব, গান শেষ কইরেন না, বহুত দেরি আছে, খাশী এহনও ভ্যা ভ্যা করতাছে।
পাড় থেকে এরূপ সবুজ সংকেত পেয়ে ইব্রাহিম গায় কৃষ্ণলীলা আর কুদ্দুস হয় তার দোহার।
ও রাধে গো রাধে যাইস না জলের ঘাটে বস্ত্র থুইয়া কলসি লইয়া নামল জলের ঘাটে বস্ত্র নিল চিকন কালা কলসি নিল স্রোতে গো।
এমন সময় একটি মেয়ে আর একটি মেয়েকে জলে ফেলে দিয়ে বলে, যা লো যা কলসি লইয়া আয়, ঐ যে ভাইস্যা যায়।
জলে পতিত মেয়েটিও কম যায় না, সে প্রত্যুত্তরে বলে- তর ত নিছে কাপড়, যা লেংটাভুতুরি দৌড় দে, গিয়া দ্যাখ কুন্ কদমের ডালে বইয়া রইছে তর নাগর।
সবাই আর এক দফা হেসে কুটিকুটি হলেও একজন বাইচাল একটি বৈঠা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটিকে পাড়ে তোলে। কুদ্দুস বলে, দাদা বুইড়া অইছো, গলায় ফ্যাস ফ্যাস বাজে। তুমার কষ্ট অয়, নিমাই-সন্যাসটা আমি গাই।
নারে ভাই বয়স কুনু বিষয় না, পেডে বেদ্না, খালী সোডা খাইয়া বাঁইচা আছি। ঠিক আছে, গাইতে চাইছস গা। ওস্তাদের সম্মতি পেয়ে কুদ্দুস গায় নিমাই সন্যাস:
নিমাই চান সন্যাসে চইলা যায় আঃ আঃ কান্দে শোচী মায়।। নিমতলা থাইক্যা নিমাই নিমের মালা গলে সয়ালকে বুঝাইতে পার মা’রে কেনে ছাড়বে নিমাই চান বাছারে নিমাই চান সন্যাসে যাওনা না।। এক অঙ্গ খাইলো মায়ের গুয়ে আর মুতে আরেক অঙ্গ খাইলো মায়ের মাঘ মা’য়া শীতে রে নিমাই চান।।
করুণ সুরে নিমাই সন্যাসীর জীবন বৃত্তান্ত শুনে তীরে বসা তানসেনের চোখে জল আসে।
এইডা কেডা, কেডা কান্দে?
তানসেন।
সে আইছে কুন্ দিন?
বাইচ খেলার আগের দিন।
এই নাম শুনলেই আমরার বুকের ভিতর জ্বালাপুড়া করে।
শশব্যস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে আসে মিজান বাইচাল।
মিয়া তানসেন, সম্রাট আকবরের সভা-গায়েন, কি অইছে। খুইল্যা কও।
অয় নাই কিছুই। ইউনিভারসিটিতে আমাদের এক বন্ধু আছিলো, নিমাই, কয়দিন আগে সে একসিডেন্টে মারা গেছে। আমরা তারে মস্করা কইরা কইতাম জামাই।
হ’ জামাই।
হুমাইপুরের জামাই মিয়া জবর ভাগ্যবান
তিন তক্তার নাও বানাইয়া কুড়াইল সম্মান।
তানসেন : তুমরা কর তামাশা আর নিমাইয়ের গান শুইনা আমি কান্দি।
মিজান : নারে ভাই তামাশা না। আমরা কিছু বুঝতে পারি নাই। আইজ হইল খুশির দিন, এইখানে কেউ মুখ গোমরা করলে বড় বেতাল লাগে। কও শুনি তুমরার নিমাইয়ের কথা।
তানসেন : কি আর কইবাম। সে আছিলো গরীবের পুত। তবে মনটা খুব ভালা। ঢাকা শহরে ওয়ানওয়ে ট্রাফিক চালু অইলে নীলক্ষেতের মোড়ে রাস্তা পার হইতে মাথায় খায় গাড়ির ধাক্কা। তারপরে তিন দিন অচেতন থাইকা হাসপাতালে মারা যায়। এই সময় আমরার বেড়াইতে যাওয়ার কথা আছিলো গারো পাহাড়ে। সেইখানে না যাইয়া লাশ লইয়া গেলাম নিমাইয়ের গ্রামের বাড়ি। বাড়ির উঠানে গিয়া ডাক পাড়তেই ‘নিমাই নিমাই’ বইলা বাইর অইয়া আসে তার মা। পুতেরে জড়াইয়া ধইরা মায়ের সে কি কান্দাকাটি। মিজান ভাই, এই দৃশ্য আমি এখনও চোখের সামনে থাইকা সরাইতে পারি না।
মিজান : না জাইনা তুমারে কষ্ট দিলাম। কিছু মনে কইরো না। গানের আসর। পারলে একটা গান গাও। আরে গান হইলো প্রাণ। গান গাইয়া মনডারে হালকা কর।
তানসেন : আমি ত গান জানি না মিজান ভাই।
মিজান : তানসেন, নামের কলংক কইরো না।
গানের এ আসরে নিমাই সন্যাসীর গান শুনে তানসেন ভাবে এ তো পুরাণের নিমাই নয়, পরাণের। মৃত নিমাইয়ের মায়ের আহাজারীর রোদন ধ্বনিতে পুরাণের নিমাইকে সে তাই পরাণের গভীরে অনুভব করে। কিন্তু গান সে জানে না। তবে এও ঠিক সঙ্গীতের একজন সমঝদার সে। শহরের কিছু সঙ্গীত-নাট্যদলের সাথে তার সংযোগও আছে। তাই মনে মনে ভাবে, এতোই যদি কও তাইলে গাই একটা। নিমাইয়ের মায়ের জবানীতে তানসেন গান ধরে আর সেই সাথে বায়ু বাহিত হয়ে জলের ধারায় নেমে আসে এক বিষাদের ছায়া:
তানসেন : ওরে ও নগরবাসীরে তোমরা নি দেইখাছ নিমাইরে তোমরা নি দেইখাছ আমার দুধের বাচ্চা নিমাইরে।। লেখাপড়া শিখ্যা নিমাই পন্ডিত অইলা বড় জগতকে বুঝাইতে পার মাকে কেন ছাড়।। আগে যদি জানতাম রে নিমাই যাইবারে ছাড়িয়া না করাইতাম বাসর সজ্জা না করাইতাম বিয়া।।
মিজান-মদিনার প্রেমের তরী
রাত গভীর হইতে সকলের শরীরের ধকলে সহিষ্ণুতা নামিয়া আসে। কেউ কেউ আড়মোড়া ভেঙে গলা খাকারী দেয়। রাতের প্রথমার্ধের তুমুল বৃষ্টিতে জল ঘোলা হয়েছে, এই ঘোলাজলে শিং মাছের রং হয় বড়ো অদ্ভূত। তার উপর বাতির আলো পড়লে মাছটাকে চেনাই যায় না। কীট-পতঙ্গ ও পাখির মৃদু তালযুক্ত ডাকের সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাস বয়। এই বাতাস আর থামে না। তবে বাতাস যেন কেমন ভিজা ভিজা লাগে, আবার গাছের ডাল-কাণ্ড ও পুষ্পাদির গন্ধও ভেজা ঠেকে। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাতের ভুরিভোজ পর্বের এক ফাঁকে প্রদত্ত কথা মতো মিজান-মদিনা উভয়েই পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। একটা কামিনী গাছের কাছে আসতেই ফুলের উগ্র ঘ্রাণে মদিনার শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে। সত্য মিথ্যা যা-ই হোক, সে শুনেছে মধ্যযামে ফুলের ঘ্রাণে সাপ আসে। যেমন শুনেছিলো বাঁশীর শব্দেও সর্প আগমনের কথা। একবার ছোট বেলায় মামাত ভাইয়ের সাথে ‘আলোছায়া’ সিনেমায় ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ ছবি দেখার সময় মহা হুলুস্থুল পড়ে যায়। লোকেরা বলাবলি করে কিরণমালার বীণের শব্দে হলের ভিতর সাপ ঢুকেছে, একটুর জন্যে নাকি কাকে কামড়ই দিয়ে বসতো, সে সিটের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। সেই রাতের ঘটনা মদিনার স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করে। এইক্ষণে সে ভাবে লোকের কথা মিথ্যা হয় না, বাঁশীর শব্দে সাপ আসলে ফুলের ঘ্রাণে আসবে না কেন? দ্বিতীয়বার এ কথা ভাবতে সে ভয়ে মিজানকে সাপের মতোই প্যাঁচিয়ে ধরে। মদিনার এই রকম লাজ ভঙ্গে মিজান হতভম্ব হয়ে পড়ে। আর সে কারণেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আগেভাগেই তার নিরবতা ভঙ্গ হয়।
মিজান : কি অইলো?
