“যারা খুন করে তারা জানে না, একটা মানুষ মানে একটা জগৎ। কত সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে একটা মানুষ, বৌ-বাচ্চা-মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু, ওরা তা ভুলে যায়। ওরা মারে বিচ্ছিন্ন একটা মানুষকে। সেই মার সেই লোকটাকে ছাড়িয়েও ছডিয়ে যায়। একজন মানুষের সঙ্গে আরো কত মানুষ শেষ হয়। যারা খুন করে তারা কি তা জানে?”
ডুমনী বিলে ভরা বর্ষার থৈ থৈ পানি। বিলের পূর্বপাড়ে নলখাগড়ার ঝোপ। ঢেউয়ের তালে তালে সেই ঝোপের বুক-হাঁটু পানিতে লাশ হয়ে আমি ভাসছি। অথচ কি আশ্চর্য, গতকাল ঠিক এই সময়েও আমি জীবিত ছিলাম।
শুরুতেই বলে রাখি, এ হচ্ছে সদ্যই অশরীরি হওয়া এক আত্মার আবেগাক্রান্ত অতিপ্রাকৃত আত্মকথন, সত্যতার উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও যা ‘স্বস্তা’ ‘সিনেমাটিক’। তবুও, আপনি একজন গল্পপ্রিয় ধৈর্য্যশীল পাঠক, এবং এই গল্পকে নিতান্তই কুখাদ্য অনুমান করেও হজম করবেন বলে মনস্থির করেছেন বিধায় গল্পের বয়ান শুরু করছি।
একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। যাকে বলে খাঁটি অজ পাড়াগাঁ, এমন গ্রাম আপনি কখনো দেখেছেন? যেহেতু আপনি গল্প পড়তে ভালবাসেন, ধরে নিচ্ছি বিভূতিভূষণের লেখার সূত্রে এমন একটি গ্রামের মনছবি আপনার কল্পনায় আছে। ধূলি বা কাদামাখা পল্লীপথ, ছন বা বাঁশের প্রায় বিধ্বস্ত বাড়ীঘর, বিদ্যুৎ নেই বলে সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার ও জোনাকি যেখানে রাজত্ব করে, এমন একটি অজ গ্রামে আমার জন্ম। ‘আমি’ মানে মির্জা আব্দুর রহমান, ডাকনাম ফিরোজ। পিতা-মির্জা ফজলুর রহমান, সাকিন-জমশেদপুর, থানা ও জেলা-পঞ্চগড়। আমার জন্ম হয়েছিল ৮ মার্চ ১৯৭৮, মৃত্যু ১৪ মে ২০০২।
‘মির্জা’ পদবীটা শুনে হয়তো আপনি বিভ্রান্ত হয়েছেন, কেমন একটা বড়লোকী বড়লোকী গন্ধ; ও কেবল নামেই। আমার বাবা ছিলেন স্রেফ একজন প্রান্তিক চাষী। সামান্য ভিটে জমি এবং যৎসামান্য কৃষি জমিই ছিল তার অবলম্বন। জসিমউদ্দীনের ‘আসমানী’র ভাঙ্গা বাড়ীর বর্ণনা আপনার অবশ্যই জানা আছে। ঠিক তেমনই একটি বাড়ীতে আমরা দুই ভাই-বোন এবং বাবা-মা থাকতাম। অভাব, ক্ষুধা আর কষ্ট তাই আমাদের খুব পরিচিত অনুভূতি। তবু, সাদা-কালো এই জীবনের মধ্যেই একদিন একটু সাসপেন্স তৈরী হয়েছিল। শেক্সপিয়র বলেছিলেন, জীবনটা নাকি রঙ্গমঞ্চ। আর রঙ্গমঞ্চে একটু-আধটু সাসপেন্স না হলেই নয়, বোধকরি তাই সেদিন ঐ সাসপেন্স তৈরী হয়েছিল। এত অভাব আর দারিদ্রের মধ্যেও আমি মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে যাকে বলে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমি আমার মায়ের চোখে কখনোই হাসি দেখিনি, বাবার চেহারায় কোন আশা বা স্বপ্ন এই জন্মেও আমি দেখিনি; কিন্তু সেদিন দেখেছিলাম। ভীষন মেঘে ঢাকা অবাক কালো অন্ধকার আকাশের হঠাৎ বিদ্যুৎ চমক’কে আলো মনে করা ভুল। আমার বাবা-মা সেই ভুল করে, আমাকে উপলক্ষ্য করে খুব আলোকিত ভবিষৎ-এর স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এই পর্যায়ে আমার মা সম্পর্কে আপনাকে খানিকটা ধারনা দিতেই হবে। তার আগে আপনাকে