ইদানীং আমার কী হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছি না। পুকুরে গোসল করে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে শরীরে কেবল পুকুরের পানিই প্রবাহিত হচ্ছে— রক্ত নয়। তাই বাম হাত কেটে রক্ত বের করে দেখি রঙ তার লাল কীনা। খুশিতে আমার চোখ মারবেলের মতো ঝিকিমিকি করে ওঠে এই আনন্দে যে— রঙ তার মিঠা পানির মতো নয়; বরঞ্চ লালই এবং জিহ্বায় লাগিয়ে দেখি স্বাদও লবণাক্ত। অদ্ভুত আনন্দে গামছা পরেই আমি রাস্তায় বেরিয়ে আসি। আমার উচ্ছ্বাস দেখে কলেজ ফেরত দুই ছাত্রী হতভম্ব হয়ে যায়; একটা মানুষের হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে আর সেই কীনা রাস্তায় প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় উল্লাস করছে। কিছুটা লজ্জা পেয়ে ঘরে ফিরে আসি।
এটা কোনো আহামরি সমস্যা না হলেও; অন্তত আমার কাছে, অন্য একটা সমস্যা প্রবলভাবে ভাবাচ্ছে আমায়। আমার খুব ইচ্ছে করে নিজের উরু থেকে একতাল মাংস কেটে আনি। খুব বেশি নয়— পোয়াখানেক। তারপর চপিং বোর্ডে রেখে চপার দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটি। বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে ভালো করে ধুয়ে মসলা মাখি। শিকের ভেতর গেঁথে কয়লার আঁচে কালো কালো করে পুড়িয়ে কাবাব বানাই। তারপর লেবুর রস মিশিয়ে খাই।
এরও একটা জটিল মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। গরুর মাংসে যেমন একটা গরু গরু গন্ধ থাকে, শুয়োরের মাংসে যেমন একটা শুয়োর শুয়োর গন্ধ থাকে, পাঠার মাংসে যেমন একটা পাঠা পাঠা গন্ধ থাকে, মানুষের মাংসেও তেমনি একটা মানুষ মানুষ গন্ধ থাকে এবং সেটা যদি হয় নিজের মাংস তবে নিজ নিজ গন্ধটা কেমন সেটা একবার টেস্ট করে দেখা। তাছাড়া মানুষ মানুষের মাংস খায়, খুব আস্বাদ করেই খায়, কেউ নিজের মাংস কি এমন আস্বাদ করে খায় যেমন করে আমি খেতে চাচ্ছি— সেই সাইকোলজির কাছাকাছি পৌঁছানো।
এরকম জটিল কিছু মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা নিয়ে আমি দিনগুলোকে রাতের দিকে ঠেলছি আর রাতগুলোকে দিনের দিকে। আমার বাসার সামনের রাস্তাটার মেরামত চলছে। সেদিন দেখি লাল লাল ইট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রেখেছে কনস্ট্রাকশনের লোকেরা। রাস্তায় বসে তিনজন শ্রমিক হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙছে। ইট ভাঙার শব্দ মনে হচ্ছে টিনের চালে শিল পড়ার মতো। তো এখানে অন্য কোনো ভাবনা আসার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো এটা রাস্তা নয়— এটা কোনো একটা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আর ইটগুলো প্রত্নমানুষের কঙ্কাল; কালের ঘষায় ঘষায় যার রঙ একেবারেই শাদা নয়— বরং টকটকে লাল হয়ে গেছে, আর ওই তিনজন শ্রমিক হাতুড়ি দিয়ে ইট নয় মানুষের কঙ্কাল ভাঙছে অনর্গল। এবং মুহূর্তেই ইট ভাঙার শব্দ হাড়-গোড় ভাঙার শব্দে পরিণত হয়। আর কেমন যেন একটা গোপন চিৎকার-আর্তনাদ-গোঙানির শব্দ উড়ে আসে বাতাসের ভেতর দিয়ে। আমার রোম রোম শিহরণ জাগে। আমার মনে হতে থাকে— সমস্ত পৃথিবীটাই প্রত্নভূমি। জীবিত মানুষেরাও জীবিত নয়— মমি। হাঁটছে— চলছে— কথা বলছে ঠিকই— কিন্তু প্রত্যেকেই যেন তুতেনখামেন। এমনকি আমি নিজেও।
পরের দিন দেখি— একটা বুলডোজার ইটগুলোকে চাপা দিচ্ছে। যেন বিদ্রোহী কঙ্কালগুলোকে সভ্যতা এসে পিষে দিচ্ছে— এমন মনে হলো আমার। কিছুদিন পর দেখি রাস্তা পিচ হচ্ছে, মনে হলো— মানুষ পুড়িয়ে কুচকুচে কালো করে গলিয়ে ঢেলে দিচ্ছে ওরা।
নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আমি ভীষণ সংকটে আছি। সেদিন বাসায় ফিরে এসে দরোজার তালা খুলছি— স্পষ্ট দেখি চাবিটা তালার কাছে নিতেই নিজেই ভেতরে ঢুকে গেলো। মনে হলো তালা-চাবি দুটোই প্রাণজ। চাবিটা কাছে যেতেই তালার ছিদ্রটা যোনির মতো মুখ খুলে দিলো। চাবি নিজেই নড়াচড়া শুরু করে দিলো এবং এটা সঙ্গমদৃশ্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমি এতো টানছি বের করতে কিন্তু কিছুতেই বেরুচ্ছে না। তালাটা শব্দ করছে— যেন শিৎকারধ্বনি তুলেছে। দীর্ঘ সময় পর চাবি বেরুলো ঠিকই কিন্তু সেটা ভেজা। আমি হলপ করে বলতে পারি— আমি তালাতে কোনো তেল ব্যবহার করিনি, আর তালাটাও পুরাতন নয়।
ধরে নিলাম তালা-চাবির ব্যাপারটা চোখের বিভ্রম। কিন্তু ঘরে ঢুকে যা দেখলাম— তা তো বিভ্রম হতেই পারে না। দেখি— দেয়ালঘড়ির কাটা উল্টো ঘুরছে। সেকেন্ডের কাটার চেয়ে মিনিটের কাটার বেশি গতি; ঘণ্টার কাটার গতি তারও অধিক। সময় আশ্চর্য গতিতে পেছনের দিকে ছুটছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার শারীরিক অবয়বও চল্লিশ থেকে তিরিশের দিকে চলে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমি কি যুবক থেকে কিশোর, কিশোর থেকে শিশু, শিশু থেকে ভ্রুণে চলে যাবো? ভাবছি— তখনও কি আমার ব্রেন এমনি কাজ করবে? যদি না করে! তাই ভয়ে দৌড়ে গিয়ে ঘড়ির ব্যাটারি খুলে সময়ের গতি থামিয়ে দিই।
এটাকেও যদি বিভ্রম ধরি তবে ফ্রিজের ডোর খোলা কেন? ফ্রিজ তো কেউ কখনো খুলে রাখে না। আর আমার স্ত্রীও বাসায় নেই যে খুলে রাখবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে— সকালে ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে ওমলেট করে খেয়ে গেছি। এবং ডোরটাও লাগিয়েছি। ফ্রিজের দরোজা লাগাতে গিয়ে দেখি— সমস্ত কাটা মাছ আস্ত ও জীবন্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। কচি ফুলকপিটা পাপড়ি মেলে ফুটে ওঠেছে। ডিমের ভেতর থেকে উঁকি মারছে ফার্মের মুরগির বাচ্চা। এবং একটা মুরগির বাচ্চা ভেতর থেকে বলেই বসলো, আমার সহোদরকে তুমি সকালে ভাজি করে খেয়ে গেছো। কাজটা ঠিক করোনি।
কাজ তো কোনোটাই ঠিকঠাক হচ্ছে বলে আমারও মনে হচ্ছে না। আমার কেবল জানতে ইচ্ছে করে রক্তের গভীরতা কত ফুট, কত ইঞ্চি। চোখের দৃষ্টির তাপমাত্রা কত ডিগ্রি সেলসিয়াস। নিশ্বাসের সাথে আনন্দ আর বিষাদের গন্ধ বের হয় কীনা এবং হলে কার গন্ধ কেমন। চোখের জলের সাথে জ্যোৎস্না মেশালে তার রঙ কেমন হবে তা দেখার জন্য মৃত মায়ের দুঃখকে মনে ধরে এক জ্যোৎস্নারাতে তুমুল কেঁদেছি। এর কোনোটাই তো ঠিক না। ডিমের ভেতর কোন মুরগির বাচ্চার সহোদরের প্রাণ রয়েছে— আর তা ভেজে খেয়েছি, সেটা কতোটা ঠিক ভেবে দেখবার সময় কৈ? কিশোরকালে গ্রামে থাকতে বর্ষার রাতে টর্চ লাইট নিয়ে বড় বড় ঘাওয়া ব্যাঙের হলুদ হলুদ রান কেটে এনে কবুতরের মাংসের মতো রান্না করে যে খেয়েছিলাম— সেটাই বা ঠিক ছিলো কে বলবে? একটা মৃত শঙ্খও তার শূন্যতার ভেতর সমুদ্রের গর্জনকে ধরে রাখে, তুমুল ঢেউয়ের গর্জনের মতো সে গর্জন মাইল মাইল প্রসারিত হবার যোগ্যতা রাখে; এমন একটা গর্জন করে যদি আমার অবস্থা পৃথিবীকে জানাতে পারতাম— কিছুটা হলেও শান্তি পেতাম।
তার আর সুযোগ কৈ। সেদিন বিকেলে হাঁটতে বের হই— হাড়িধোয়া নদীর পাড়। নদীর পাড়ের বহুতল ভবনগুলিকে মনে হচ্ছিলো বহুতল পাহাড়। পাহাড়ের ফ্লোরে ফ্লোরে মানুষের ফ্ল্যাট। মানুষগুলো পার্বত্য সিমেন্টের জানালা দিয়ে আমায় দেখছে আর পরিহাস করছে। শত শত পার্বত্য মানুষের দৃষ্টি কেবল আমার দিকে। কেন? আমি কি স্বাভাবিক মানুষ নই? ক্রো-ম্যাগনন কেউ? মহাকালের যোনি ফেড়ে বেরিয়ে এসে পড়েছি আধুনিক সভ্যদের মাঝে? বেশিক্ষণ থাকিনি সেখানে আর। চলে যাই ভরতেরকান্দি বাজার। শহর-ঘেষা এ গ্রামের দুধচার দোকানটিতে আমি প্রায়ই যাই। গরুর খাঁটি দুধের চা খাই। সেখানকার কেউ কিন্তু আমার দিকে মোটেও অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না। তাহলে কি নদীটি পার হয়ে এপাড়ে আসতে না আসতেই আমি মানববিবর্তনের লক্ষ লক্ষ বছর অতিক্রম করে ফেলেছি?
