জুনিপোকের মত একবিন্দু আলো বর্ষার নতুন পানিতে তিড়বিড় করে হাঁটে। সাপের লেজের মত এঁকেবেঁকে যায় কখনও, কখনও সোজা নাক বরারব। কখনও বা থামে কচ করে গেঁথে ফেলে কাক্কে, ওল্লা বা ডিমওয়ালা বালে। বাত্তি কামলা সামিদের অবয়ব বাত্তির পেছনের অন্ধকারেই মিশে থাকে জনম কি জনম। আমরা শুধু এই বাত্তি কামলার গল্পই শুনি, কখনও দেখি না। সকালে বাবু বাজারের নামায় রাতভর আত্তরে গাঁথা মাছগুলো একটা পুরনো আঙ্গের মধ্যে ডিমওয়ালা পেটটা ভাসায়ে চিগান দিয়া থাকে। সামিদের বউ রুক্কির মুখের সাথে মরা বালে-র কোন পার্থক্য আমরা নিরুপণ করতে পারি না। দুইজনের মুখই আসমানের দিকে চিগান দেওয়া। দুজনেরই পেট ভরা ডিম। রুক্কির পাণ্ডুর মুখ মরা বালে-র পেটের মতই ফ্যাকাসে আর মাছি ভনভন আশপাশ।
বাজারি জিগায়
কিলো – মাছদি অক্করে আক কইরে রইচে!
সারা রাইতের মারা যে-
খালি কি মাছই মারা না আরো কেউ!
ভাইছাব যে কী কয়!
রুক্কি হাসে তার হলুদ রঙের দাঁতগুলো বাইর কইরা। ভাইসাব ঘুরে ঘুরে মাছ দেখে আর রুক্কির সাথে করে ফাসুরি। ভাইসাবদের ফাসুুরি আর কাকুদের তাচ্ছিল্যকে উপেক্ষা করেই রুক্কি এই বাবু বাজারের নামায় প্রতিদিন মাছ বেঁচে চাল কিনে বাড়ি যায়। তাদের সুখের সংসার একবেলা খাইলো তো আর চিন্তা নাই। ফেদ্দুচ্ছের বাপ যায় উগাড়ের উপর আর রুক্কি যায় পাড়ায় এর-তার মাথার উকুন মারতে। সামিদ মিয়া তো আর কোন কাজও পারে না। এই একখান কাজই পারে বাত্তি বাওয়া। জগতের সব মানুষ খালি হাতে ফিরলেও সামিদ মিয়া ঠিকই এক আঙ্গে না হোক আধা আঙ্গে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে। এই দুর্মূল্যের বাজারে আধা আঙ্গে মাছ অক্করে কম না। গণকেও কইছে, ফেদ্দুচ্ছের বাপ মাচ্ছে রাশি।
সংসারে সামিদের বালবাচ্চা কয়টা তা খাওয়ার সময় গুনে বলতে হবে। ওদেরকে শুধু খাওয়ার সময় দেখা য়ায়। বাকি সময় এর-তার উঠানে গুলি খেলে অথবা ধুলার মধ্যে সাঁতার কেটে পার করে দেয় দিনমান। সামিদের এই সংসার মোরগমুরগীর সংসারের চাইতেও খারাপ। কারো কোন ঠিক ঠিকানা নাই। কেউ রাত জাগেতো কেউ দিনমান বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। পোলাপানদের বনবাদারেই বাসা। তয় তা নিয়ে সামিদের বা রুক্কির কারো কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। থাকবো কেমনে। মাথা থাকলে তো ব্যথা থাকে। গুরু ছাগলের মাথাও নাই ব্যথাও নাই। চাট্টে খাইলো তো আর খবর নাই। কারো সাথে কারো কোন কথাবার্তা নাই। তয় খাবার সময় পোলাপান কও আর জোয়ান মানুষ কও সবাই আইসা হাজির। খাইলো তো লাপাত্তা। সামিদ-রুক্কি এইভাবে জীবনযাপন করতে পারলেও সমাজ তো তা পারে না। আল্টিমেটলি সমাজের একটা দায়িত্ব আছে না। তাইতো একদিন উত্তরপাড়ার বজলু মেম্বার সামিদরে আইসা ডাইকা তোলে।
কিরে সামিদ! ও সামিদ, আছস নি ঘরে?
