শায়লা কাপ থেকে পিরিচে চা ঢেলে দিচ্ছে, সাবা চুক চুক করে খাচ্ছে আর একের পর এক প্রশ্ন করে চলছে। প্রশ্নগুলো করছে তার বাবাকে উদ্দেশ করে। সাবার বয়স তিন বছর আট মাস। সুকুমার রায়ের ‘বিষম চিন্তা’ মতো তার মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন। প্রশ্ন সহজ হয় কখনো জটিল হয়। মাঝে মধ্যে এমন সব প্রশ্ন করে যা বর্তমান সভ্যতার সীমাকে লঙ্ঘন করে ফেলে। কাজল তার মেয়ের সবকথা গুরুত্ব না দিলেও উত্তর দিয়ে থাকে। এমনকি সেইসব ভয়ঙ্কর জঠিল প্রশ্নেরও বুদ্ধি খাটিয়ে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু এখন সাবাকে চুপ থাকতে বলছে কারণ তার মেজাজ খুবই খারাপ। পরিবেশটাও ভিন্ন। ওরা বসে আছে কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনের একটা চায়ের দোকানে।
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড গরম। বাতাস বিভাগেও মনে হয় লোডশেডিং চলছে। কাজলের মেজাজ খারাপ একাধিক কারণে। এ মুহূর্তে সব চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের ওপর। ঈশাখাঁ এক্সপ্রেস কিশোরগঞ্জ স্টেশনে আসার কথা নয়টা ২০ মিনিটে, এখন বাজে দশটার উপর। ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছে এ নিয়ে সাবার চিন্তা নেই, অমিতের স্কুল বিষয়ক একটি ঘটনার উত্তর জানা খুব দরকার। অমিত সাবার চেয়ে দু’বছরের বড়। স্কুলে যায়। স্কুলের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ছোট বোনের সাথে গল্প করে। স্কুলে অন্তরা একদিন অমিতকে ব্যাঙ বলেছিল। শুধু অমিত না, যার সাথেই ঝগড়া হয় অন্তরা তাকেই ব্যাঙ বলে। রাগ করলে অন্তরা সবাইকে ব্যাঙ বলে কেন এ মুহূর্তে সাবার কাছে এটাই জরুরি প্রশ্ন। এমন ধারার প্রশ্নে সমস্যা নেই কিন্তু মাঝেমধ্যে সাবার মনগড়া কিছু প্রশ্নে সামাজিক পরিবেশ আক্রান্ত হয়ে পড়ে । গতকাল শশুর বাড়িতে কাজলকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। বিকাল বেলায় ঘটনা । শায়লার মা অসুস্থ ,বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘরভর্তি আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী । এর মাঝে সাবা দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে কাজলকে লক্ষ করে ব্যস্ততার সাথে জানতে চায় , বাবা-বাবা তুমি কি ছোটখালাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে ?