মদিনা : ডর লাগে।
মিজান : কিসের?
মদিনা : জানি না।
মিজান : গলা ছাড়। কেউ দেখবো। পাশের ঘরে নয়া জামাই-বউ। এহনও ঘুমায় নাই।
মদিনা : বাইরে এহন আন্ধাইর।
মিজান : আস্তে কতা কও মদিনা। তুমি তো বুঝ না, জেল জরিমানা অইলে আমার অইবো।
মদিনা : কেউ জাইগা নাই।
মিজান : মনে অয় বাইরে পাহারা আছে। ঐ যে টিপবাত্তি মারতাছে।
মদিনা : থাক। আইচ্ছা, নাওয়ের উপরে যে তুমারে লইয়া বাইচালরা টানাটানি করলো, তুমার লাজ করে নাই?
মিজান : কি, এই ঘটনা তুমি দেখছ?
মদিনা : ক্যারে, তুমি আমারে দেহ নাই?
মিজান : না তো।
মদিনা : তুমি একটা বেক্কল।
মিজান : আর তুমি একটা চালাকের নাতনী।
(উভয়েই চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে)
মিজান : কি রূপ নিয়া তুমি ঘর থাইক্যা বাইর হইলা মদিনা? সারাদিন কাম কইরাও তুমার শরীলে নাই ক্যারে ঘামের গন্ধ?
মদিনা : রাইতের মাতাল বাতাস আমার গতরের সব গন্ধ শুইষা নেয়। আর আন্ধাইর নেয় শরীলের রং।
মিজান : কেউই ত আমরার কতা শুনলো না, লও পলাইয়া যাই, ঘাটে ডিঙ্গি বান্ধাই আছে। যেই সেই নৌকা না, দৌড়ের নাও।
মদিনা : যাইবা কই?
মিজান : করিমগঞ্জ, খালার বাড়ি।
মদিনা : এইভাবে দিন যাইবো? কয়দিন থাকবা সেইহানে?
মিজান : যয় দিন পারি।
মদিনা : খালা কি আশ্রয় দিবো?
মিজান : ক্যারে দিবো না? এক সাথে মানুষ অইছি। খালার সাথে আমার বয়সের তেমুন ফারাক নাই। সব কথাই তার সাথে খুইলা বলা যায়।
মদিনা : তারপরে যাইবা কই?
মিজান : তুমারে নিয়া আমরিকা যাইবাম। দুইজনের নামে দুইডা ডিভি ছাড়ছি। লাটারীডা পাইয়া লই।
মদিনা : হিঃ হিঃ হিঃ। গাছে কাঁডল মুচে তেল।
মিজান : না না, সত্যিই কইছি। যদি লাইগ্যাই যায়?
মদিনা : এই নৌকা তুমি একলা চালাইতে পারবা?
মিজান : ক্যারে পারতাম না? যে শক্তি আছে হাতে, একলা চালাইলেও সাঁতারের চাইতে নাও আগে যাইবো।
মদিনা : কিন্তুক পলাইয়া গেলে তো মাইনষে কইবো ছিনাল ছেড়ি। মনে কর তুমার লাইগ্যা আমি ডর ভয় লজ্জা শরম সবই হারাইছি, কিন্তুক অপবাদের বোঝা বই ক্যামনে?
মিজান : কুন অপবাদ না, তুমি ত যার তার লগে যাইতাছ না।
মদিনা : তারপরেও কতা আছে। যেই নৌকা চালাইতে লাগে ৬০ জন পাক্কা বাইচাল, তারে তুমি একলা নিবার চাও?