সামিদ ঘরে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি, ওতো মরার মত ঘুমায়। বজলু মেম্বার উঁকি দিয়া দেখে। ‘হ, হালায় তো ঘুমায়’। এবার সে ঘরে ঢুকে ধাক্কাধাক্কি করে সামিদরে উঠায়।
কেরে ডাহ তে!
আরে ওঠ! তোর লাগি জব্বর খবর আছে।
কী কও?
শোন, ব্যাংক থেকে লোক আইছিল। তোর তো ভালা খবর আছে। ওরা চায় তরে টাকা দিবার। মাছের ব্যবসা করবি। তোর তো আবার মাচ্ছা রাশি। আমারে জিগাইলো তুই লোক কেমন, কী করছ। আমি কইলাম রাতে বাত্তিবাই আর দিনে ঘুমায়। ওরা কইলো একটা জোয়ান মানুষ এমন কর্মহীন জীবনযাপন করবো তা কেমনে হয়। তোর বউ কী করে তাও জিগাইলো। তাও কইলাম। বাড়ি বাড়ি গিয়া বেডিগোর মাথার উকুন মারে। আর গল্প করে। হেরা শুইনাতো টাসকি। কী কয়! এই যুগেও এমন মানুষ আছে? তারে কাজে লাগাইতো হইব। মেম্বার সাব আপনি কথা বলেন। অফিসে নিয়ে আসেন। তোর বাচ্ছাকাচ্ছা ইসকুলে যায়না শুইনা বড় রাগ হইল। পোলাপানরে ইস্কুলে পাঠাস না কেন। ইস্কুলে গেলেতো মাসে মাসে ২০ কেজি চাল পাবি, পোলাপানগুলোও মানুষ অইব। এই বুঝও কী মাইনষের দেয়া লাগে। কিরে তোর বউ কই? ডাক ওরে। সামিদ চোখ কচলাইতে কচলাইতে এবাড়ি ওবাড়ি যায়। এই কই গেলি, ফেরদুচ্ছের মা। কই গেলি। তিন বাড়ির পর শামীম্মের মা’র বাড়ি থেইকা রুক্কিরে ডাইকা আনে সামিদ। এই দেখ বজলু ভাই কী কয়।
কী কয়?
ব্যাংক নাকি টেহা দিবার চায়!
কী গো বজলু ভাই ! ব্যাংক কেন টেহা দিবার চায়। আমরারে আবার বেচ্চা ফালাইচো নাতো?
কিলো রুক্কি! মানুষ কয় তুই নাকি বেক্কল! বেক্কল কেমনে এমন টেডা টেডা কথা কয়।
বেক্কলই তো, না হয় ব্যাংক কেন টেহা দিবার চায়। নাগো ভাই, আমরা গরিব, গরিবের মত থাকি। অফিস আদালত না চিনাই বালা।
হঠাৎ রুক্কিরে খুব বৈষয়িক মানুষের মত লাগে। সামিদও একটা ধান্ধায় পড়ে যায়। ভরা ঘুম চোখে নিয়া কটকটা রোদের মধ্যে খালি ঝাপসা সরষে ফুল দেখে। বারবার চোখ মুছে, চোখ কচলায়। ব্যাংকের ঘোর লাগা চোখ তাও বজলু মেম্বারের মুখই দেখে।
আচ্ছা হুন। চিন্তা কর। তোর সুমুন্দির সাথে কথা ক। তারবাদে আমারে জানাইস।
বলে বজলু হনহন করে চলে যায়। সামিদ আর রুক্কি কী এক দ্বন্দ্বের মধ্যে নিয়ত ডুবতে থাকে। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। এমন কী তাকায়ও না। হঠাৎ সামিদের মুখ ফসকে একটা কথা বাইর হইয়া আসে।
‘কিলো, কী কয়! বুঝলি কিছু?’
‘আগো এরার কথা। বজলু টাউটরে তুমি চেনো না। কোন প্যাঁচ থেইকা কোন প্যাঁচ লাগায় তার কোন ঠিক আছে নাকি। তয় সোনা ভাইরে তুমি জিগাও। এরা আমাদের টেহা দিবার চায় কে!’