সবার ছোট খালা অর্থাৎ শায়লার ছোট বোন নিলাও ঘরে আছে । মাসখানিক হলো নিলার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে, বিয়ের কথা প্রায় চুড়ান্ত। অসুস্থতার খবর পেয়ে ছেলে পক্ষের লোকজনও এসেছে, একজন ছেলের আপন চাচা । মহা অস্বস্তিকর অবস্থা। কাজল পরিবেশটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। সাবাকে আদর করে কাছে ডেকে কারণ জিজ্ঞাস করলে সাবা জানায় রনির বাবা রনির ছোটখালাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। রনি অমিতের বন্ধু , স্কুলে আজ রনির পরীক্ষা ছিল কিন্তু সে পরীক্ষা দেয়নি, কেবলই কেঁদেছে । একটু আগে অমিত তার ফুফুর বাসা থেকে এসব কথা ফোনে জানিয়েছে।
নিলার বিয়ের সম্পর্কটা এনেছে নিলার বড় ভাবী, এ কারেণেই হয়তো তিনি বেশি রকম ক্ষুব্ধ। সাবাকে কিছু না বলে আক্রমণ করেন শায়লাকে উপলক্ষ করে। তোমার বরটা যেমন পাগল ছেলেমেয়েগুলো হয়েছে তেমন ……. শায়লা আক্ষেপ করে, আহ্! ভাবী, সাবা বাচ্চামানুষ, একটা ভুল না হয় করে ফেলেছে, এর মধ্যে ওর বাবাকে টানছ কেন? সাবার বড় মামী কাজলের উপর সীমাহীন বিরক্ত। মাস তিনেক আগে কাজলকে পাগল বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত সাত বছরে কাজল পাঁচ বার চাকরি ছেড়েছে, শেষ চাকরিটা ছেড়েছে তিন মাস আগে। বসের সাথে সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে ৫০হাজার টাকা বেতনের চাকরিটা ছেড়ে দিলো! পড়াশোনায় রেজাল্ট ভালো, এমন সুদর্শন যুবক অথচ চাকরি করতে পারে না! নিজের হাতে আগুন জ্বালিয়ে সবগুলো সার্টিফিকেট পুড়িয়ে দিল যে ছেলে তার মাথায় নিশ্চয় গণ্ডগোল আছে। সাবার মামীর দুঃখ এই সহজ বিষয়টা তার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি কেও ঝুঝতে পারছে না। শায়লাইবা কেমন মেয়ে! নিজে চাকরি করে সংসারের ঘানি টানছে অথচ অপদার্থ স্বামী রত্নটিকে কিছুই বলে না! মেয়ে মানুষ হয়েও শায়লা এমন বোকা কেমন করে হলো সাবার মামীর চিন্তায় আসে না। শায়লার ওপর রাগ ঝাড়বার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু সাবার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। কাজল চুপ হয়ে থাকলে সাবা চিৎকার করে ওঠে-এই বাবা,কথা বলছ না কেন! তুমিও কি ছোট খালাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে?
কাজল মাথা নাড়িয়ে বলে,না মা- পালিয়ে যাব না।
তাহলে রনির বাবা রনির ছোট খালাকে নিয়ে পালিয়ে গেল কেন?
রনির বাবা রনির মাকে ভালোবাসতো না তো এই জন্য।
তুমি কি আমার মাকে ভালোবাসো না?
কাজল মৃদু হেসে বলে,ভালোবাসি।
তাহলে তো তুমি ছোট খালাকে নিয়ে পালাবে না, তাইনা বাবা-আ?
কাজল মুখে হাসি নিয়ে বলে না মা পালাবো না ।
রনির বাবা রনির মাকে ভালোবাসতো না কেন বাবা-আ?
সাবা আদুরে গলায় এই প্রশ্ন করলে কাজলকে একটুখানি ভাবতে হয় । হেসে বলে কেন ভালোবাসতো না জানিনা, এবার বাজিতপুরে গিয়ে তুমি আর আমি রনির বাবা কে জিজ্ঞেস করবো, কেমন? সাবা খুশি মনে মাথা দুলিয়ে চলে যায় কিন্তু ঘরের ভিতর বসে থাকা অনেকগুলো মুখ আঁধার হয়ে থাকে অনেকক্ষণ ।
ট্রেনের খোঁজে কাজল স্টেশন মাস্টারের রুমে যায় । একজন জানায় খাঁ সাহেব এখন গৌরিপুর ইঞ্জিন বদল করেছেন । কেন দেরি হচ্ছে উত্তর মেলে না তবে উপদেশ পাওয়া যায়। ট্রেনের চেয়ে ৮গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে চড়ে যে বাজিতপুর যাওয়া যায় কাজল জানে । টাকার চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাস জার্নিটা শায়লা একেবারেই সহ্য করতে পারেনা । প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে কাজল নতুন বানানো বিল্ডিংটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে । একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মনের অজান্তে। কি ভীষণ অপচয়! ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো কিংবা সিংগেল লাইনকে ডাবল লাইন করাটা কত জরুরি! জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই স্বেতহস্তী বানিয়ে জনগণের কি উপকার হচ্ছে?