মিজান : আরে বড়ডা নিতাম না। নিয়াম সবার ছোড ছিপ নাওডা। বৈঠা জোরে টান মারলে পংখীরাজের মতো উড়া মারবো। তুমি নাওয়ের আগায় থাইকা গলুইয়া মাঝির মতো মাঝে মইদ্যে ঝাঁকুনি মারবা, দেখবা নাও কই যায়।
বারবার পিছনে তাকিয়ে তাকিয়ে মদিনা মিজানের হাত ধরে ছোট পানসিটায় গিয়ে ওঠে। একটা রঙিন বৈঠা নিয়েই মিজান ঘর থেকে বের হয়েছিলো। রাতে বৈঠাই বাইচালদের আত্মরক্ষার হাতিয়ার। পায়ে হেঁটে রাতে কোনো দূর গ্রামে গেলেও বাইচালদের হাতে থাকে ছোট্ট বৈঠা। ওরা দুইজন নায়ে উঠেই মিজান বাইচাল জোরে লগি মেরে নৌকাটা ভাসিয়ে দেয়। নাওয়ের পাছায় একটা বড়ো ঝাকুনি দিতেই মদিনা সার্কাসের বালিকার মতো নাওয়ের গুড়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে গলুইয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। কখনো ত্রিভঙ্গ মুরারি হয়ে কিম্বা বিশেষ ভঙ্গিমায় অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহের মূর্তি হয়ে যায়। কুচযুগল উদাম, গলুই কাটা বাতাসে উড়ে বসন।
দক্ষিণা লীলুয়া বাতাস লাগলো মাইয়ার গায় গো লীলাম্বরী বসন তাহার বাতাসে লুটায় দক্ষিণা লীলুয়া বাতাস উত্তর দিকে যায় পূবালী বাতাসে মাইয়ার আঞ্চলটা লুটায় গো।
এইদিকে মিজান বাইচালের বৈঠা মারার বিরাম নাই। নৌকা তখন সোয়াইজনী নদীকে বিদায় জানিয়ে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। চারপাশে শুধু পানি, শুধু অন্ধকারের অতল গহবরে হারিয়ে মদিনা বিবি হাবুডুবু খায়। এক সময় পূর্ব দিকে সূর্যসারথীর১২ আনাগোনার সংবাদ পাওয়া যায়। তারই আলোকছটায় পূর্ব দিগন্ত হয় বিশাল চিত্রপট। এই পটে আমাদের মদিনা বিবি হয় এক মানবী চিত্র, বিশ্বকর্মার আঁকা। আবার কখনো দিগন্তে মেঘের ঘনঘটায় হয় দেয়ালচিত্র কিম্বা কাষ্ঠে খোদাই মুরতি।
আর ঐ দিকে হলো কি? কি হলো? সারা পাড়ায় চিল্লা-ফাল্লা হলো। হৈ চৈ হলো। তবে অনেক দেরিতে। মোয়াজ্জিনের আযান হলো। কীর্তন গাওয়া শেষ হলো। ঘাটে এসে ম্লান করতে জামাই বাবু লজ্জা পেলো। অজুর পানি গড়িয়ে গেলো। লাঠিশোটা বের হলো। চোর পালালো, কুত্তা দৌড়লো। বৈঠা লগি হাতে উঠলো। পাহারাদার কানে একটা মলা খেলো। ডাকে নাই তাই বাকের মোরগা জবাই হলো। ৫০/৬০ জন বাইচাল ছিলো, ঘর থেকে বের হলো। ‘হেঁই সামালো হেঁই সামালো’ রব উঠলো। কিন্তু ধরতে কি পারলো? পারলো না।
চামড়াঘাট বন্দরে তখন লাজুক রাত তার ঘোমটা সরিয়ে ফেলেছে। ফার্স্টট্রিপের গয়নার নাও লোকজনকে ডাকাডাকি করে আর কাঠিতে ঢোল বাজায়— আসেন ভাই, আসেন, ছাইড়া দিলো নাও, এলেংজুড়ি-ইটনা-জয়সিদ্ধি, আসেন তাড়াতাড়ি, আর মাত্র ১০ মিনিট, ফাস্টটিপ-ফাস্টটিপ! এখানে নৌকার অন্ত নাই। কতো বাহারী নৌকা— কুসসা, পাতাম, সাম্পান, সেরেঙ্গী, রপ্তানী, ইঞ্জিনের ট্রালার, স্পীডবোট, ছৈয়া নাও, গুদারা, ডিঙ্গি, তালগাছের এমন কি কলাগাছের ভেলা। আর ভাটি থাইক্যা আসে যায় নৌকা বোঝাই কাঁঠাল, কচু ও লতি। সিলেটের পাথর আসে কার্গোতে কইরা। লঞ্চ ছাড়ে হবিগঞ্জ-সুনামগঞ্জের দিকে। ভৈরবপুর থাইকা যে লঞ্চ সন্ধ্যায় ছাইড়া কুলিয়ারচরের কালী নদীতে আইসা জিরায়, তা শেষ পর্যন্ত বাইজপুর-নিকলী অইয়া ভোরের আলো মাথায় কইরা চামড়াঘাটে ঠেকে।
শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে ওরা দুইজনই নৌকার দুই মাথায় হাল ছেড়ে বসেছিলো। ভোরের আলো ফুটতে মিজান আবার বৈঠা হাতে নেয়। মদিনা শোয়া থেকে উঠে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে। বাসী দাঁত ঘষতে ঘষতে মানুষ টিটকারী মারে- ঐ যে দ্যাখ যায়, না জানি কইত্থে ধইরা লইয়া আইছে।
দ্বন্দ্ব
বাংলাঘরের সামনে দাঁড়াইয়া প্রদোষ মাস্টার আর কফিলউদ্দিন মাথার চুল ছিঁড়ে।l
প্রদোষ : নাও দৌড়ানির শেষ কাডালে এই হাল? চেয়ারম্যান আইতাছে, দেহি তাইনে কি কয়।
দুলাল : কি অইলো কফিলউদ্দিন-প্রদোষ মাষ্টার? এলাকার মানসম্মান আর রইলো না। নৌকা শেষমেশ ছেড়ি ভাগানীর কামে ব্যবহার অইলো।
প্রদোষ : আমরা কি করবাম চেয়ারম্যান? সবাইর সব দায়িত্ব না। জিগান কফিলউদ্দিরে।
দুলাল : কফিলউদ্দিন, তুমি থাকতে-
কফিল : চেয়ারম্যান সাব, বাইচ খেলার বাইরের দায়িত্ব কি আমরার নি কন?
দুলাল : তুমরার বুঝা উচিত ছিলো, এর লগে জড়াইয়া আছে নিকলী ময়ালের মান-ইজ্জত যা তুমরা রাখতে পারলা না।
কফিল : চেয়ারম্যান সাব, আপনে দেহি মাঠের বাইরের ঝগড়া ফ্যাসাদের দায়দায়িত্ব রেফারির উপরে চাপাইতে চান। এইডা বড় বেঅন্যায় কতা।
দুলাল : না কফিল না, কইবার চাই যে, সবারই আরো সর্তক থাকা দরকার ছিলো।
কফিল : সতর্ক ত আছিলামই। রাইতে দুইজন পাহারাদারও বসাইছিলাম। কিন্তুক ভাবি নাই যে, নৌকা নিয়া ছেড়া-ছেড়ি পলাইয়া যাইবো।
প্রদোষ : তুমার পাহারাদাররে আইন্যে গাছে লটকাও। দেহি কুনু কতা বাইর অয় কিনা।
দুলাল : আরে মাস্টার, হেরা কিছু কইতে পারবো না। সারা রাইত গাঞ্জা খাইয়া ঘুমাইছে।
কফিল : ঠিক আছে আপনেরা যখন অতোই দোষ চাপাইতেছেন পোলাপুড়িরে ধইরা আনবাম। চৌথা আসমানের নিচে যেহানেই মিজান-মদিনা লুকাইয়া থাক, বাঁচবার পারবো না।
দুলাল : ডাকো তারার মা-বাপেরে, আগে জিগাইয়া দেহি, ছেড়াছেড়ির আশা করে, না করে না।
কফিল : আপনে কুনু চিন্তা কইরেন না চেয়ারম্যান সাব, হেরারে অবশ্যই খুঁইজা পাইবাম।
প্রদোষ : পাইলেই কি, কলংকের কালি যা লাগবার তা’ত লাইগাই গেছে। তুমি কি বুঝবা কি হারাইছে, সেইডা বুঝে প্রদোষ মাস্টার।
দুলাল : ঠিকই কইছ মাস্টার, এই কলংকের তীর যত না লাগছে চেয়ারম্যান দুলাল আর কমান্ডার কফিলের গায়ে, তার হাজারগুণ জোরে বিঁধছে মাস্টারের বুকে।
প্রদোষ মাস্টার ডুকরে কেঁদে ওঠেন। চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাকে প্রবোধিত করার চেষ্টা করেন।
প্রদোষ : আমারে কি বুঝাইবেন আপনেরা, আমি কম বুঝি? কম বুইঝা কোনোদিন মাস্টারী করতে যাই নাই।
দুলাল : ঠিক আছে, চলো আজকের বাইচটা শেষ করি। আল্লার রহমতে ভালোয় ভালোয় শেষ অইলেই অয়। দেহি দুর্নাম একটু ঘুচে কিনা।
প্রদোষ : সাবধানে চলবাইন চেয়ারম্যান। আইজ আশুরা।
দুলাল : হ, তুমার দেহি সব খবরই আছে।
কফিল : না অইলে আর মাস্টর ক্যারে?