দোকানে ঢুকেই দেখি পাঁচ-ছয় জন গ্রাম্যমানুষ চা খাচ্ছে। আমিও চায়ের অর্ডার করি। ওরা কি বিষয়ে কথা বলছে বুঝতে পারছি না। ওদিকে টিভিও চলছে ফুল ভলিউমে। হঠাৎ ওদের ভেতর থেকে শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন গান ধরলো:
আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়
পারে লয়ে যাও আমায়…
আমি তো অবাক। জ্যোতিরিন্দ্রের আঁকা মানুষটা এখানে কোত্থেকে এলো? স্বয়ং লালন!
দোকানদারকে ডেকে বললাম, টিভিটা বন্ধ করুন। দেখছেন না সাঁইজি গান গাচ্ছেন। দোকানদার লজ্জায় দ্রুত গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিলেন। সাঁইজির মুখোমুখি বসা লোকটার দিকে তাকিয়ে আরো বিভ্রমে পড়ি আমি। রবীন্দ্রনাথ! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!!
গান শেষ হলে রবীন্দ্রনাথ সাঁইজিকে প্রণাম করলেন। সাঁইজি প্রণাম গ্রহণ করলেন। বললেন, বুঝলে রবি, মানুষ রতনকে ধরতে হবে। তুমি কি বলো— জীবন। আমি তো হতবাক! দেখি জীবনানন্দ! পাশের লোকটা মধুসূদন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত! মধুসূদন বললেন, শুনো লালন, জীবন খুব কম বলে কিন্তু ভালো লিখে। তুমি গুরুজিকে জিজ্ঞেস করো। দেখি মধুসূদন, লালন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ চারজনই প্রণামের ভঙ্গিতে বুকে হাত তুলে বলছে— গুরুজি, আপনি কিছু বলছেন না! গুরুজি চোখ খুলে বললেন, আমি কেবল ভাবছি— যে যে আইলা তে তে গেলা। কোথায় গেলা? ভাষা শুনে বুঝলাম ইনি কাহ্নপা। তাঁরাও কি তবে মহাকালের যোনি ফেড়ে ভরতেরকান্দির এই চায়ের দোকানে এসে জড় হয়েছেন!
আমার অবস্থা এখন এই। একটা সবুজ কচি পাতার ভেতর আমি মায়াসভ্যতার রহস্য দেখতে পাই। দেখতে পাই টানটান যুবতী তন্বী নদীটির ভেতর মহাকালের নির্জন ঘোলা স্রোত। ইচ্ছে করলেই আয়ুরেখার পথ ধরে হেঁটে চলে যেতে পারি মৃত্যু-উপত্যকার প্রান্তপ্রান্তর; ফিরেও আসতে পারি জীবনের কাছে। কিন্তু এ ঘোর কাটাতে পারি না। পারি না বলেই ফিরে আসি ঘর। শুয়ে পড়ি বিছানায়। মিথের মতো ঘুম নামে চোখে। নিটোল অন্ধকারের ঘুম আমি ঘুমোতে পারি না। আমাকে তাড়া করে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন স্বপ্ন। স্বপ্নও যেনো জেগে থাকার ওলট-পালট দৃশ্য দৃশ্যান্তর। দু’একটা স্বপ্ন শুনলেই বোঝা যাবে আমি বাস্তব আর স্বপ্নের তুলনায় বাস্তবেই যথেষ্ট ভালো আছি।
এই যেমন কালই দেখলাম— পাহাড়পুরের বিহার থেকে বেরিয়ে আসছে এক বৃদ্ধ শ্রমণ। সাথে এক তরুণ শ্রমণী। স্পষ্ট টের পাচ্ছি শ্রমণীর শরীর থেকে উড়ে আসছে ঝাঁক বেঁধে বুদ্ধগন্ধ। গন্ধটা অনেকটা উসাই সেন রামু বড় ক্যাং-এর মোমবাতি জ্বলা গন্ধের মতো। কেমন পোড়া পোড়া। শ্রমণীর শরীরের ভেতর কি মাংস রান্না হচ্ছে কামের উত্তাপে? তবে তো তা কামসূত্রমগন্ধ হওয়ার কাথা। বুদ্ধগন্ধ কেন? যখনি এমনটা ভাবছি— শ্রমণী তার বসন খুলে আনোখনগ্ন হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো। বৃদ্ধ শ্রমণ ‘করো কি, করো কি’ বলে চেচাচ্ছে কিন্তু তরুণী তাতে কর্ণপাতই করলো না। ওর স্তনের উত্তাপে আমার ঊরু বেয়ে একটা তরল গরম স্রোত বেরিয়ে পড়লো। ঘুম ভেঙে গেলো।
এটা স্বাভাবিক ঘটনা। বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আবার এসে শুতেই ঘুম নেমে এলো চোখে। মিথের মতো সে ঘুম। দেখি— শ্রমণী বলছে, এতো অল্পেই পৌরুষ গলে গেলে হবে নাগর? চলো বিহারের ভেতর যাই। গেলাম বিহারের ভেতর। মহাস্থানগড়ের এই প্রাসাদের ভেতর আমাকে অভিবাদন জানাতে চলে এলেন মুন্সিগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামের বজ্রযানপন্থী অতীশ দীপঙ্কর। চেতনাকে বজ্রের মতো কঠিন করে তুলতে হয় বলে এ সাধনপন্থার নাম হয়েছে বজ্রযান। আহা কী তাঁর রূপ। গৌতমের নতুন সংস্কার। সারা বিহার জুড়ে তখন দীপঙ্করঘ্রাণ। মোহিত হয়ে বললাম, আপনি তিব্বত থেকে কবে এলেন?