নানান বিষয় ভাবতে ভাবতে ভিড়ের মধ্যে কাজল মানুষ দেখে। লুঙ্গিপরা মানুষ,প্যান্টপরা মানুষ ,টাইবাঁধা মানুষ,ইনকরা মানুষ, শাড়িপরা মানুষ, বোরকাপরা মানুষ। হকার বেকার সরকারী চাকুরীজীবি এনজিও কর্মচারী কলার বেপারী কতো রকমের মানুষ! যখন-তখন বিদ্যুৎ চলে যাওয়া-সকালের ট্রেন দুপুরে আসা কত সহজেই না নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে এই মানুষ! তার পরও মানুষের রাগ হয়, শরীর দিয়ে কষ্ট অনুভব করে। চিন্তায় যন্ত্রণা হয় কি? কাজলের যন্ত্রণা হয়, ভীষণ যন্ত্রণা-মুক্তির অবিচল লক্ষে থাকতে না পারার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়। লড়াই থেকে দাসত্ব-দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে চাকরি ছাড়ে। চাকরি ছাড়ার পর মনে হয় সব দিক তার খোলা কিন্তু পা বাড়ালেই অনুভব করে অদৃশ্য শিকল।
ভিক্ষুকের বিলাপ, হকারের চিৎকার, যাত্রীদের কোলাহলের ভেতর একটি গুঞ্জন শোনা যায়, অল্পক্ষণ আগে একজন নারীমানুষ মারা গেছে এই স্টেশনে।
মৃতদেহটি রাখা হয়েছে পুরোনো একটি পাটির উপর। কাঁথা দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হয়েছে। লাশকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে। শিশুরা বসেছে মাটির সাথে শরীর মিশিয়ে, হাত-পা ছড়িয়ে। চারজন নারী আর দুজন বৃদ্ধ বসেছেন হাটু ভেঙে পায়ের উপর ভর করে। পুরুষরা সবাই দাঁড়িয়ে। মৃত মহিলার সাথে এই মানুষজনের আত্নীয়তার সম্পর্ক নেই, প্রতিবেশীও নয়। তার পরও মানুষ যে দাঁড়িয়ে আছে কারণ হতে পারে নিছক সময় কাটানো কিংবা যূথবদ্ধ জীবনের আদিম প্রবৃত্তি।
নারী মানুষটি মারা গেছে ফুলের মত ফুটফুটে দুটি বাচ্চা রেখে। ছেলেটির বয়স ৯-১০ হবে, মেয়েটি নিতান্তই শিশু-৩ এর বেশি হবে না। মৃত্যু সম্পর্কে ছেলেটির ধারণা আছে। মায়ের হাড্ডিসার পা দুটি জড়িয়ে ধরে কাঁদছে-জগতের গভীরতম ক্রন্দন। অসংখ্য নির্মমতার সাক্ষী এবং শিকার সমাজের মানুষ ঘটনাটা দেখছে সংসার জীবনের সাধারণ নিয়ম থেকে। কিছু পরিমাণে ব্যথিত মানুষ বাদাম খায়, পানের পিক ফেলে, বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কথা বলে। একটু ব্যতিক্রম হয়। ছোট্ট মেয়েটি মৃত মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে, চোখেমুখে চুমু খেয়ে ডাকতে থাকে-মা আর ঘুমাইও না। মা, মাগো উট উট…. দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষদের চোখ ছলছল হয়ে ওঠে,বসে থাকা মহিলারা ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দেয়। এক বৃদ্ধা বিলাপ করেন, গত রাতে পাউরুটি আর গুড় দিয়েছিলেন এই মহিলাকে, জ্বরের ঘোরে তাকে মা বলে ডেকেছিল। বৃদ্ধা ডুকরে কেঁদে উঠেন, আল্লা গো এইডা কি করলা তুমি! এই মাসুম বাচ্চা দুইডা অহন কই যাইবো?