‘আমার কেমন জানি ডর ডর করে। টেহাপয়সার কারবার হুনলেই মাথা ঘোরে। থাক, আমরার অত টেহাপয়সার দরকার নাই। বাত্তিবাও; এইডা দিয়া বালাই আছি।’
‘হ, বাদ দে এই চিন্তা। এহন যা, ঘুমাইতে দে’। বলে সামিদ উগাড়ে উঠে সটান শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম! ঘুম কই গেল? চোখ ভরা ঘুম ঝাটায়ে বিদায় করতে উঠেপড়ে লাগে মাথা ভরা চিন্তা।
জন্মের প্রথম সামিদ আজ ঘুমাতে পারলো না। শুয়ে জেগে থাকার বিস্বাদ অভিজ্ঞতা হলো আজ। সামিদ কী টাকার চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে? ঘুমের বদলে জেগে থেকে স্বপ্ন দেখছে। কাড়ি কাড়ি টাকা, টাকার পেট ভর্তি টাকা। খালি টাকায় টাকা। জাল ফেলে আর আঙ্গে ভইরা সামিদ মাছের বদলে টাকা নিয়া বাড়ি আসে। বিছানাবালিশ, হাঁড়িপাতিল সব ভরা খালি টাকা।
‘দুর বালের টেহা, বালের টেহার আমার দরকার নাই। এ কই গেলি। গামছা দে।’
বলে বটে কিন্তু সামিদ নিজেও জানে গামছা দেওয়ার কেউ নাই। নিজেই গামছা কাঁধে নিয়া নদীর দিকে পা বাড়ায়।
কতদিন পর আজ দুপুরবেলায় সামিদ নদীর পাড়ে যাচ্ছে তা নিজেও হিসাব করে বাইর করতে পারে না। কী সুন্দর চকচকা রোদ। গাঙ্গের পানি দুই টাকা পাঁচ টাকা কয়েনের মাত খালি ঝিলিক মারে। সামিদ ভুলে যায় এই ভরদুপুরে কেন সে গাঙ্গের পাড় আইছে। গতর ধোয়া একটা কাজ হইতে পারে। কিন্তু ডুব গোছল বাদ দিয়া পানির এই পয়সা খেলা দেখতে সামিদ মিয়ার বড় ভাল লাগতাছে। টেহাপয়সা জিনিসটা মাছের মতই, যার কপালে থাকে তার বাড়ি আইসা উজায়ে ওঠে। আর যার কপালে নাই সে গাং সিইচা উঠান বানাইলেও মাছ পাইবো না।
মাছ নিয়া ভাবতে ভাবতেই মাছের টানে সামিদ গাঙ্গে নামে। পানির ছোঁয়া লাগার সাথে সাথে সামিদের সারা শরীর পানির মাঝে মিশে যেতে থাকে। সামিদ পূজা শেষের মূর্তির মতই গলে গলে নদীর তলায় চলে যায়। প্রথমে সমিদ ভাবে পানির নিচে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক অইবো না। দমফুডা লাইগা মইরা যাইতে পারে। কিন্তু কী এক অচমবিত কারণে সামিদের দমফুডা লাগে না। সে ডাঙ্গার মতই দম নেয় দম ফেলে। নদীর তলে মাছদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। মাছরা তার খোঁজখবর নেয়। প্রথমে সামিদ বুঝে না মাছরা তার তথ্যতালাশ করে কেন। তার মনে হয় এ যেন পাড়াপড়শীর মতই কথা বলে টিসটাস করে। নিজেকে এই পাড়ার এক মাচ্ছা রাশীর ছেলেই মনে হয়। ঘুরতে ঘুরতেই দেখা হয় একটা বড় দাঁড়িওয়ালা গজার মাছের সাথে। গজার মাছ সালাম দিয়াও বসে নাই, সে এসে কদমবুচি শুরু করে।
‘কী ব্যাপার, কী আশ্চার্যি, তুমি সেলাম কর কে?’