তিনি বললেন, আপনি এসেছেন শুনেই চলে এলাম।
কে বললো আমার কথা?
আমার কন্যা।
কে?
যোগমায়া।
যোগমায়া মানে তরুণ শ্রমণী। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কখন?
দীপঙ্কর বললেন, ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আপনি যখন বাথরুমে গিয়েছিলেন— তখন।
আমি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, চলুন আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই যেখানে আপনি আসবেন বলে শান্তরক্ষিত আমাকে আগেই বলে রেখেছেন। বলে কী এই বাঙালি দার্শনিক! আমার আসার কথা শান্তরক্ষিত বলে রেখেছেন!
বিস্মিত আমি পা চালালাম দীপঙ্কর ও যোগমায়ার ছান্দসিক হাঁটার অনুকরণে। আমি হাঁটছি আর বিস্মিত হচ্ছি এই দেখে যে— যে মহাস্থানগড় কালের ঝাঁকুনি খেয়ে মাটির নিচে দেবে গেছে শতাব্দী শতাব্দী আগে; যাকে স্যার ক্যানিংহাম মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করেছেন কিছু বছর আগে সেই মহাস্থানগড় মাটি ভেদ করে গজিয়ে ওঠছে উদ্ভিদের মতো। এই অনুপম প্রাসাদের স্থানে স্থানে ধ্যানরত বুদ্ধের মূর্তি। তারা আমাকে সর্বশেষ যে কক্ষে নিয়ে এলেন— সে কক্ষে সিমেন্টের এক বিশাল পদ্মপুষ্প। দীপঙ্কর আমাকে বললেন, আপনি এই পদ্মপুষ্পে বসুন। বসলাম আমি। দীপঙ্কর ও যোগমায়া আভূমি নত হয়ে আমাকে প্রণাম করলেন। বললাম— আমাকে প্রণাম করছেন কেন? দীপঙ্কর স্মিত হেসে বললেন— আপনিই তো অমিতাভ গৌতম।
প্রণাম শেষে যোগমায়া একটা আগুনের কুণ্ড হয়ে যায়। তার আঁচে আমি অর্ধসেদ্ধ হয়ে বসে থাকি সিমেন্টের পদ্মপুষ্পের উপর। যোগমায়ার অগ্নিকেশ উড়ছে আর বিহারের ছাদ জ্বলছে, যোগমায়ার দুই অগ্নিহস্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে প্রাসাদের চারপাশ, যোগমায়ার আগুনের গোলার মতো স্তন পুড়িয়ে দিচ্ছে প্রাসাদের দ্বার— আমি ক্রমে ছোটো হতে হতে চলে আসছি যোগমায়ার দিকে— যোগমায়ার যোনির দিকে। একেবারে তার যোনির ভেতর। যেন এ যোনি নয়— আগুনের গ্যালাক্সি। অজস্র আকাশ তার। অজস্র গ্রহ। নক্ষত্র। ধূমকেতু। আমি বুঝতে পারছি যে আমি জাগ্রত নই— ঘুমন্ত আছি। চাইলেই একটানে ঘুমটাকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারি জাগ্রতলোকে কিন্তু কিছুতেই পারছি না। যোগমায়ার অগ্নিগ্যালাক্সির ভেতর আমি গৌতমের ধ্যানে বসে গেলাম। আমার সমস্ত জাতকজন্ম আমার চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো প্রদর্শিত হচ্ছে। কোন সে পাথরের সংস্কৃতির যুগে কোন এক অর্ধ–মানবীর বিশাল স্তনের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলাম— সেই স্মৃতি, কোন দূর অতীতের এক অভয়ারণ্যে শুয়োর হয়ে এক শুয়োরির পিঠের উপর চড়েছিলাম— সেই স্মৃতি, কোন এক ময়াবী সভ্যতার কিনারে দাঁড়িয়ে কার দিকে ছুড়ে মেরেছিলাম— অশোকগুচ্ছ— সে স্মৃতি; সব মনে পড়ছে আমার। আর এদিকে সমস্ত আগুনের ভেতর আমার দিকে দুই হাত তুলে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আমারই জাতকজন্ম বজ্রযোগিনী গ্রামের বজ্রযানপন্থী শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর।
মুহূর্তেই স্বপ্নের প্লট পাল্টে যায়— আগুনের কুণ্ডটা ক্রমে কিশোরগঞ্জে দেখা পাগলীটাতে পরিণত হয়। এমন রকস্টার টাইপ পাগলী আমি জীবনে দেখিনি। শাড়ি পরে খোলা চুলে মাথায় ক্যাপ দিয়ে কালো সানগ্লাসের ফাঁকে আমায় চোখ মেরে বললো— কিরে অমিতাভ বচ্চন, আমারে রেখার মতন লাগতাছে না?