সবিনয় প্রস্তাব করবো, পড়ার লয়’টা একটু মন্থর করে আপনার চোখ দু’টো একটু বন্ধ করুন। এবার মানসচক্ষে আপনার মা’কে দেখার চেষ্টা করুন। ভেবে দেখুন, আপনি এবং আপনার মা পরস্পর পরস্পর’কে কতটা ভালোবাসেন। আপনাদের একজনকে ছাড়া অন্যজনের জগত-সংসার কতটা অর্থহীন, মৃত, অন্ধকার, অসাড়; অনুভব করতে চেষ্টা করুন। কোন এক চরম হতাশার সময় একবার আপনি আপনার মায়ের কুলে কিছুক্ষণ মুখ বুঁজে, চোখ বুঁজে শুয়েছিলেন। তারপর কি এক অপার্থিব প্রশান্তি ও নির্ভার ভাব নিয়ে জেগে উঠেছিলেন, দয়া করে তা রোমন্থন করুন। আপনার সাফল্যের কোন খবরে আপনার মায়ের চোখে-মুখে সর্বাঙ্গে কি পরিতৃপ্তির ঢেউ জেগে উঠে, একবার ভেবে দেখুন। আপনার কোন দুঃসংবাদে কেমন বিষাদে ছেয়ে যাবে আপনার মায়ের মন, অনুগ্রহ করে পূর্বানুমান করুন। বুঝা যায়? এই ডুমনী বিলের ঢেউয়ের শপথ, আমার মা’ও ঠিক একই রকম, অবিকল আপনার মায়ের মতো; সহজ, সাধারণ, নিরাপদ, প্রশান্তিদায়ক।
আমার মা কখনো বিজলী বাতি দেখেননি। ভাবতে পারেন! আমার মা কখনো ফ্যান দেখেননি, কোন শহর দেখেননি, পাকা রাস্তা দেখেননি, কোন কিছুই দেখেননি। কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়, কিভাবে সুখ-কল্পনা করতে হয়, কেমন হয় সুুখের অনুভূতি; আমার মা কখনোই তা জানেননি। তারপরও, স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া আমার মা’কে আমি স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলাম। আজ ডুমনী বিলের ঢেউয়ের তালে তালে তার সেই স্বপ্ন লাশ হয়ে ভাসছে।
পাঁচ ঘন্টা ধরে পানিতে ভেসে আছি। ভোর এখনো চোখ মেলেনি, কেবলমাত্র পাখীর কিচির মিচির শুরু হয়েছে। একটুপর প্রভাত হবে, জেগে উঠবে চরাচর, রাষ্ট্র হবে লাশ আবিস্কারের খবর। পরদিন পত্রিকার শিরোনাম ‘খিলক্ষেতের ডুমনী বিলে ভাসমান লাশ, ঢাবি ছাত্রের রহস্যময় মৃত্যু’। হায়রে জীবন, পত্রিকার পাঠক কিভাবে পত্রিকার শিরোনাম হয়ে যায়! বেশ কৌতুহল হচ্ছে, কিভাবে ছাপা হবে আমার খুন সংবাদ! বরাবর দেখেছি, ছাত্রদের মৃত্যু পত্রিকায় বেশ গুরুত্ব পায়। প্রথম পাতায় ডাবল লাইনে দুই কলাম শিরোনাম হবে হয়তো। ক্লোজ রেঞ্জ থেকে আমার মাথায় গুলি করা হয়েছে। কাল রাতে ক্যাম্পাসে একটা ‘সিঙ্গেল শট’-এর আওয়াজ নিশ্চয়ই অনেকে শুনেছে। এই দুই ঘটনার যোগসূত্র নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক অনুমান আর জল্পনা-কল্পনা হবে । ক্যাম্পাসের লাশ কিভাবে ডুমনী বিলে এলো, তা নিয়ে হবে অনেক আলোচনা। আমার সহপাঠী বন্ধুদের ক্রন্দনরত ছবিও ছাপা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি তদন্ত কমিটি করবে, সে খবরও আসবে পত্রিকায়।
সুবীর, রিপন, নাজিয়া, ফারহা, আহাদ আর আমি; আমরা এই ছয়জন একসাথে পড়তাম। আগস্টে অনার্স ফাইনাল, কিছুদিন ধরে তাই খুব লাইব্রেরী ওয়ার্ক হচ্ছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত একসাথে থাকতে থাকতে কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে। আজ সকাল নয়টায় সেন্ট্রাল লাইব্রেরী’তে আমরা মিট করবো, এমনই কথা ছিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমি ছাড়া ওরা কতটা দিশেহারা হবে। আহাদ’কে নিয়েই আমার যত ভয়; আচ্ছা, ও কি আমার মৃত্যুটাকে সহজভাবে নিতে পারবে না? সুবীর এবার ইয়ার ড্রপ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চড়-থাপ্পর দিয়ে আমি আর নাজিয়া ওর ভূত তাড়িয়েছি। আমি না থাকলে সুবীরের কি হবে! সেদিন আয়শা প্রসঙ্গে রিপনকে অনেক খেপিয়েছি, রিপন এমন বিব্রত হয়েছিল, যখন-তখন কেঁদে দেয় অবস্থা। রাগ রাখিসনা রিপন, সরি।