‘ভাইজান, কেমন আছেন ভাইজান, আপনার পায়ের ধুলা দেন। আপনারা বড় নেকি মানুষ। আপনার বাবা আমার পীর আছিলো। উনার গান শুনতে কত গেছি আপনাদের বাড়ির পিছনের পাগাড়ে। বাজানের মৃত্যুর পর আর যাওয়া হয়না। ভাইজান, আপনে কেমন আছেন ভাইজান। আম্মাজান যে মারা গেছেন সেই খবর আমি পাইছি নশুখলার বোয়ালে-র কাছে’।
সামিদের বহুদিন পর তার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা দেখতে কেমন ছিল? বাবার কি দাঁড়ি ছিল? মাথায় চুল কি ছিল? সামিদ কিছুতেই সম্পূর্ণ আদলটা মনে করতে পারে না। খালি মনে হয় মাথায় গামছার গোমটা দেওয়া একটা ছায়া ছায়া ভাব, নড়াচড়া না করেই হাঁটাচলা করে। মাটি দুখ পাইবো বইলা জোরে হাঁটেও না। গলার আওয়াজে কীটপতঙ্গের ঘুম ভাঙতে পারে বইলা জোরে কথা কয় না। দোতারাটা কখনও বুকে রাখে কখনও গলায়। কোথাও রাখতে চাইলে জায়গাটা আগে ফুঁ দিয়া পরিষ্কার করে লই। তারপর দোতারাটা সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মত শুয়াইয়া রাখে। বারবার ঘাড় ঘুরায়ে দেখে শিশু আবার কান্দে কিনা।
‘ভাইজান আসেন এই টিলাটায় বসেন। আমি গজান্নিরে খবরটা দিয়া আসি। সেও বাজানের গানের বড় ভক্ত ছিল।’
সামিদ টিলাটায় বসে আর শুনে বাবার গলায় গান। কতদিন হয় বাবা মারা গেছে! এত বড় গাতক বাবার পোলা গানবাজনা কিছুই পারে না। পারে খালি মাছ ধরতে। তাও বাত্তি দিয়া। ছোটবেলায় বরশি দিয়া মাছ ধরলে বাজান কইতো-
‘এই নিষ্পাপ মাছগুলারে কেন বাবা তোরা ফাঁদ দিয়া ধরিস। বরশিতে মাছ যখন আটকা পড়ে- না পারে টান দিতে না পারে বাইজা থাকতে। আহারে কী অসহায়! মালিক তুমি কোন বিচারে এই নিষ্পাপ মাছগুলারে ফাঁদে ফালায়ে মার। তুমি নাকি দয়ার সাগর, অকূলের কূল, অসহায়ের সহায়। তোমার কুদরতের সব কথাই মিছা মনে হয়। তোমার নিষ্ঠুরতার কোন কূল কিনারা দেখি না দয়াল’। বাজান ভেউ ভেউ কইরা কান্দে। আমরা বাড়ির সবাই মিটমিট কইরা হাসি। বাউলের পাগলামি।
ভাইজান আসেন। গজারের সাথে গজান্নি আসে হাজার খানেক বাচ্ছা নিয়া। সারা নদী মনে হয় গজার মাছের দখলে চলে গেল।
ভাইজান খালি আমার পোনা দেইখেন না। মুর্শিদের দোয়ায় সবারই এই রকমই বালবাচ্ছা। না হয় এত ধরাধরির পরও টিকে আছি কেমনে কন। তয় শুনেন আপনারে বলি। আপনিতো জানেন মাছের ঘরবাড়ি। তাও বলি, এই বেঙলা চরাবাঁধা হইলো গিয়া মাছের কাড়ি। এই কাড়ির যদি আপনি একটা গর্তেও মাছ অল্প অল্প করে ধরেন এই ধরেন গিয়া এক আঙ্গে আধা আঙ্গে আর কী। তাইলে সাত জনমেও মাছ ধইরে শেষ করতে পারবেন না। কাড়িটা হইলো গিয়া আপনার কাইমের বাউলি কালি মন্দির থেইকা পশ্চিম দিকে সোজা নাক বরাবর, এক্কেরারে বেঙলার মুখটাই। নদীর পাড়ে দেখবেন একটা হিজল গাছ আছে তার দশহাতের মধ্যেই’।