রেখার মতোই হাইট ও টাইট ফিগারের পাগলীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ঈশা খাঁ’র জঙ্গলবাড়ি। ঈশা খাঁ’র পঞ্চদশ পুরুষ যে বাড়িটি এখনো দখল করে আছে সে বাড়ির সোপানে বসে পাগলী বলে, বল তোর জাতকজন্মের গল্প।
আমি চমকে গিয়ে পাগলীকে বলি, তুমি কি যোগমায়া? যার অলাতচক্র পার হয়ে আমি কেবলই বেরিয়ে এসেছি!
পাগলী বলে, না রে বচ্চন, আমি রেখা। চিত্রনায়িকা রেখা।
কিন্তু তার মুখের পেশিতে পেশিতে আমি যোগমায়ার চাতুরী লক্ষ্য করছি। তারপরও নিস্পৃহ হয়ে বলি— এমন পাগল সেজে থাকো কেন?
তোর জন্য অমিতাভ। সে বললো, কেবল তোর জন্য।
কিন্তু আমি তো অমিতাভ গৌতমও নই, অমিতাভ বচ্চনও। তুমিও নও যোগমায়া কিংবা রেখা। তবে এই পাগলের বেশ কেন তোমার?
মুহূর্তেই যোগমায়া ওরফে রেখা নিয়ান্ডারথাল মানবীতে রূপান্তরিত হয়। আমি নিজেও রূপ নিই নিয়ান্ডারথাল মানবে। আমরা চলে আসি প্লাইস্টোসিন যুগের অপভ্রংশে। এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের এক পার্বত্যগুহার সামনে। হাতে তার পাথরের হাতিয়ার— আমারো। তার স্তন দুটো পাথরের মতো বড়ো। সেই পাথরের মতো বড়ো স্তনের উপর আমি মাথা রেখে শুয়ে পড়ি। সে বললো, এবার চিনেছিস আমি কে?
আমি উত্তর দিই— হ্যাঁ চিনেছি।
দূর অতীতের এক অভয়ারণ্যে শুয়োর হয়ে এই শুয়োরির পিঠের উপরই আমি চড়ে বসেছিলাম। কোন এক মায়াবী সভ্যতার কিনারে দাঁড়িয়ে তার দিকেই ছুঁড়ে মেরেছিলাম অশোকগুচ্ছ।
এবার বুঝলি তো কেন বলছি আমি কেবল তোর জন্য পাগলের সাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
ঘুম ভেঙে যায়। ডিম পাড়া মুরগীর মতো ডাকতে থাকে ভোর। ভোরের হিরণ্ময় আলোর সাথে স্বপ্নের ঘোর মিশে ভোরটাকে আরো আধিভৌতিক দেখায়। আমি ‘না–স্বপ্ন ও না–বাস্তব’ এমন একটা গ্রহের একমাত্র বাসিন্দা তখন।
এরকম ঐতিহাসিক ও প্রাগৈতিহাসিক স্বপ্নযাত্রার মানুষটি যে আমি বৌদ্ধবাদ কিংবা জন্মান্তরবাদে সিকি পরিমাণ বিশ্বাসী তা কিন্তু নই। বরং কেনো ইজমেই বিশ্বাসী নই আমি। এমনকি বংশানুক্রমে পাওয়া রক্তের স্রোতে মিশে থাকা পৈতৃক ধর্মটাতেও আমি একেবারে না-বিশ্বাসী। তবে কেন এরকম স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে। যদি ফ্রয়েডের কথাই মেনে নিই—’স্বপ্ন হচ্ছে এক ধরনের মাতৃজঠরে প্রত্যাবর্তন’ তবে তা আমার ক্ষেত্রে হলো কৈ? হলে এমন হতো— আমি মাতৃজঠরে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পা উপরে তুলে ঝুলে আছি। পেটটা একটা কোমল রশি দিয়ে বাঁধা। আর আমি পেন্ডুলামের মতো দুলছি। সুখে হাত-পা ছুঁড়ছি। মনের ভেতর ঘোলা নদীর স্রোতের মতো ঘুরপাক পাচ্ছে আনন্দ। মায়ের কলিজার গন্ধ পাচ্ছি, পাচ্ছি রক্তের স্পন্দন। মায়ের আর আমার রক্ত এক— মায়ের আর আমার নিশ্বাসও এক। মাতৃজঠরের ওমে আমি মাত। সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। মায়ের আনন্দ-দুঃখ যতোটা উপলব্ধি করছি ঠিক ততোটাই উপলব্ধি করতে পারছি আত্মার স্পন্দন। জাগতিক কোনো যন্ত্রণাই এই চামড়াটা ভেদ করে ভেতরে আসতে পারছে না। মাতৃজঠর যেন এক বোধিবৃক্ষতল। মাথার উপর মাংসের আকাশ, চারপাশে মাংসের দিগন্ত, নিচে মাংসের ভূ-ভাগ। মাঝখানে আমি এক কচিমাংসের জীবন্ত জাতক। জাগতিক কথা-বার্তা পালি শ্লোকের মতো কানে আসছে। আর আমি বলছি— ওম শান্তি, ওম শান্তি… তবে না হয় বুঝতাম_ স্বপ্ন এক ধরনের মাতৃজঠরে প্রত্যাবর্তন। আমার জেগে থাকা কিংবা ঘুমিয়ে থাকা দুটোই তো আগুনের ভেতর হাত দিয়ে বসে থাকার মতো অসহ্যকর। এমনটা কি কখনো হতে পারে যে, আমার হাত পুড়ছে আর আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছি আর বলছি— কী সুন্দর শৈল্পিক আগুন! বাহ: বেশ দারুণ স্টাইলে নৃত্য করে হাতকে পোড়াচ্ছে!