বৃদ্ধার কান্না কাজলকে স্পর্শ করে গভীরভাবে। বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠে বাচ্চা দুটির জন্য। মৃত মহিলার আত্নীয়স্বজনের খোঁজ করে কাজল। বছর খানিক আগে দুই বাচ্চাসহ একদিন কিশোরগঞ্জ স্টেশনে নেমেছিল ওই মহিলা,তারপর বিভিন্ন বাসায় হোটেলে কাজ করেছে,অসুস্থ অবস্থায় ভিক্ষা করতে দেখা গেছে।
এক টাকা পাঁচ টাকার কয়েন থেকে শুরু করে দশ টাকা বিশ টাকার বেশ কিছু নোট পড়ে আছে লাশের চারপাশে। বোরকা পরা এক মহিলা দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনা শুনে ছেলের হাত দিয়ে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট পাঠিয়ে দেন। টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে আছে যে যুবক তার নাম ওসমান। ওসমান টাকাটা রাখে খুব যত্নের সাথে। বাতাসে উড়ে যাবার সম্ভবনা নেই তার পরও ছোট একটি টুকরো পাথর বসিয়ে দেয় টাকার ওপর।
পুকুর পাড়ে তাকিয়ে ওসমান তার দুই সাগরেদ মন্টু এবং ইদ্রিছ আলীকে দেখতে পায়। ওদের পাঠিয়েছিল মসজিদ থেকে সামিয়ানা আনতে। ইদ্রিছ আলীর সাথে মসজিদের ঈমাম সাহেবকে দেখতে পেয়ে মনটা একটু দমে যায়। ঈমাম সাহেব স্থানীয় কেউ না কিন্তু ক্ষমতাবান মানুষ। ক্ষমতাবান মানুষ মাত্রই বিপজ্জনক! ইদ্রিছ আলী কি এটা বুঝে না? মনে মনে একটা কঠিন গালি দেয় ইদ্রিছ আলীকে ।
লাশ দেখে ঈমাম সাহেব রাগে ফেটে পড়েন। চারপাশে জড়ো হওয়া জনগণের উদ্দেশে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেন, লাছের মাতা পচ্চিমে কেন?
পাবলিক নিশ্চুপ। কয়েক মুহূর্ত মৃদু গুঞ্জনের পর ওসমান হাতজোড় করে কাছে এসে দাঁড়ায়। নিচু স্বরে বলে, হুজুর আমরা মুরুক্ক মানুষ। ওসমানের বিনীত ভাব দেখে ঈমাম সাহেবের রাগ নরম হয়। মুখে হাসি নিয়ে বলেন, বেয়াকুবের দল উত্তর শিথান কর উত্তর শিথান। মুছলমানের মিত্যু হইলে মাতা রাকতে হয় উত্তরে।
এই বেডি যে মুছলমান হের প্রমাণ কি? ঈমাম সাহেব প্রশ্নকর্তাকে তাকিয়ে দেখেন। পরিচিত মুখ। কি বলবেন ভেবে উঠতে পারেন না। একমণী একটা পাথরখণ্ডে বসে আছে সামছু, হাতে জলন্ত বিড়ি। তিন আঙুলে বিড়িটা ধরে জোরে জোরে কয়টা টান দিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ে পেছনে। সামছু যে একটা ঝামেলা পাকাবে ওসমান বুঝতে পারছে। কাছে এসে বলে, সামছু ভাই, এইহানে তোমার কি কাম? তুমি চইলা যাও।
ওসমান কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে-সামছুর ভাল লাগে। কালো কালো দাঁত বের করে দুর্বিনীত হাসি হাসে। দেড় বছর আগে হলে এ লাশের নেতৃত্ব সে-ই দিত কিন্তু সময়টা এখন ভালো না, ভয়ঙ্কর খারাপ সময়। রাতে ভাত খাওয়া হয়নি। সকালে ফুলির মার দোকান থেকে দুটো চিতল পিঠা খেয়েছে মরিচভর্তা দিয়ে। জেল থেকে বের হয়েছে আজ ৪ দিন, বসের এখনো জামিন হয়নি। সঙ্গীসাথীরা সব পলাতক। এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসের টিকেট ব্ল্যাক থেকে শুরু করে সবকিছু চলছে আগের মতই কিন্তু নেতৃত্ব বদলে গেছে। পাথরখণ্ডে বসে এতক্ষণ নিকট অতীতের কথাই ভাবছিল সামছু। কি উদ্যাম ঘটনাবহুল জীবন ছিল! টাকা-নারী-নেশা-মাঝেমধ্যে মন্টুর বোনকে সাথে নিয়ে সিনেমা দেখা! সামছুর একটা মজার শখ ছিল বি এ পাশ এম এ পাশ বেকার যুবকদের সাথে গল্প করা। বেকার যুবকরা ইস্টিশনে আসতো পত্রিকা পড়তে, দীর্ঘ সময় নিয়ে চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজতো। শ্যামপাল টি স্টলে বসে সুখ-দুঃখের কথা শুনতো,পকেটের টাকা খরচ করে চা খাওয়াতো। সাড়ে চার টাকা দিয়ে বেনসন জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার মধ্যে কি আনন্দই না ছিল!