পুরা কথাটা শেষ করার আগেই কী এক অজানা তাড়নায় সামিদ পানির উপর ভেসে ওঠে। উঠেই মনে হয় এখনই একবার জায়গাটা ঘুরে দেখা দরকার। আবার মনে হয় এইসব জায়গা তো তার সবই চেনা। দেখার কিছু নাই। রাতে বাত্তি হাতে গেলেই চলবে। রাতে বাত্তি হাতে সামিদ ঠিক ঠিক সেই হিজল গাছের তলায় গিয়া হাজির। গুনে গুনে দশহাত জায়গা সে ঠিক করে পশ্চিম দিকে। বাত্তি কামলা সামিদ বাত্তি পাড়ে রাইখা নদীতে নামে কাড়ির মাছ হাতে ধরবে বলে। কাড়ির মাছ হাতেই ধরতে হয়। একটা ছোট্ট গর্তের মধ্যে দিনের পর দিন মাছ ধরা যায় তাও শেষ হয়না এই হইলো গিয়া মাছের কাড়ি, মাছের খনিও বলতে পারেন। কাড়ির মাছ ধরার উন্মাদনায় সামিদের কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে। সে এক হাঁটু কাদাপানিতে নেমে কাড়ি খোঁজে। ডানে খোঁজে বামে খোঁজে সামনে পেছনে চারদিকেই খুঁজে কিন্তু না। কাড়ির কোন নামগন্ধও নাই। গজার মাছ কী বলছিলো তা মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারে না। নিজের উপর বড় রাগ হয় কেন কথাটা শেষ করার আগেই ডুব থেইকা উইঠা এল। আর একটা মিনিট থাইকা কথাটা শেষ কইরা এলে কী এমন ক্ষতি হয়তো। সারাটা জীবন সামিদ না বুইঝাই ভাব দেখাইলো বোঝার। নিজের উপর বড় রাগ হয়। কিন্তু রাগ করার সময় নাই। যেভাবেই হোক কাড়ি খুঁইজা বাইর করতে অইব। সামিদ খোঁজে পাগলের মত। খুঁজতে খুঁজতেই ফযরের আযান পড়ে। গাবন্নিরা ঊলুধ্বনি দেয়। হঠাৎ মাছবিহীন সকাল হয়ে যাওয়াতে সামিদের প্রথমে বুক ও তারপর পেট ক্ষুধায় নাকি আতঙ্কে মুচড় দিয়া ওঠে। অনেকগুলো বাচ্চার না খাওয়া মুখ ভাসে সকালের এই সূর্যবিহীন আলোয়। সামিদ কী করবে বুঝতে পারে না। রুক্কি তো বিশ্বাসই করবো না যে সারা রাত মাছই খুঁজছে। সামিদ অবসন্নতায় কুঁকড়ে যাওয়া একটা মন আর ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়া একটা দেহ নিয়ে চোরের পায়ে ঘরে ঢুকে সোজা উগাড়ের উপর সটান। ছেঁড়া কেঁথাটা দিয়ে এমনভাবে নাক মুখ ঢাকে যে কেউ টেরই পায়না সামিদের উপস্থিতি। সময় যায় সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ক্ষুধা। পানির তেষ্টায় বুক ফাটে কিন্তু সে কাঁথার ভিতর থেকে বাহির হওয়ার সাহস করে না। সবার চোখের সামনে লুকায়ে থাকার ম্যাজিক খেলায় সামিদ নিমজ্জিত হয়।
ম্যাজিকের ঘোরলাগা তন্দ্রায় রুক্কি এসে ডাকে।
‘এই ওঠো। জাও রান্না করছি। একটু খায়ে ঘুমাও’।
‘কী কচ? চাল পাইলে কৈ?’
‘চাল ঘরেই ছিলো। প্রত্যেকদিন রান্নার চাল থেইকা এক মুঠ উঠায়ে রাখতাম। তা দিয়াই জাও রান্না করছি’।
সামিদ আর কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা জাওয়ের বাসন নিয়ে চার-পাঁচটা বাচ্চা ছেলেমেয়ের সাথে নিজেও সুবোধ বালকের মত খেতে বসে।
সামিদ খায় বটে তবে খাওয়ার চাইতেও গত রাতের কাড়ি খুঁজে না পাওয়ার বেদনা আর অবসন্নতা কাটিয়ে জাওয়ের স্বাদ মুখে লাগছে বলে মনে হয় না। ফুতুৎ ফুতুৎ কইরা জাও গিলে না কাদা গিলে তা বুঝতে পারে না।
সামিদ শেষ বারের জাওটা মুখে নিয়াই হনহন করে বাইর হইয়া যায় সোজা বজলু মেম্বারের বাড়ি।
বজলু ভাই বাড়িত আছ?