সকলে : হাঃ হাঃ হাঃ।
ওরা আবার মৌসুমের শেষ দিনের বাইচ আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চারদিকে গুরুগম্ভীর ভাব বিরাজ করলেও, আয়োজন ও পরিচালনায় তাড়াহুড়ার আতিশয্য লক্ষ্য করা যায়। তবে মরশুমের শেষ নাও দৌড়ানি বলে লোক সমাগমের অন্ত নাই। সব লোক গিয়ে কার্গোর প্যান্ডেলে উঠে। ভলান্টিয়ারের বেরিক্যাড সত্ত্বেও মানুষের বাধ মানে না, ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। এক সময় পুরাতন কার্গোর পাটাতন মানুষের চাপে ভেঙে পড়ে। তাতে লোকজন আহত হয়। পুরস্কারের টেলিভিশন বাক্স সমেত পানিতে চুবানী খেয়ে উঠে। আবার তাকে রোদে শুকানো হয়। মাস্টার মশাই আর চেয়ারম্যান সাহেব প্রমাদ গুনলেও কফিলউদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ চেয়ারম্যানের ওয়ার্নিং পেয়ে সে থলা থেকে আর বের হয় না। নিচ্ছিদ্র শৃঙ্খলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তার চেষ্টার বিন্দুবৎ ত্রুটিও নাই।
একটি নৌকার অভিযোগ পেয়ে কফিলউদ্দিন সেখানে ছুটে যায়। তাদের কমপ্লেইন, নাগেরগাঁয়ের নৌকা নাকি তাদের সাথে দারুটোনার গুনীন নিয়ে আসে। এই গুনীনের হাতে তারা দেখেছে ধূলাপড়া ও কাটা মোরগের লহু। এই দিয়ে গুনীন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কোনো একটা যাদুটোনা করতে চায়। কফিল তাই নাগেরগাঁয়ের নৌকার মোতায়েন, যাকে কমিটি কর্তৃক এ্যাপয়েন্টম্যান্ট দেয়া হয় বাইচের আগে, তাকে জিজ্ঞেস করেও কোনো হদিস খুঁজে পায় না। সাক্ষীপ্রমাণ না পাওয়া গেলে যেমন বিচার হয় না, এই মামলাটিরও নিষ্পত্তি হয়েছে অনুরূপভাবেই। তবে নাগেরগাঁয়ের নৌকাটি নিবৃত্ত হলেও সে রোষে ও জেদে ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকে। সুতী নদীর পাড়ের পুড্ডা গ্রামের নৌকা তার তলায় করে নিয়ে এসেছিলো কোঁচ-বল্লম ও লাঠি শোঠা। এ নৌকাটির সাথে নাগের গাঁইয়ারা জোট বাঁধে ও সখ্যতা গড়ে। যে করেই হোক ডাঙ্গেরগাঁয়ের নৌকাকে আজ আটকাতেই হবে।
স্টার্টারের বাঁশী বাজবার খানিক আগেই পুড্ডার নৌকাটি বৈঠা মারে। কিন্তু ডাঙ্গেরগাঁয়ের নৌকা তাতে আমল দেয় নাই। তারা জানে কয়েক কদম গেলেই আগের নৌকাটিকে ধরে ফেলা তাদের পক্ষে কোনো সমস্যাই নয়। তাই লোকজনের পুনঃ হিট নেয়ার দাবীকে অগ্রাহ্য করেই তারা এগিয়ে চলে। এতে নাগেরগাঁয়ের নৌকার বাইচালরা খুশিতে আটখানা। এইবার বুঝি ডাঙ্গেরগাঁও হেরেই যাবে। আর তাদের নিজেদের তো নেই কাপ হাতে নেয়া বা সোনার চেইন গলায় পড়ার কোনো বাসনা। পুড্ডা গেরাম জিতলে কার কি ক্ষতি? কিন্তু চোখের পলকেই ডাঙ্গেরগাঁও তার ব্যানার উঁচিয়ে সামনে ধাবমান হয়। বাকী দুই তরণীকে পিছনে ফেলে সে কয়েক হাত এগিয়ে যায়। নাগেরগাঁয়ের নৌকার বাইচালরা জলে বৈঠা না মেরে সেই বৈঠা ঠেকায় প্রতিপক্ষের ঘাড়ে। অন্যপাশ থেকে পুড্ডার নৌকা সজোরে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলে গুটি কয় বৈঠা। শেষ প্রান্তের আগে আগে দুই নৌকা ডাঙ্গেরগাঁওকে সাঁড়াশীর মতো চেপে ধরে। কিন্তু অতোশতো মার খেয়ে কিঞ্চিৎ রুখে দাঁড়াতেই পুড্ডা গ্রামের বল্লমের আঘাতে ডাঙ্গেরগাঁয়ের শিরমাঝি জলে ছিটকে পড়ে। এই সংঘর্ষ যে কেবল জলেই সীমাবদ্ধ আছে তা নয়, থলার দুই পাশের লোকজনের মধ্যে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি পাড়ের দর্শক সমেত পুরো বাইচ এলাকা ডাঙ্গেরগাঁও ভার্সেস আদার্সে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মেয়েছেলেরা ঘরে সেঁধিয়ে দরজা জানলার খিল আঁটে। থলার দুই পাশের ছোট নৌকাগুলো দিক বিদিক ছুটতে থাকে। একটি ছোট দৌড়ের নাও জলে ডুবন্ত সেচের ড্রেনের উপর দিয়ে পালাতে গিয়ে ভেঙে ছত্রখান হয়ে পড়ে। কিছু ইঞ্জিনের ট্রলার লোকজনের দাপাদাপিতে কাত হয়ে ডুবে যায়। কেউ কেউ সাঁতরে স্থান ত্যাগ করার তাড়াহুড়ায় তাৎক্ষণিক জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষের মাথার কেশবর্ণে সারা সোয়াইজনী নদী ফোটা ফোটা কালো রঙ ধারণ করে। শিশুদের আর্তচিৎকারে যেন শুষ্কতার বদলে নাব্য কারবালা নেমে আসে। বৃক্ষের ডালে যারা শাখা মৃগবৎ বিরাজ করছিলো তারা আপন স্বভাব ভুলে গিয়ে অনড় হয়ে আধুনিক সভ্যতায় ফিরে আসে। তাদের অস্থির হাতগুলো আর জলে ঢিল ছুঁড়ে না। যারা বার বার টারজানের ডাকের অনুকরণে কন্ঠশীলন করছিলো তাদের ডাকাডাকিও বন্ধ হয়ে যায়।