দুইটা টিউশনি ছিল আমার; একটা হাতীরপুল, আরেকটা মগবাজার। এদের একজন জাকি, পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে, আমার উপর তার অনেক নির্ভরতা। একদিন টিউশনি মিস করলে কি যে রাগ করতো! জাকি, এখন কি করবে তুমি? স্নেহা কেজী’তে পড়ছে, গেল সপ্তাহে ওর একটা দাঁত পড়েছে। যত্ন করে দাঁত’টা তুলে রেখেছিল আমাকে দেখাবে বলে। স্নেহা’র মা নেই, জন্মের সময় মারা গিয়েছেন। চোখে পানি, হাতে দাঁত নিয়ে মার জন্য খুব কাঁদছিল সে। আমার মা’কে একবার ওদের বাসায় নিয়ে আসার জন্য সে কি আব্দার। জাকি, স্নেহা; আমার এই মৃত্যুসংবাদ’কে তোমাদের শিশুমন সহ্য করতে পারবে তো!
কত কি করার ছিল ! গ্রামের বেকারদের নিয়ে একটি সমিতি করার ইচ্ছে ছিল, যে সমিতি কৃষকদের উৎপাদিত ফসল ঠিক দামে থানা, জেলা হয়ে একসময় ঢাকায় বিপনন করবে। কয়েক বছরে স্বাবলম্বী হয়ে সেই সমিতি সেচ, বীজ ও সারের জন্য কৃষকদের সুদবিহীন ক্ষুদ্র ঋণ দিবে।। একটি বৃদ্ধাশ্রম ও শিশু আশ্রম করবো ভেবেছিলাম (নাজিয়ার বাবা আশ্রমের জমি কেনার জন্য বড় অঙ্কের একটা টাকা এর মধ্যেই বরাদ্দ করেছিলেন), সেখানে বৃদ্ধরা শিশুদের নির্মল আনন্দ আর উচ্ছলতা দেখে সজীব থাকবে, শিশুরা বৃদ্ধদের দেখে জীবনের পরিনতি সম্পর্কে জানবে, মৃত্যুহীন জীবন হয়না এই সত্য জেনে শিশুরা কর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে অমরত্বের বীজ বুনবে। কৃতজ্ঞ এই শিশুরাই একদিন বড় হয়ে বহন করবে আশ্রমের ভার, এবং এভাবেই চলবে পুণঃপৌনিক, আশ্রম হবে স্বাবলম্বী।। ফলজ এবং ঔষধী বৃক্ষের একটি বিপ্লব শুরু করেছিলাম জমশেদপুরে, চেয়েছিলাম এই বিপ্লব ছড়িয়ে দিব পুরো দেশে।। জমশেদপুর’কে একটি পর্যটন গ্রামে রূপ দেবার জন্য গ্রামের মুরব্বী, মাতব্বর, মেম্বারদের সাথে কথা হয়েছিল। গ্রামের সরল জীবনধারা, যৌথ পরিবারের যৌথ সুখ-দুঃখ, সবুজ প্রকৃতি, খালে-বিলে মাছ ধরা ইত্যাদি বিদেশী পর্যটকদের কাছে হতে পারতো আগ্রহের বিষয়। । আমাদের গ্রামে কেউ নিরক্ষর থাকবেনা, এই উদ্দেশ্যে গত বছর জানুয়ারী’তে শুরু করেছিলাম ‘আলোকিত জমশেদপুর’ আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল প্রাইমারী স্কুলের শিশুরা। ছোট ছোট শিশুরা বয়স্ক লোকদের অক্ষর আর বানান শেখাচ্ছে, এটা যে কি আনন্দের দৃশ্য! এরমধ্যেই গ্রামের ত্রিশজন বয়স্ক ব্যক্তি লিখতে পড়তে শিখেছেন। জুলাই মাস থেকে পাশের কুমুদখালী গ্রামে শিক্ষার আলো নিয়ে সে গ্রামের বয়স্কদের কাছে তারা যাবেন, এমন পরিকল্পনা হয়েছিল।। আমার ব্যবহৃত ডায়েরীতে এমন আরো অনেক পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য সমস্যা ও সমাধানের কথা টুকে রাখা আছে, ডুমনীর জল বিছানায় শুয়ে-ভেসে আমি প্রার্থনা করি তার সব যেন বাস্তবায়িত হয়।