ঘরের ভিতর থেকে বজলু আওয়াজ দেয়। কে সামিদ নি, আও।
সামিদ ঘরে ঢুকে মাথা নিচু করে বসে থাকে। কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারে না। বজলু সবই বুঝে।
কি সামিদ তোর সমুন্দির সাথে কথা কইছিলি।
সামিদ মাথা নাড়ে।
একটু পরামর্শ করলে পারতি। মরুব্বিতো। তোরে তো উনি খারাপ বুদ্ধি দিবো না। আচ্ছা শোন এত বুঝাবুঝিরও কিছু নাই। ব্যবসা করুম আমরা। আমরা বুঝলেই হইলো। কী কচ।
‘হ বজলুভাই।
বজলু আর সামিদ এক বসাতেই ফাইনাল করে ফেলে ব্যাংকের লোন, পুকুরের চুক্তি, মাছের পোনা, পোনার খাবার, জাল-খুটি-ডোলা-আঙ্গেসহ মৎস্য ব্যবসার যাবতীয় সরঞ্জাম। বজলু মেম্বার করিৎকর্মা লোক। সে সব কিছু ম্যানেজ করার দায়িত্ব নেয়। সামিদ শুধু মৎস্য খামার দেখাশুনা করবে আর ব্যাংক লোনের জন্যে করবে দরখাস্ত। ইনিশিয়াল টাকা পয়সা যা লাগে বজলুই ম্যানেজ করবে। কথা পাক্কা। সামিদ আবারও হন হন করে নদীর পাড়ে যায়। নদী পাড়ে দাঁড়ায়ে সে গজার মাছকে নাকি নিজেকেই উদ্দেশ করে বলে-
শালার মাছ- খাড়া, পুকুরে চাষ কইরা দেখাবো মাছ কীভাবে ধরতে অই!
খুব বেশিক্ষণ সামিদের নদীপাড়ে মন টিকে না। সে আবারও হনহন করে বাড়ি চলে আসে, এসেই সোজা উগাড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামিদ ঘুমবিহীন স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়। গতকাল থেকেই সামিদ স্বপ্নে বিভোর। খালি মাছ ভাসে, আশপাশ দিয়া মাছ খালি টাকাপয়সার মত উড়াউড়ি করে। সামিদ স্বপ্নের ফ্যাসাদে হাবুডুবু খায়, ডুব দেয়, ভেসে ওঠে, মাছের সাথে করে টিসটাস, কথা কয়, মাছেরা সামিদের উপস্থিতি টের পেয়ে কেমন যেন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। মনে হয় মাছদের যেন আজ মুসলমানি। চারদিকে বাদ্যবাজনা, নতুন লুঙ্গি, নতুন গেঞ্জি, মাইকে মুজিব পরদেশীর গান ‘আমি বন্দি কারাগারে’। আবার একটু পরে নুনু কাটা যাবে এই চিন্তায় কিছুটা ম্রিয়মানও। সামিদের কেমন যেন ডরডর লাগে। গুনি কী আইসা পড়ছে? নুনু কি আমারটা আগে কাটবো না আমিদেরটা। সামিদের কেমন যেন পালায়ে যায়তে ইচ্ছা করে। পাশ ফিরে, ডানবাম করে, উপুর হয়ে শোয় আবার চিৎ হয়। চিৎ হয়ে সামিদ চিতল মাছের মত ছটফট করে। চিতল মাছ ডাঙ্গায় উঠে বেশিক্ষণ বাঁচে না। চিতল মাছের দমফুডা সামিদের বুকে আটকা পড়ছে মনে হয়। সামিদ আবার উপুর হইতে চেষ্টা করে। অনেক কষ্টে যদিও বা উপুর হইলো তো কাত হইতে পারে না। নড়াচড়ায় এত অসুবিধা কেন? তারে কি বজলু মেম্বার জাঁতাকলে ফেলছে? না! আসলে শালার উগাড়ের ফলা গুলান বদলাইতে হইব। কেমন বেঁকাতেড়া হয়া গেছে।
না। সামিদের এখন ঘুমানোর সময় নাই। ম্যালা কাজ বাকী। বজলুভাই যতই কোক সে সব সামলাইব। নেতা মানুষ, কথার কোন ঠিক আছে নাকি। সামিদ আবারো বজলু মেম্বারের বাড়ির দিকে যায়।
ক্রমাগত সামিদের দৌড় বাড়তে থাকে। দৌড়াইতে দৌড়াইতে সামিদ কখন যেন মানুষ থেকে জ্বিনে পরিণত হয়। একই সময়ে মানুষ তারে সবগুলো পুকুরের পাড় ধরে হাঁটাহাঁটি করতে দেখে। এইতো গতকাল বেয়ানবেলা নশুখালের আন্ধা পুকুরের পাড়ে দেখছে নুরা, আবার মীরু কয় সে দেখছে উজার বাড়ির খালে। মুক্তার হোসেন কয় কী কও তোমরা গতকাল বয়ান বেলা তো হেরে দেখছি বাবুবাজারে মাছের বেপারির সাথে কথা কয়। সামিদরে নিয়া গ্রামবাসীর আগ্রহ আর ভাবনার অন্ত নাই। সবাই তার দৌড় আর উন্নতি দেখার জন্যে আকুপাকু করে। দুইটা কথা জিগানোর কোন সময় কেউ পায়না গত দশ বার বছর। দৌড়ের মধ্যে কেউ কেউ যদি সামিদরে জিগায়-
কিরে সামিদ আছস কেমন?