নেতা গোছের একজন অতিথি কার্গোর সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নেমে আসে। তার পশ্চাৎধাবন করে দুলাল চেয়ারম্যান, প্রদোষ ও অন্যান্য গন্যমান্যগণ। একজন এসে তার হাতে পায়ে ধরে হাজার কাকুতি মিনতি করলেও তিনি আর এখানে থাকবেন না বলে চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। পরে জানা যায়, হেরে যাওয়া নৌকাটির অধিকাংশ বাইচাল ছিলো তার দলের সমর্থক। কেবল তা-ই নয়, এই নৌকার তলায় তিনি মোটা অংকের ডোনেশন ঢেলেছেন। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে এ অর্থ তিনি নৌকার ভেতরে নয় বাইরে অর্থাৎ জলে ঢেলেছেন।
দস্যুরা যেমন সর্বস্ব লুট করে কর্ম সমাধা হলে নৌকায় দ্রুত উল্টো বৈঠা মারে, তেমনি ওলন্দাজ, পর্তুগীজ বা স্পেনীয় জলদস্যুদের মতো অপরাধী দুটো নৌকা পালাতে থাকে। অন্য নৌকাগুলো তাদের পিছু ধাওয়া করেও ধরতে পারে না। একটি নৌকার শিরমাঝি বরং বস্ত্র উন্মোচন করে পিছনের সকল নৌকাকে বলে- আমার এইডা ধরবি। তবে বস্ত্র অভ্যন্তরে কি ছিলো দূর থেকে তা স্পষ্ট না দেখালেও থলার শেষ প্রান্তের এক স্কুল বালকের খেলনা বাইনোক্যুলারে তা মোটামুটি ধরা পড়ে। থলার অন্যপ্রান্তে ডাঙ্গেরগাঁয়ের নৌকার শিরমাঝিকে সহকর্মীরা দ্রুত নৌকায় তুলে উপজিলা হেল্থ কমপ্লেক্স-এর উদ্দেশ্যে বৈঠা মারে। শিরমাঝি যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। নৌকার পশ্চাৎভাগ থেকে শিরমাঝির পতিত রক্ত জলে একটি উজ্জ্বল লাল রেখা তৈরি করে করে দীর্ঘ হতে থাকে। হাসপাতালের দোরগোড়া পর্যন্ত এ রক্ত পতন অব্যাহত থাকে। শিরমাঝির সহযোদ্ধারা বদরপীর ও খোয়াজখিজিরের নামে সাইর গাইতে গাইতে সেখানে উপনীত হয়।
আমন্ত্রিত দলীয় অতিথি একটু আগে যেমন দ্রুত গতিতে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়েছিলো তেমনি কফিলউদ্দিন তার কয়েকগুণ বেশি বেগে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। এ সময় নিচ থেকে উঠে আসা প্রদোষ মাস্টার প্যান্ডেলের সীমানা-বাঁশে হাত রেখে মুখ গুঁজে চুপ হয়ে থাকে। চেয়ারম্যান তার পিঠে হাত বুলান। কফিলউদ্দিন বলে, চেয়ারম্যান সাব- মাষ্টার আগেই কইছিলো, আশুরার দিনে….। আরে রাখ তুমার কথা, সেইডা ত আমিও জানি, তারিখ কি আর ফিরাইয়া দেওয়া যায়? যা হওয়ার তা’ ত অইছেই। আর তা ছাড়া নাও দৌড়ানি কুনু পাপের কাম না।
কফিল : কিন্তুক আর একটা কারবালা ত অইয়া গেল।
চেয়ারম্যান : সব ঠিক অইয়া যাইবো কফিল। আগে ডাঙ্গেরগাঁও-এর শিরমাঝি বাঁইচা উঠুক। তারপরে দেহাইবাম মজা।
কফিল : আর যদি মইরে যায় তাইলেই ত বাজলো ভেজাল। থানা পুলিশ আর কোর্ট কাচারী করতে করতে বাপের নাম ভুইলা যাইবাম।
প্রদোষ : তাইলে প্রদোষ মাস্টার, দুলাল চেয়ারম্যান আর মুক্তিযোদ্ধা কফিলউদ্দিন কেউই বাঁচতে পারবো না।
চেয়ারম্যান : আরে রাহ তুমরার আগাম কথা।
প্রদোষ : কথা এহানেই শেষ। আর নৌকা বাইচরেও আইজ থাইক্যা শ্মশানে দেওয়া অইলো।
চেয়ারম্যান : শ্মশান বল, আর কবর বল আমি দুলাল চেয়ারম্যান বাঁইচা থাকতে তা অইতে দিতাম না।
কফিল : আর আমি কফিল কমান্ডারও দেইখা লইয়াম নৌকা বাইচ ক্যামনে মরে। যুদ্ধের সময় দেশটা মরতে দেই নাই, আইজ নৌকা বাইচও মরবো না। সব যুদ্ধই আমরা জানি।
চেয়ারম্যান : বেশি কইরা ফান্ড জোগাড় কর, আগামীতে আরও বড় কইরা নৌকা বাইচ অইবো।
প্রদোষ : রাখেন চেয়ারম্যান, মানুষের চান্দার টেকায় কুনু কাম বেশি দিন চলে না। মনে রাইখেন, নৌকা বাইচ উইঠা গেলে মারামারি হানাহানি আর মাইয়া ভাগানীর লাইগ্যা উঠবো না। উঠবো টেকার অভাবে।
চেয়ারম্যান : চলো চলো, প্রদোষ বাবুর মাস্টারী শুরু অইয়া গেছে।
কৃত্য পাঁচালি
বদর বদর বলি কিনারে কিনারে চলি ভাটি গাঙ্গে ভাটি গান গাইও থাকিলে জোয়ারে দেরি লগি মাইরো ত্বরাত্বরি বেলাবেলি ঘাটে ফিইরা আইও।
না, কিনারে কিনারে দৌড়ে নাও চলে না, আর ভাটিতেও চলে না। সে সব সময় উজান বায়। কিম্বা তার কোনো উজান-ভাটি নাই। বাদাম নামে তার কোনো পাংখাও নাই। সে আসমানের পংখী নয়। নয় জলের পংখী পানকৌড়ি, ডাহুক, কোড়া কিম্বা জলপিপি। সে তো জলের এক মেরুদন্ডী যান। সে করুণার বাতাসে ভর কইরা চলে না, চলে নিজের বাহুবলে। তবে তারও আছে পাখা বেবাক প্রান্তর জুইরা। সে পাখা কেউ দেখে না। কিন্তুক টের পায়। সেই কারণে একটা জবরদস্ত দৌড়ের নাও চললে অদেখা পাখার ঝাপটানী খাইয়া জলে ওঠে ঢেউ। সেই ঢেউয়ে পাড় না ভাঙলেও গতি কম আর বেশির কারণে কত মানুষের মন ভাঙে।