স্টেশনের উত্তরে অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে বিকট শব্দ করতে করতে একটি মোটর সাইকেল আসে। দ্রুত ব্রেক কষে দাঁড়ায় লাশের কাছাকাছি। কৌতূহলী জনতার সাথে ওসমানও তাকায়। তিন জন-ই পরিচিত। অজিত বর্মণের পিছনে বসে আছে জুম্মন আর পরিমল। একশ টাকার একটা নোট অজিত বর্মণ নিজের হাতে রাখে লাশের শিয়রের কাছে। ওসমান খুশি হয় না-তাকে চিন্তিত দেখায়। অজিত বর্মণ সাধারণ পাবলিক না-পৌরসভার গত নির্বাচনে কমিশনার পদে দাঁড়িয়ে ফেল করেছিল কিন্তু ফেল করলেও ক্ষমতাবান মানুষ। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ওসমান জানে ক্ষমতাবান মানুষ মাত্রই নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে নতুন কোন ঘটনার জন্ম দিতে চায়। এদিকে সামছুর আচরণ আরও সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। জুম্মন আর পরিমলের সাথে কানে কানে কি কথা বলে?
ঝামেলাটা শুরু হয় মৃত মহিলার ধর্মের পরিচয় নিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ওপর ভিত্তি করে ওসমান যে দাবী করে তা দুর্বল হয়ে পড়ে অজিত বর্মণের তথ্যের কাছে। গত দুর্গা পূজার সময় সিদ্ধেশ্বরী বাড়িতে দুই বাচ্চাসহ এই মহিলাকে প্রসাদ খেতে দেখেছে। বিপরীত তথ্য দেন ঈমাম সাহেব। ২ জুম্মা আগে মসজিদ থেকে এই মহিলাকে শিরনি নিতে নিজের চোখে দেখেছেন। জনগণ কথা বলে। ১জন, ৫জন, ১০জন। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে মসজিদ-মন্দির সবই সমান। যেখানে খাবার পায় সেখানেই যায়। সামছু কর্কশস্বরে জানতে চায়, একজন অমুসলিমের জানাজা হলে সেই পাপের দায়ভার কে নেবে? ঈমাম সাহেব সরাসরি উত্তর না দিয়ে একজন মুসলমানকে আগুনে পুড়ানো যে কত বড় গুনাহ্ কাজ দীর্ঘ বয়ান করেন। তুমুল তর্ক-বির্তক শুরু হয়। উপস্থিত জনগণ আগ্রহের সাথে তর্ক-বির্তক উপভোগ করতে থাকে।
বসন্তের শুকনো পাতার মতো টাকা ছড়িয়ে আছে লাশের চারপাশে । অল্প সময়ে আশাতীত টাকা দেখে ওসমানের মনটা ফুরফুরে ছিল এতক্ষণ কিন্তু একটা টাকাও এখন কেউ দিচ্ছে না। তমুল হট্টগোলের মধ্যে ওসমান চিৎকার দিয়ে বলে অত কথার দরকার কি? এই বেডির পোলা ত অহনও মরে নাই, হেরে জিগাইলেই ত হয়। এ কথায় কেউ আপত্তি করে না। কয়েকজন একসাথে জিজ্ঞেস করে, এই তরা হিন্দু না মুছলমান?