সামিদ উত্তরে কয়। বাইদের চরে জাল ফেলছি মাছ কিনলে ঘাটে যাও।
দ্বিতীয়বার তারে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ গত একযুগে পায়ছে তা বলতে পারবে না। তয় সামিদের উন্নতিও হয়ছে। ছেলেমেয়ে গুলান এখন স্কুলে যায় জামা পরে। কয় বেলা খায় সামিদের যদিও এই হিসাব নেয়ার সময় নাই তয় না খায়া থাকে না। ঘরের চালাটাতে খড়ের বদলে টিন লাগাইছে গত বছর। দুইখান লিজ পুকুর আছে। রুক্কি দুধের গরুও একখান পালে। সব মিলায়ে লাখ টাকার সম্পদতো অইবোই। ব্যাংকের রশিদ স্যার এই পাড়ায় আসলে সামিদের উঠানেই বসে, এক গ্লাস পানি খায়। আর কারো উঠানে দাঁড়ায়ও না। পাড়া প্রতিবেশীর এই নিয়ে ফিলোয়ামির শেষ নাই। তারা ফিসফাস করে, ‘রুক্কি নাকি ইদানিং দেয়’। সামিদের তো কিছু করার সময় নাই। রুক্কির কী দোষ কও? ছেড়ির তো যৌবন এহনও এহেবারে শেষ হয়া যায় নাই’। তয় সামিদের এইসব ফুসুরফাসুর শোনার সময় নাই। রুক্কির নালিশও সামিদ কানে তোলার সময় পায় না। রুক্কিও নালিশ এখন আর নিজের ঘরে করে না। পাড়াপড়শিরে কয়ে বেড়ায়।
বুছাবগো কি কইতাম। মানুষটা দৌড়াতে দৌড়াতে এক্কেরারে শুকায়ে খড়ি। ভাত চাইটে খাই, কিন্তুক বয়া খায় না, আম্হা দিয়া কোন মতে গিলেই দৌড়। কেন খায় এইডাও বুঝি না। কী ফাঁস যে গলায় নিলাম। আর তো ফাঁস খুলতাম পাড়ি না। দিন যায় আর খালি ফাঁস আটে’। গেলো সনে কিস্তি দিতাম ১৯৮০ এই বছর দেয় ২৩৫০, ঋণের কামুড়ে কামাই সুদ খাওরি খুসনী দেশ ছাইড়ে পলাইছে আর কুতুব আলী লইছে ফাঁস। এহন এই দুইজনের ঋণও সমিতির বাকী আট’জনের টানন লাগব। দেশ ছাড়-ন আর দুনিয়া ছাড়-ন ঋণ মাফ নাই। সবইরে চুইসে খাইয়াও এ দানব থামবো না। আর মানষে দেহে খালি উন্নতি। ঋণে যে নাক পর্যন্ত ডুবা তা আর কেউ দেহে না’। ভাত চাইট্টে খাই কিন্তুক গলা দিয়া নামে না। বার বছরের মধ্যে ফেদ্দুছের বাপেরে আমি কোনদিন ঘুমাইতে দেহি নাই।
হায় আল্লা বুছাব যে কী কয়। বছরেও আমারে ছুঁয়ে দেহে না। শল্লের মধ্যে রসকস থাকলে না চুইতো। শুকায়ে অক্করে মিশ্বে গেছে।’
রুক্কির এই আক্ষেপ পাড়ার বুবুদের চিত্ত চাঞ্চল্য বাড়িয়ে দেয়। তারা রুক্কির সাথে বিষয়টি আরো বিস্তারিত জানার জন্যে বসত ঘরের বেডরুমে নিয়ে যায়। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে শুনে বিবাহিত রুক্কির বৈদগ্ধ্যের কাহিনী। চাচিরা রুক্কিকে আদর করে সোনাদিয়া বাজার থেকে আনা সুগন্ধি জর্দা দিয়ে পান খাওয়ায়। আর সামিদের উন্নতির ভোগান্তি, রুক্কির মরদবিহীন উতাল পাতাল রাত সাথে নাগরের শিস শোনে হাহুতাশের মধ্যে দিয়ে আনন্দ ও তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।