ঠিক আছে গাও গান বদরের, মাদারের। হাজার বছরের উৎসবে আজ আমাদের আগুন লাগছে। কোথায় তুমি অগ্নিপীর মাদার, সেই আগুন নিভাও। তোমার এক ফুঁৎকারে নিভাইয়া দেও হিংসা, বিদ্বেষ আর কলহের আগুন। কামনার আগুনেও তুমি জল ঢাল বাবা। আমরা আমাদের দৌড়ের নাও ফেরৎ চাই। আমরা তুমার মাজারের গাত্র কালো গাইয়ের দুধ দ্বারা লেপে দেবো। তুমার মোকামের চাইর ধারে আসমানের তারার মত মোমবাত্তি জ্বালাবো। সেই আগুন নিয়া তুমি যত পার বহ্নিউৎসব কর। কিন্তুক আমাদের ভালোবাসার দরগা-ডেরায় আর আগুনের লিকলিকে জিহ্বারে বাড়তে দিও না।
কোথায় পবনবাবা বদর তুমি? ঝড় ঝঞ্ঝার অধীশ্বর বদরপীর মুখ তুইলা চাও। দমকা হাওয়ার ঘূর্ণনে যে আমরার দৌড়ের নাও শুকনা পাতার মত ঘুরে। এই বাতাস বন্ধ কইরা নাওডারে স্থির হইতে দেও বাবা। কুনু দুষ ত আমরা করি নাই যে, জগত জোড়া হাওয়ার মাতম বহাইয়া দিয়া তুমি দূর থাইকা হাততালি দিবা। তুমার এক ঘূর্ণিবায়ুর দাপটে আমরার রঙ যমুনার সব পানি শুকাইয়া গেছে বাপ। সেই যমুনায় আর পানি নাই, রঙিন মৎস্যকন্যা নাই, নাই রঙিলা মাঝি আর নাও। তুমার পবন ঘোড়ারে কও একটু থামতে, সে যেন আর পানি উড়াইয়া আসমানে না নেয়। তুমার পাগলা বাতাস থামাও বাবা, আসমান থাইকা আবার জলের বিন্দু পইড়া রঙ যমুনাটা ভরাট হোক। আসো পীর বদর তুমি, আকিয়াব থাইকা ফের পানির উপর দিয়া পাত্থরে চইরা তুমি আস।
তারা এই সময় দক্ষিণ-পুবে চাইয়া দেখে নদী দিয়া ভাইসা আসে রঙিন কাগজের আস্ত তাজিয়া। তবে কেবল তার কাঠামোটাই আছে। রং বেরঙের কাগজ সব ছিঁড়া ফাঁড়া। বাতাসের ঝাপটায় আর নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাজিয়া তাবুত আর দুলদুলের নাড়িভুড়ি বের হয়ে গেছে। আশুরার দিন অষ্টগ্রামের হাবেলী বাড়ি থেকে এসব বিসর্জন দেয়া হয়। এক সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে তাজিয়া-দুলদুল-তাবুত-বোরাক। যেন ইমাম হাসান-হোসেনের বার্তা নিয়ে ঢেউয়ের দোলার তালে তালে অষ্টগ্রামের কারবালা ময়দান থেকে এসব নিকলীর ঘাটে এসে লাগে। জানি না কোন্ কারিগর বানায় এ বোররাক। অর্ধনারী-অর্ধঘোড়ার এ পাখা শতচ্ছিন্ন হলেও তার দেহ যে আছে অবিকল। বোধকরি মোটা কাগজ দিয়ে শরীরটা তৈরি, কারিগর পাখার দিয়ে নজর দিতে পারে নাই। একজন বাইচাল এই পৌরাণিক প্রাণীকে চিনে ফেলে। এই দেখ দেখ আমার নবীজির বোররাক আসে। এই রকম তাজি বোররাকে চড়েই আমার নবী মেরাজে গমন করিয়াছিলেন। হে অশ্ব-রমণী বোরাক, তুমি আমারে দুইডা পাখা দেও, আমিও চোক্ষের নিমিষে উইড়া যাবো। আহা তুমার পাংখা দুইডা দেহি ছিঁড়া, কি অইলো, সপ্ত আসমানে উঠতে বুঝি বাতাসের বাড়ি খাইছ? নাকি পানির বাড়িতেই আমরার দৌড়ের নাওয়ের মত ভাঙছে তুমার কপাল? সেইডা যা-ই হোক, আমরা তুমার মত গতি চাই। দৌড়ের নাওয়ের গতি ছাড়া গতি নাই। তুমার পিঠের উপর চইড়া আমেনার পুত আমরার হযরত যখন উইড়া গেলেন, তখন অজুর পানি গড়াইয়া পড়ে, আবার আইসা দেখলেন সেই পানি তখনও গড়াইতেছে। তাইলে মাঝখানের সময় গেল কই, কয়েক বছর? আছে আছে, গতি বেশি থাকলে সময় টময় বুঝা যায় না। আর এইবার শুনলাম নয়া কথা। বাইচ দেখতে আইয়া একজন পরফেসার কইলাইন হকিং সাবের কেচ্ছা। অত বড় বৈজ্ঞানিক, কি কয় কিছুই বুঝি না। তাইন কইছুইন সময় বুলে লড়ে না, এক জায়গায় খাড়ইয়া রইছে। এইডা কুনু সম্ভবের কতা? হাঃ হাঃ হাঃ।
প্যাঁচাল বাদ দিয়া পাঁচালি গাও। পানি রাজ্যের অধিকর্তা কে? বাবা খোয়াজখিজির। সবুজ পোশাকের জিন্দাপীর যার চোখের মণিও সুবজ ছিলো। গাও তার গান শুনি। দেও তারে ভোগ কাঁচা দুধ, পাঁচটি কলা, পাঁচ কড়ি পয়সা, পান-সুপারি, হলুদ-আদা, আখের গুড়-বাতাসা, মিষ্টান্ন এক পদ, নতুন হুকা ও কলকীতে সাজানো তামাক আর সাতটি মাটির প্রদীপ। দেখ কার রমণী জল আনিতে যায় লো, সোনার নূপুর বাজে রাঙা পায় গো! দাঁড়াও ভগিনী, নারী তুমি কি রজস্বলা? যদি হও, তবে যাইও না এখন নদীর ঘাটে। পাছে জল অপবিত্র হইলে খোয়াজ খিজির কুপিত হন। ভগ্নি, এমনিতেই আমাদের দুঃখের সীমা নাই। আমাদের দয়া করো বোন। দরকার হলে নদীর সারা জল নর্দমা কেটে তুমার বাড়ি পৌঁছে দিবো। রমণী তথাস্তু করে ফিরে যায় আর শুরু হয় পানিপীর খিজিরের বন্দনা:
আমার নাওখান কে চালাইব রে মাঝি-মাল্লা নাই নৈরাকারে দৈবার পরে খোয়াজ খিজির সাঁ। চতুর দিকে চাইয়া দেখি কুল কিনারা নাই।। পঞ্চ কাঠের নাও যে আমার পঞ্চ পীরে পাহারাদার হায়রে পানি কাটায় দুমের মাদার ছোয়ার হইছে মালেক সাঁই নৈরাকারে দৈবার পরে খোয়াজ খিজির সাঁই।। ইমাম হুসেন দাঁড় টানিবে নূরনবী কান্ডারি হবে আলী সাহেব মাস্তুলেতে পাই, হায়রে খোয়াজ খিজির চরনদার হইল জল ফালাইব মা গঙ্গায়।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মা গঙ্গায়। খোয়াজ খিজিরের কথা না এইবার রাখিয়া, মা গঙ্গার কথা বলি শুন মন দিয়া। তবে খিজিরকে ছাড়াও আবার মা গঙ্গার কথা চিন্তা করা যায় না। এই জনমে হয় নাই বিয়া পর জনমে হবে। তা হলে গাই খোয়াজ-গঙ্গার বিবাহের পাঁচালী:
পাতালেতে বাস করে পাতালেই খেলা তে কারণে গঙ্গা দেবীর গায়ে উঠল জ্বালা। গঙ্গা বলে, ওগো খিজির আমার কথা ধর অকুমারী রইছি আমি আমায় বিয়া কর।
খিজির বলিলেন, ছিঃ ছিঃ এই কি কথা কইলে মাগো, কথার নাই নিশানা, আমরা হইছি ফকির-খিলফার জাত, বিয়া করতে মানা। কিন্তু খিজিরের কথা শুনে মা গঙ্গাও কম যায় না, তার গায়ে উঠলো জ্বালা, দেখিবো কেমন পীর আমারে ভাড়াইলো:
হারে তুমি যুদি সহায় থাক ওগো নারায়ণ খিজিরকে ভুলাইতে আমার লাগবে কতক্ষণ। এই কথা বলিয়া গঙ্গা সিংগার করতে গেল এইক্ষণ গঙ্গার কথা আমার বলতে সুরণ হল।। তারপরে কি হইলো? কি হইলো, কি হইলো? শুনেন যত ভাই বন্ধু শুনেন মন দিয়া অকুমারী ছিল গঙ্গা না হইছিল বিয়া। গঙ্গা কয় নামটি আমার সংসারে রাখিব বার বছইরা কইন্যার রূপে খিজিরকে ভুলাব। খিজির বইলাছেন আমি এই কামনা করিব আড়াই রোজের শিশু অইয়া গঙ্গার দুগ্ধ খাব।
হ্যাঁ ভাই, এ সবই বিধির লীলাখেলা। সাধারণ মানুষ তারে বুঝতে নারে।
ইমাম বলছে বিধির লীলা কে বুঝিতে পারে তৎক্ষণাতে কুলে থাইকিয়া ছেইলা আরো খিজির রূপ ধরে। যেমতি আছিল খিজির তেমতি হইল গোস্বা অইয়া গঙ্গা তারে ধূলায় ফেলি দিল। বিয়া বইবার সাধ ছিল গঙ্গার খিজিরের সাথে এখন সরমিন্দা হইয়া গঙ্গা লাগিল কান্দিতে। এই মতে জিন্দাপীর জেন্দা হইয়া গেল গঙ্গা দেবীর বিয়ার খাইশ জিতেতে রইল। এই বিয়া হইবে ভাইরে আশরের ময়দান সগল অবুঝ শিশু সব হইবে বিয়ার মেজবান।
হ’ ভাই, ভাবতে অবাক লাগে যে, জুলকারনাইন বাদশাহর প্রধান অমাত্য খোয়াজ খিজিরের বিয়ের বরযাত্রী হবে এই ছোট ছোট পোলাপান। তবে হ্যাঁ, যাদের আশা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছে, যারা জীবনের স্বাদ গ্রহণ করবার আগেই মা-বাবাকে দুঃখের গঙ্গায় ভাসাইয়া দিয়া, এই পিরথিমীর মায়া ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, বিধির লীলায় তাদের জন্য জিন্দাপীরের এই পুরস্কার।
মিজান-মদিনার প্রত্যাবর্তন, প্রদোষ মাষ্টারের আশাবাদ ও ভবিতব্যের হাতছানি
তুলশী তলায় লিলিরাণী গড় হয়ে প্রণাম জানায়। তার সিঁথিতে সিঁদুর। হাতে তার ধূপধূয়ার উপাচার। সদা চঞ্চলা চপলা লিলি এখন রাশভারী। তার হাতে উঠেছে শাঁখার চুড়ি। পূজা অর্চনা সেরে আমাদের লিলিরাণী জলকে চলে সোয়াইজনীর ঘাটে। উল্টা দিক হইতে ফেরারী জীবন ত্যাগ করিয়া মিজান-মদিনা ফিরিয়া আসে। পথিমধ্যে দেখা হইলে অচিনা কাউকে ভাবিয়া লিলি মাথায় বস্ত্র টানিয়া নেয়।
মিজান : লিলি দি, তুমার মাথায় সিঁদুর? আর কেডা দৌড়ের নাওয়ের যাত্রা সাজাইয়া দিবো?
লিলি : মিজান-মদিনা ফিরা আইলি? আছিলি কুন হানে অতোদিন?
মদিনা : তার কুন ঠিক আছে দিদি। খোলা আসমানের নিচেই আমরার সংসার পাতছিলাম।
মিজান : হ’ দিদি। দৌড়ের নাওয়ে ত আর ছৈয়া নাই যে, আরামে থাকুম। গেছিলাম ত দৌড়ের নাও নিয়াই পলাইয়া। কত যে কষ্ট!
লিলি : শুনছিলাম ত গেছস কুটুম বাড়ি। কষ্ট কিসের?
মিজান : না গো দিদি, তুমরার মদিনা বিবি কয় দরকার অইলে মক্কা যাইবাম, তবু না যাইবাম কুন খেস১৮ বাড়ি।
লিলি : কারণ কি লো?
মিজান : তাইনের বড় শরম লাগছিল।
লিলি : তারপরে?
মিজান : তারপরে আর কি, তিন দিন তিন রাইত মাইঝ দরিয়ায় ভাসি। ঝড় বিষ্টি বাদল নাই, রইদ-গরম দুপর নাই-ভাসি ত ভাসিই। একটু কিনারে আসলেই মানুষ চকমকাইয়া ওঠে, আঙ্গুল তুইলা দেখায়। আবার নাও ভাসাই গাং থাইক্যা গাঙ্গে।
লিলি : কুন বিপদ আপদ অয় নাই?