বালক কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে, প্রশ্নটা হয়তো বুঝতে পারেনা। বালকের ঠোঁট জোড়া কাঁপে, আস্তে আস্তে বলে, আ ম রা গ রি ব….
ওসমানের দুর্বোধ্য ঠেকে বালকের সহজ উত্তর। অসহিষ্ণুতা ক্রোধে পরিণত হয়, আরে ফকিন্নির পুত, তরা কি জমিদার? গরিবই ত, জিগাই তরা হিন্দু না মুছলমান? বালকের একই উত্তর আ ম রা গ রি ব…………..
ধর্মীয় পরিচয় বের করতে সবাই মিলে নানা উপায়ে চেষ্টা করে। বালকের নাম টগর, ছোট বোনের নাম বেলি। ফুলের মধ্যে হিন্দু মুসলমান কোন বিষয় আছে কি না একে অন্যেকে জিজ্ঞেস করে। উত্তর খুঁজে পায় না। মাকে টগর সারাজীবন মা বলেই ডেকেছে, লোকে বলত টগরের মা। বাবাও একদিন ছিল, আর একটা বিয়ে করে মাকে ছেড়ে চলে গেছে। বাবার চেহারা কিংবা নাম কোনটাই টগর এখন মনে করতে পারে না।
টগর চুপ হয়ে বসে আছে। এই নিঃশব্দ বেদনার রূপটি কাজলকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। গভীর অন্তর্দ্বন্দ্বে তোলপাড় হয় তার চিন্তাজগত। দ্রুত একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। চাকরি না হোক ব্যবসা কিংবা কিছু একটা করবে অমিত কিংবা সাবার মত টগর আর বেলিও আজ থেকে তার সন্তান। এটা কি ভালোমানুষীর নামে মধ্যবিত্তসুলভ সুবিধাবাদীতা? নিজেকে প্রশ্ন করে কাজল। বাংলাদেশের-না, শুধু বাংলাদেশ না- এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমিরিকায় যে ২৫ কোটি শিশু কারখানায় দৈনিক ১৬ ঘন্টা শ্রম বিক্রি করে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। টগরের আর্তচিৎকারে কাজল চমকে তাকায়-মাতৃশোককেও যেন ছাপিয়ে যায় এই চিৎকার। দুহাতে প্যান্টের বোতাম আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ বাধা দিতে চেষ্টা করছে অনেকগুলো বয়স্ক হাতকে। দু দলে বিভক্ত হয়ে এতক্ষণ যারা তর্ক-বির্তক করছিল মহাউল্লাসে সবাই এখন একজোট হয়েছে। এই শিশুটির লিঙ্গ ছোলা না আছোলা তা দেখতেই হবে।
মায়ের লাশের সামনে এভাবে সন্তানকে ন্যাংটা করা যায় কাজলের কল্পনায় আসে না। কিন্তু চোখের সামনেই ঘটতে চলছে। এটা কি ৭১? তবে কি ৭১ও এখনও শেষ হয়নি? কিন্তু তখন তো শত্রু ছিল এক পক্ষ। কাজলের কল্পনায় ভাসে মানব জাতি-গোটা মানবজাতিই যে ন্যাংটা হয়ে যায়! শিশু কন্ঠের কান্নার শব্দ খুব পরিচিত লাগে-অমিত যেন আকুল হয়ে ডাকছে- কাজল স্থির রাখতে পারে না নিজেকে, ভয়ঙ্কর আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করতে বেশ কষ্ট হয়। ডান হাতের দুটো আঙুল মনে হয় ভেঙে গেছে । প্রথমে শায়লার সাথে কথা হয়, এরপর দুই বন্ধুকে স্টেশনে আসতে বলে। উপস্থিত পাবলিকের আচরণ দ্রুত পাল্টে যায়। এতক্ষণ নিরব দর্শক হয়ে থাকা জনতা সরব হয়ে উঠে। কাজলকে কেন্দ্র করে উল্লসিত জনতা টগরের ওপর নিপীড়নকারীদের তীব্র ভাষায় নিন্দা করতে থাকে।
অজিত বর্মণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে কাজলকে। যে পরিমাণ রাগ হয় তার চেয়ে বেশি অবাক হয়। চার-পাঁচজন জোয়ান পুরুষকে মুহূর্তের মধ্যে ঘায়েল করে ফেললো! হাতের সাথে এভাবে পা চালাতে সিনেমায় দেখেছে, বাস্তবে দেখলো এই প্রথম। অবাক বিস্ময়ে ভাবছে কোত্থেকে এলো এই যুবক!