সামিদ আলীর গল্প শুনতে শুনতে আমরা যখন প্রায় ক্লান্ত তখন এক অদ্ভুত সকালে একটা খবর সারা এলাকায় হঠাৎ মেঘবিহীন বৃষ্টির আদ্রতা তৈরী করে। সেইদিন সকালে মসজিদের মাইকে আযান হয়নি। গতরাতে মসজিদের মাইক চুরি হয়ে গেছে। তা নিয়ে গ্রামবাসী উত্তেজনায় ফযরের নামায পড়তে ভুলে যায়। এই উত্তেজনার গায়ে স্নিগ্ধতার পরশ নিয়ে শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টি সাথে করে নিয়ে আসে রৌদ খেঁকশিয়ালের বিয়ে বলে। আমরা গ্রামবাসী মাইক চুরির কথা ভুলে গিয়ে খেঁকশিয়ালের বিয়ে নিয়ে মেতে উঠি মুহূর্তেই। আর সোনার ফোটায় ধোঁয়া শিমুলতলা গ্রাম সদ্য স্নান করা নববধূর মতই লাজুক নয়নে দেখে তার বুক বরাবর আসছে একটি জিপ আর তিনটি মোটর সাইকেল ধুলার বদলে ধোঁয়া উড়িয়ে। আমরা গ্রামবাসী হুমরি খেয়ে পরি মসজিদের সামনে এবং প্রস্তুত হই মাইক চোরের সর্বোচ্চ বিচারের ব্যবস্থা নিতে। তারা থানা সদরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কিছ্ইু উচ্চারণ না করে রওয়ানা করে সামিদের বাড়ি। আমরাও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সামিল হই সামিদের উঠানে। সেখানে উপস্থিত হন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই, এলাকায় মুরুব্বি মাস্টার আব্বাস আলী, থানা থেকে আসেন ইউ.এন.ও সাহেব সাথে সাংবাদিক ও স্থানীয় ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার প্রধান। তেনারা সময় না নিয়ে ঘোষণা করেন সামিদের পদক প্রাপ্তির খবর। দেশ তার কর্মের স্বীকৃত দিতে চায়। তেনারা বলেন যে, সামিদ একজন আলোকিত মানুষ। সামিদের আগে এই এলাকায় পদক পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো সৈদালী নিজের কিডনি বিক্রি করে ঋণ শোধ করার সাহসিকতা দেখিয়ে। সৈদালীর মৃত্যুর পর তাকে সম্মান দেখিয়ে কাঠের মাঝে টিনের নৌকা মার্কা পদক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দোয়া করেন। আমরা আবারও তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যে সৈদালীর কথা ভুলে নাই তাতে আমরা খুবই আমোদিত হই। এবার আমরা হাততালির মধ্যে দিয়ে সামিদের পদক পাওয়ার ঘোষণাকে স্বাগত করি। তাকে আলোকিত মানুষ হিসাবে পদক দেওয়া হবে। তার চোখের আলো ছড়িয়ে দেয়া হবে দেশের ঘরে ঘরে এমন কী সারা বিশ্বে। আমরা গ্রামবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখি একজন আলোকিত মানুষের চোখের খোঁড়লে হারিয়ে যাওয়া মণিবিহীন নির্ঘুম দুটি চোখ, আমরা কিছুতেই তার চোখের আলো আবিষ্কার করতে পারি না। শুধু দেখি সামিদের দুই চোখে একফোঁটা ঘোলা জল পোনা মাছ বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয় নিয়ে টলমল করে।