মিজান : কত যে বিপদ দিদি! কি আর কইবাম। রাইতে ডাকাত পড়ে। আবার বাহুতে শান দিয়া বৈঠা মারি, বুকের পাঁজর ভাইঙ্গা আসে। ডাকাত বিদায় হইলে জলপুলিশের টর্চের আলোয় চোখ ঝলসাইয়া আবার আন্ধাইর অইয়া আসে। আর আমার বধূ করে আল্লা আল্লা। উজ্জ্বল আলো সহ্য করতে না পাইরা নাওয়ের গুড়ার নিচে গিয়া ঢুকে। পুলিশ কয় বাইর হ’ খারাপ মাইয়া মানুষ, চল থানায়, রুলের বাড়ি খাইলে বুঝবি গতর বেচতে মজা কত! আমি হাতে পায়ে ধইরা দারোগা সাবরে কত বুঝাই, হে কুন খারাপ মাইয়াছেলে না, আমার লগে স্বজ্ঞানে ভাইগা আইছে স্যার, আমি একজন বাইচাল, নৌকা বাওয়াই আমার ধর্ম, একটু পরেই খালার বাড়ি চইলা যাইবাম। দারোগার সাথে কথা শেষ অইতে না অইতেই চুদির ভাই সিপাই আমার পিঠে দেয় বাড়ি ধুমধাম। গরুর মত সেই বাড়ি সহ্য কইরা দেহি আর একটা কেরায়া নাও দইড়া আইতাছে। সেই নাওয়ের মাঝি বলে, দারোগা সাব ছেড়াডারে আমি চিনি, ভালা মাইনষের পুত। আর যদ্দূর জানি মাইয়াডাও ভালা মানুষের সন্তান। তারারে ছাইড়া দেন দারোগা সাব। দারোগা সাব মাঝিরে আগেই চিনতেন। কারণ সে আছিলো আগের দারোগার নাওয়ের মাঝির শালা। আগের দারোগা টেনেসফার অইয়া যাইবার আগে নয়া দারোগার কাছে মাঝিরে চিনাইয়া দিয়া যায়। তারপরে অত কষ্ট সহ্য কইরা মদিনা বেগম মুইয়ের বাড়ি গেলো তো গেলো, গাধার মত পানি ঘুলা কইরা।
লিলি : যাত্রার আগে আমার হাতের গামছা নিয়া গেলে ত আর ফিরা আইতে অইতো না।
মিজান : ভুল কইলা দিদি, তোমার মন্ত্রসিদ্ধ গামছা নিতেই ফিইরা আইলাম। দেও একটা নয়া গামছা।
মদিনা : কিন্তুক দিদি, তুমি ত এহন জামাইবাবুর ঘর কর। আর কি মন্ত্র পড়বা কুন দিন?
লিলি : ধুর পাগলী, কুমারী ব্রত কইরা কেউ সংসার ধর্মে যাত্রার আচার করতে পারে না। তার জন্য লাগে একজন শাঁখা সিঁদুরওয়ালী। কিন্তুক পরধর্মের আচারে কি তরা বিশ্বাস করস?
মিজান : আরে দিদি জাত-ধর্ম কুন ব্যাপার না। কিসের আবার হিন্দু মুসলমান? দেও আমার মাথায় লাল সালু বাইন্ধা নাওয়ের গলুইয়ের মত, আর মদিনারে দেও গামছা।
মদিনা : তবে যা তা গামছা আমি নেই না দিদি। যেই গামছায় দই বাইন্ধা চিপা দিলে চুয়াইয়া না পড়ে তারে আমার পছন্দ। সেই গামছা পারবা তুমি আইন্যা দিতে?
লিলি : ওলো ছেমড়ি ক্যামনে শিখছস অত কতা? পিরীত কইরা? ছোট বেলায় শুনতাম ঠিকই সত্য কথা, প্রেমে পড়লে মানুষের মুখে খই ফুটে।
মদিনা বিবি মক্কা যাওয়ার আশা ত্যাগ করিয়া বাড়ি ফিরে। ঘাট হইতে সেই বাড়ি বেশি দূরে না। ভাগ্যলক্ষ্মীর হাত ধরে তারা বাড়িতে প্রবেশ করে। সারা পাড়ায় হই চই ওঠে। সকলেই একটি বাড়ি অভিমুখে দৌড়াইয়া আসে। পিঁপড়ার দঙ্গলের মতো তৈরি হয় মানুষের সারি। জয়াদি জুকার আর লিলি রাণীর উলুধ্বনিতে কারো কারো কানে তালা লাগে। দূরে দাঁড়াইয়া ইমাম সাব মুচকি হাসেন আর আঙ্গুল তুলে কি যেন বলতে চান। একজন বলেন, চুপ থাকেন ইমাম সাব, আপনের কাম আপনে কইরেন, এহন কুন কতা কইয়েন না। ইমাম সাবও কম রসিক না, তিনি বললেন অন্য কথা- হ, বুঝলাম, যেই দেশের যেই ভাও, নাও মাথাত দিয়া মাথলা বাও!১৯ ছুটে আসা মানুষের দল হয়ে যায় পিঁপড়ের সারি, তবে প্রদোষ মাস্টার নামের একটা বড়ো পিঁপড়ে যায় উল্টো দিকে ধেয়ে। পাড়ে গিয়ে সোয়াইজনীর জলের সাথে তিনি বুঝাপড়া করেন।
প্রদোষ : শুনলাম মিজান মদিনা ফিইরা আইছে। কাইলকা ডাঙ্গেরগাঁয়ের শিরমাঝির সিলাই কাটবো উপজিলা হাসপাতালে। আর ঐদিকে কফিলউদ্দিনও মোটামুটি কামিয়াব। তার দেওয়া মীমাংসা দশ গেরামে মাইনা নিছে। তাইলে কি আগামী বছর আর একবার নাও দৌড়ানি অইবো? কিন্তুক এক বছর ত অনেক দেরি।
কয়েকজন এসে মাস্টারকে ঘিরে দাঁড়ায়। কি কতা কন মাস্টার জলের সাথে?
প্রদোষ : কই যে, নাও দৌড়ানির মৌসুম হইল শেষ। ভাদ্র গিয়া আশ্বিন আইলো। আর দুইদিন বাদে জলে মারবো টান। নিয়ম ভঙ্গ কইরা ইচ্ছা অইলেও নাও আর দৌড় দিতে পারবো না।
অন্যেরা কয় : তাতে কি, আর একবছর করবো অপেক্ষা।
প্রদোষ : জল দেবতা জানে, সকলের তর সয় না। সারা জনম নৌকা পুষছি, কুন দিন নিজের হাতে বৈঠা ধরি নাই। নৌকার সাথে ছিলো আমার অতি দূর, আবার খুবই নিকটের সম্পর্ক। কিন্তু প্রদোষ আর নৌকার মধ্যে কুন দূরত্ব থাকতে পারে না। সেই দূরত্ব কেবল দীর্ঘ করবে প্রতীক্ষার পালা। প্রদোষ মাস্টার, তুমি নিজেই এবার নৌকা হবে। একবার নৌকা হয়ে কল্পনা কইরা দেখ বাইচের কী কষ্ট! দেখ মাস্টার, দুই পায়ে না দৌড়াইয়া সরীসৃপের মত বুকে ভর কইরা চলতে ক্যামুন লাগে।
প্রদোষ মাস্টার জলে যাবে না হাওয়ায় যাবে, বুঝে উঠতে পারে না। তবে সে কাঁধের সমস্ত ভার নেমে যাওয়ায় নিজেকে খুব হালকা মনে করে। এতোই হালকা যে, সে শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে শূন্যের উপর দুলতে থাকে। বিদ্যুতের গতিতে অন্যেরা মাস্টারকে ধরে ফেলায় তার গতরে দৌড়ের নাওয়ের অবয়ব নেমে আসে। হেঁইয়া হো হেঁইয়া হো বলে দৌড়ের নাও সামনে এগিয়ে চলে।
(২১.০৪.২০০০-২৩.০৬.২০০০)