বিশালদেহী পরিমল মাটিতে শুয়ে আছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ওসমানের কপালের ডান পাশটা ফুলে একটা টেবিলটেনিস বলের আকৃতি নিয়েছে। যে জুম্মনকে অজিত বর্মণ আদর করে মাঝে মধ্যে অসুর বলে ডাকতো সেই জুম্মনের অবস্থা আরও কাহিল। মুখের ভেতর দাঁত কয়টা আছে কয়টা নেই না গুনে বলা সম্ভব নয়। অজিত বর্মণ কাজলকে বুঝতে চেষ্টা করে। পুলিশের লোক? আর্মি অফিসার? র্যাব? সাংবাদিক? নাকি ক্ষমতাসীন পার্টির কেও? না হতেই পারে না। তবে এই শক্তির উৎস কোথায়? অজিত বর্মণ তার জ্ঞান দিয়ে চেষ্টা করে-হিসাব মিলাতে পারে না। কাজলকে ঘাটাতেও সাহস পায় না।
আজিমউদ্দিন স্কুলের কাছাকাছি এসে ঈশাখাঁ ডাকতে শুরু করে। তার পিঠে কাঁধে অসংখ্য মানুষ। লোকাল ট্রেনের যাত্রীরা দৌড়াতে শুরু করে লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের মতো বসার ব্যবস্থা না হোক পা রাখার জন্য একটু জায়গা খুব দরকার।
খাড়া সূর্যের নিচে পৃথিবীটা এখন অনেক বেশি শান্ত। লাশের পায়ের কাছে একটা ত্রিভুজ আকৃতির পাথর। পাথরের নিচে পড়ে আছে একটা কয়েন। এক টাকার কিংবা পাঁচ টাকার হতে পারে। দেখার জন্য কেও নেই এখানে।
স্টেশনের উত্তরে অশ্বত্থ গাছটি বহু ঘটনার নিরব সাক্ষী । অশ্বত্থের গায়ে হেলান দিয়ে কাজল বসে আছে। এক পাশে সাবা অন্য পাশে টগর। কাজলের ঠোঁটের কাছে অনেকটা কেটে গেছে। গেঞ্জি আর প্যান্টের কয়েক জায়গায় রক্ত দেখে সাবা বারবার কারণ জানতে চাইছে। বেলি শুয়ে ছিল কাজলের হাটুর উপর। শায়লাকে দেখে কি মনে করে ওঠে পড়ে। কাজলের শরীরে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে শায়লা। ভেজা রুমালটা জড়িয়ে রাখে হাতের কব্জিতে। ঘটনার বিবরণ শুনতে চায় কাজলের কাছে। নীল রঙের জামা পরা ছোট্ট মেয়েটিকে শায়লা হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। কিন্তু বেলি ওয়াগনের পাশে রোদের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে। শায়লা ওঠে এসে বেলির মাথায় হাত রাখে। ইশ্! শরীর যে আগুন হয়ে গেছে! বোকা মেয়ে, এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বেলি উত্তর দেয় না পিট পিট করে তাকিয়ে দেখে শায়লাকে। আহ্! কি সুন্দর মানুষের বাচ্চার চোখ! শায়লা বেলিকে কোলে তুলে নেয় গভীর মমতায়।