এই তো সেদিনও দুপুরের ভাতঘুমে গেছি কেবল। স্বপ্নে দেখি দুজন করাতি একটা গাছকে মাচানে ঝুলিয়ে কাটছে। হয়তো কাঁঠাল গাছ। বলতে পারবো না ঠিক। চামড়া তুলে ফেলেছে। কিন্তু কাঠ কুটুমপাখির পালকের মতো অতিহলুদ। আমার খুব ইচ্ছে হলো করাত দিয়ে গাছ চিরতে। ওমা— আমিই তখন করাতি বনে যাই এবং কাঠ চিরতে শুরু করি। আমি যেন কয়েক দিন ধরে গাছই চিরে যাচ্ছি কেবল। হুম…হুম…শব্দ করে একবার টেনে করাত উপরে তুলছি আবার নিচে ঠেলে দিচ্ছি। দরদর করে ঘাম ঝরছে। কিন্তু আমার পরক্ষণেই মনে হলো আমি গাছ ভেবে যেটা চেরাই করছি সেটা মোটেও কোনো গাছ নয়— এবং তার রঙও একেবারেই হলুদ নয়, বরং এটা একটা লাশ আর ফিনকি দিয়ে তার থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। কথা হচ্ছে লাশের শরীর থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ার কথা। ফিনকি দিয়ে নয় তবে কি লাশটা লাশ নয়— জীবন্ত কেউ? কে হতে পারে?
মাথা থেকে পেট পর্যন্ত লাশটা চিরে দুফালি করে ফেলেছি। বুকের দিকে একটা কাঠ ঢুকিয়ে ফাঁক করে রেখেছি কাটতে যেন সহজ হয়। তাই চেহারাটা কিছুতেই চিনতে পারছি না। একটা দ্বিখণ্ডিত মুখের মাঝখানে আধহাত পরিমাণ ফাঁক থাকলে পরিচিতজনকেও চেনার কথা নয়। নিশ্চয়ই তেমন পরিচিত কেউ নয়। আতঙ্কে আমি করাতটা টেনে বের করি। টেনে বের করি বুকের দিকে ঢুকিয়ে দেয়া কাঠটাও। লাশটার দ্বিখণ্ডিত মাথা টেনে জড় করি। দেখি আমার শৈশবের বন্ধু শুক্কুর আলীর মুখ।
শুক্কুর আলী কথা বলতে শুরু করে। একটা ছড়া। ছোটবেলায় খেলার সময় যে ছড়াটা বলতাম সেটা…
আউলাঁ ঝাউলাঁ পাঁকিস্তাঁন
দেঁশেঁ আঁইলোঁ ইঁরিঁ ধাঁন
ইঁরি ধাঁনের গঁন্ধেঁ
নোঁয়াভাঁবি কাঁন্ধেঁ
ওঁগোঁ ভাঁবিঁ কাঁন্দোঁ কেঁরেঁ
তোঁমাঁর ভাঁইয়েঁ মাঁরছেঁ কেঁরেঁ
মাঁইরাঁ মাঁইরাঁ আঁদরঁ কঁরেঁ
ডাঁক্তারঁ আঁইন্যাঁ ব্যাঁন্ডিঁজ কঁরেঁ।
শুক্কুর আলীর দ্বিখণ্ডিত মুখ, দ্বিখণ্ডিত নাক, নাসিক্য ধ্বনিতে ছড়া কাটতে কাটতে জোড়া লাগতে শুরু করে। আশেপাশে আমার প্রাইমারি স্কুলের সমস্ত বন্ধু। শুক্কুর আলীর হাতে রামসুন্দর বসাক প্রণীত ‘আদি বাল্যশিক্ষা’। আনন্দ পাবলিশার্সের ছাপা। লাল–হলুদ–সবুজ প্রচ্ছদের উপর একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। আমার সমস্ত বাল্যবন্ধু চেঁচিয়ে পড়ছে আদি বাল্যশিক্ষার লাইন…
অ— অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর।
আ— আলস্য দোষের আকর।
উ— উগ্রভাব ভালো নয়।
ঊ— ঊর্ধমুখে পথ চলিও না।
এ— একতা সুখের মূল।
আমিও তাদের সাথে চিৎকার করে পড়ছি…
য— যত্ন করলে রত্ন মিলে।
স— সৎ পুত্র কুলের ভূষণ।
হ— হঠকারিতা বড় দোষ।
ক্ষ— ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ।
ক্ষ— ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ বলেই আমি শুক্কুর আলীকে জড়িয়ে ধরে বলি, শুক্কুর আলী, আমাকে ক্ষমা করে দে। বিশ্বাস কর করাত দিয়ে আমি তোকে কাটতে চাইনি। আমি গাছ কাটতে গিয়েছিলাম শুধু। বিশ্বাস কর বন্ধু… বিশ্বাস কর…
অমনি কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে রত্না— আমাদের প্রাইমারি স্কুলের বান্ধবী, বলে— তোরা এখানে বসে আছিস। আয় গোল্লাছুট খেলবো।
কোথায় শুক্কুর আলী আর কোথায় গোল্লাছুট; রত্না আমাকে নিয়ে চলে এলো আমার মধ্যবয়সের উপত্যকায়। বললো, আমার বুকে হাত দে।
আমি ওর বর্তুল স্তনে হাত রাখি। কী নরম আর কী গরম! বললাম— এগুলি কী?
রত্না বললো— গ্রহ। পৃথিবী নামক গ্রহ। কী সফ্ট দেখেছিস? আমি বললাম— পৃথিবী তো সিলিকন দিয়ে তৈরি। এতো সফ্ট হয় কী করে?
রত্না বললো, শুধু সিলিকন নয় রে পাগল— ঈশ্বর উপাদানও এর সাথে মিশে আছে, আর রক্ত–মাংস–শিরার দৌঁড়াদৌড়ি তো আছেই।
আমি স্তনে আবার হাত রাখি। জ্যোতির্ময় স্তন। রক্তের কম্পনের সাথে মাংসের নির্জন ঘুম মিশে শিরাগুলোকে ফুলিয়ে দিয়েছে। যেন স্বয়ং ওর ঈশ্বর ভেতর থেকে জেগে ওঠছেন। দুটো পৃথিবীকে মুঠোর ভেতর পুরে আমি ওর ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করতে চেষ্টা করি। পাই না।
রত্না বললো, স্তন এক আশ্চর্য ফুল, ছুঁয়ে দিলে ফুটে। বলেই সে স্তনের দিকে তাকালো। আমি দেখলাম, স্তন দুটো পাপড়ি মেলে ফুটছে। কাঁঠালচাপার পাপড়ির মতো পাপড়ি। গন্ধটা মাংসগন্ধ নয়, রক্তগন্ধ নয়— সিলিকনগন্ধ।
তারপর দেখি স্তন নেই, রত্না নেই, পৃথিবী নেই৷ একটা শূন্যস্থানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গায়ে আমার জামা নেই, মনে হলো আমি আদম। হাওয়াকে খুঁজতে বেরিয়েছি। কিন্তু এই শূন্যস্থানের কোথাও কোনো ঘরবাড়ি নেই, নদী নেই, অরণ্য নেই, মরুভূমি নেই, ঝর্ণা নেই, শহর নেই, সভ্যতা নেই। আমি পা রাখছি শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যাচ্ছে। মাটি ফেঁড়ে বেরিয়ে আসছে উঁচু উঁচু দালান, দৌড়ে ছুটছে জলজ্যান্ত নদী। লক্ষ লক্ষ বীজ কেটে ফটফট শব্দে গজিয়ে ওঠছে কোটি কোটি বৃক্ষ। হাজার হাজার কিলোমিটার ভূখণ্ডে জেগে ওঠছে সর্বভুক মরুভূমি। ঝর্ণা ছুটছে। শহর ওঠছে। সভ্যতা ফুটছে।
আমি হাঁটছি আর একটা পৃথিবী জন্ম নিচ্ছে। আমি হাঁটছি— পৃথিবীটা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। এক অদ্ভুত নৈঃসঙ্গকে সঙ্গী করে আমি কাউকে খু্ঁজছি। যাকে খুঁজছি তার নাম হাওয়া, না ইভ, না শতরূপা আমি জানি না। হাঁটতে হাঁটতে শেষপর্যন্ত যে ভূ–ভাগে এসে দাঁড়ালাম তার পানি মিঠা, বৃক্ষ সবুজ, চুলের মতো চিকন অজস্র নদী কোনোটার নাম পদ্মা, কোনোটার নাম মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, হাড়িধোয়া। হাড়িধোয়া নদীর পাড়ে এসে যাকে খুঁজে পেলাম তার নাম— ফাতেমা। আমার স্ত্রী। তাহলে আমি আদম নই? আজিজুল হক। আমার ঘুম ভেঙে যায়।
বউয়ের পরামর্শ শুনে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হই। বউ বুঝতে পারছে সামথিং ইজ রং। অনেক সমস্যাই সে নিজ থেকে লক্ষ্য করেছে। বিশেষ করে সেদিন যখন ওর হাত ধরে আমি বললাম, তোমার হাতে হাত রেখে আমি গাছের রক্তসঞ্চালন টের পাচ্ছি। এবং এই রক্তসঞ্চালন একটা ইউক্যালিপটাস গাছের রক্তসঞ্চালনের মতো।
আরো একটা ঘটনা আছে যা আমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট পর্যন্ত এনে ছেড়েছে। সেদিন রাতে আমরা মিলন করছিলাম। আমি বলতে পারবো না, আমার স্ত্রী বলেছে, আমি নাকি সঙ্গমের সময় বলছিলাম, তুমি একটা নদীর মতো রহস্যময়। তোমার সাথে মিলিত হলেই মনে হয় আমি একটা নদীর সাথে সঙ্গম করছি। তুমি কি নদী? কী নাম তোমার? মেঘনা না পাহাড়িয়া।
সঙ্গমের সময় এমন কথা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে আবেগবশত বলতেই পারে। কিন্তু আমার চোখ–মুখের এক্সপ্রেশন নাকি মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না। একজন মানসিক রোগীর মতোই নাকি আমি আচরণ করছিলাম।
ডাক্তার আমার সমস্ত কথা শুনে বললেন, আপনার ধাঁচের রোগী আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি ক্রমশ সুপারন্যাচারাল হয়ে ওঠছেন। এটা ঠিক রোগ নয়— বীক্ষণদোষ। এই বলে তিনি একটি ক্যালেন্ডার নিয়ে আসলেন আমার সামনে। বললেন— দেখেন তো মার্চের পাতার প্রচ্ছদটিতে আপনি কী দেখতে পাচ্ছেন?
আমি বললাম, সত্য বলবো না মিথ্যা বলবো।
ডাক্তার বললেন, যা দেখছেন তাই বলুন।
বললাম, কালো কোটের সফেদ পাঞ্জাবি পরা লোকটা একজন প্রেরিতপুরুষ। বাঙালি জাতির আশীর্বাদ। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের পুণ্যে এ লোকটার জন্ম হয়েছিল বলে এই মাঠে প্রেরিতপুরুষের রূপ ধরে এসে দাঁড়িয়েছেন। যে মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা বাঙলার আঁতুড়ঘর। ওই যে আকাশের দিকে উত্থিত তর্জনী ওটা বাঙালির দিকনির্দেশক যন্ত্র। আর ওই যে কলরেডির মাউথ স্পিকার ওটা শব্দব্রহ্মযন্ত্র। যে যন্ত্র কেবল গর্জনকে প্রচার করতে জানে।
আমার স্ত্রী বললেন, শুনেছেন ডাক্তার সাহেব?
ডাক্তার বললেন, জ্বি। তিনি সত্য বলেছেন।
আমি তো সত্যই দেখি এবং সত্যই বলি। কিন্তু যা দেখি তা যে স্বাভাবিকতাবাদে পড়ে না তা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কী দোষ। আমার মতো মাধ্যমিকবাদী নিয়ে বউ যেমন যন্ত্রণায় আছে আমি নিজেও তেমনি কষ্টে আছি।
বউ চাচ্ছে আমি কবিরাজের কাছে যাই। তাই গেলাম। কবিরাজমশাই আমাকে ভালোভাবে অধ্যয়ন করলেন; যেন আমি একটা গ্রন্থ। পাঠ শেষে বললেন, আমাকে জ্বিনে ধরেছে।
আমার বউও তাই ভাবছিলেন।
কবিরাজমশাই একটা তাবিজ দিলেন। তাবিজে আঁকা একটা মানুষের প্রতিকৃতি। আরবি সংখ্যা ও হরফে রেখা টানা। জাফরান কালিতে লেখা এ তাবিজটা কিছুদিন গলায় ঝুলাই। আমার কেবলই মনে হয় গলায় একটা ট্রাঙ্ক ঝুলিয়ে রেখেছি। এই ট্রাঙ্কটার ভেতর আদি ও আসল জ্বিনতাড়ানো মন্ত্র আছে। মন্ত্র আর ট্রাঙ্কের ভারে আমার মাথা যেন নিচু হয়ে আসে। যদিও তার ওজন এক ছটাকও নয় তবু্ও তাকে আমার কয়েক মণ মনে হতে থাকে— একি তাবিজের ওজন না তাবিজের ভেতরকার মন্ত্রের ওজন বলতে পারবো না। স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝামাঝিও একটা সময় আছে, তাকে ঠিক তন্দ্রাকাল বলা যায় কীনা আমি জানি না। তবে সে সময়টাতে আমার অস্তিত্ব নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি বিভ্রমে থাকি।
এ সময়কার ব্যাখ্যা অবশ্য আমি সাইকিয়াট্রিস্টকেও দিইনি। কবিরাজকেও না। আসলে এ ব্যাখ্যা আমার নিজের কাছেও দুর্বোধ্য।
স্বপ্নলোকের সমস্ত কিছু বাস্তব জগতে এসে হুলুস্থুল বাধিয়ে দেয় আবার বাস্তবের সবকিছুও স্বপ্নের ভেতর অনায়াসে ঢুকে যায়। আমি যেন কেমন এক থাকা না থাকার দোলাচলে ভোগি। ইচ্ছে করলেই আমি মৃত্যুর দিকে যেতে পারি— আবার জীবনের ভেতরও প্রবেশ করতে পারি অনায়াসে। কিন্তু না–মৃত্যু না–জীবন তার স্বন্ধিক্ষণে পড়ে আমি এমন এক মাধ্যমিকবাদী হয়ে ওঠি যে— বাস্তবের মানুষটা একটা চড়াই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে বাস্তবে এসে আমাকে পেন্ডুলামের মতো দোলাতে থাকে এবং আমি দুলতে দুলতে না–স্বপ্ন না–বাস্তবের মাঝে পড়ে শিল–নোড়ায় পেষা মরিচের মতো অস্তিত্বহীন হতে থাকি।
সময়ের দুটি পৃষ্ঠা। একটা শাদা একটা কালো। শাদাটা দিন— কালোটা রাত। শাদা–কালোর মাঝামাঝি যে গোধূলিসন্ধি বা প্রভাতসন্ধি তাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করা চলে? তাই আমিও আমাকে বিশ্লেষণ করতে পারছি না।