আদুরী নামে আমার একটিমাত্র ছোটবোন ছিল। ‘আলোকিত জমশেদপুর’ আন্দোলনের সেও একজন কর্মী। এমন একটি আন্দোলনে জড়িয়ে কি খুশী যে হয়েছিল ওর ছোট্ট শিশুমন! আমাদের পরস্পর পরস্পরের জন্য বাড়াবাড়ি রকমের আদর-ভালোবাসা ছিল। একবার আদুরী’র খুব জ্বর হলো, তখন ওর বয়স সাত কি আট। জ্বরের ঘোরে বারবার ডেকে ডেকে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝরাতে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আদুরীর ভয়ার্ত কণ্ঠের ডাক শুনে মা-ও জেগে উঠেন। ওর ফ্যাকাশে চেহারা দেখে ঘাবড়ে যান মা। বাবাও জেগে উঠেন। দূর্বল-কাতর-ক্ষীণ কণ্ঠে আদুরী তখন বলতে থাকে- মা, আমি এখন মারা যাবো। ফিরোজ দাদা তো ঢাকায়, তাই দাদাকে দেখতে পাবোনা। তুমি বাবাকে বলো, বাবা যেন দাদা’র মতো গুণগুনিয়ে গান করে। আমি তখন জিজ্ঞেস করবো, কে? বাবা বলবে, আমি ফিরোজ। তারপর বাবা এসে আমার গালে দাদার মতো করে একটা চিমটি কেটে দিবে। আমি ব্যাথা পেয়ে কাঁদলে বাবা যেন ‘আঁদুরী-বাঁদুরী, ব্যাঁথা পেঁয়ে কাঁদুরী’ এই কথা বলতে বলতে আদর করে দেয়।
আদুরী যেভাবে বললো ঠিক সেভাবেই কাজ করা হলো। এবং কি আশ্চর্য, অর্থহীন ঐ ছড়া আমার বোনের উপর মন্ত্রের মতো কাজ করতে লাগলো। আদুরী’র অস্থির, ফ্যাকাশে চেহারা ধীরে ধীরে প্রশান্তিতে ভরে গেলো। তারপর টুপ করে ঘুমিয়ে পড়লো আমাদের ছোট্ট আদুরী, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন আমার মা-বাবা।
জীবন আসলেই রহস্যে ভরা। যুক্তির এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন মীমাংসা নেই। টিএসসি-তে ঘুড়ে ঘুড়ে চকলেট বিক্রি করে আদুরীর বয়সী এমন একটি ছোট্ট মেয়ে আছে। ওকে দেখলেই আমার আদুরীর কথা মনে পড়ে, তাই আদর করে তাকেও আমি আদুরী নামে ডাকি। যে রাতে আদুরী অসুস্থ্ ছিল, সেদিন বারবার আদুরীর কথা মনে হচ্ছিল। ছায়া আদুরী’কে দেখার জন্য আমি তাই টিএসসি-তে গিয়েছিলাম। অনেক খুঁজেও না পেয়ে জানতে পারলাম যে সে অসুস্থ্। শুনেই আমার কি যে হলো, দরকারী কাজ শেষ করেই বাড়ীর পথ ধরলাম। অনেক ঝুট-ঝামেলা পার হয়ে যখন বাড়ী পৌঁছুলাম, তখনো ভোর হয়নি। বাড়ী ফেরার আনন্দ আমার কাছে সবসময়ই সুতীব্র, প্রশান্তিময়, মৌলিক ও বিশুদ্ধ। এবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে আদুরীর জন্য কলজে ছেঁড়া টান। অস্থির আবেগ নিয়ে আমি ডাকলাম-আম্মা, আম্মা। মা জেগেই ছিলেন, ঘরের ঝাপ খুললেন। আর, মুহুর্তেই কোত্থেকে যেন একটা ছোট্ট উড়ন্ত পাখী আমার কুলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আনন্দাশ্রু’র মতো পরম বিশুদ্ধ একটি আবেগজাত বিষয়কে গোপন করার অপক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দেননি। আমরাও সেই ক্ষমতার সামান্যমাত্র চেষ্টা না করে ‘মরা চাঁদে’র শেষ আলোর নীচে আবেগপ্লাবনে ভেসে গেলাম।
কিভাবে কিভাবে যেন আদুরী ছবি আঁকতে শিখেছে। পরীক্ষার পর যখন বাড়ী যাবো, যেন রঙ-পেন্সিল নিয়ে যাই, আমাকে কিছু ছবি এঁকে দিবে, এমন কথাই আমাদের হয়েছিল। আহারে, দরদী স্বপ্নচারী অভাগা বোন আমার।
আব্বাকে লেখা এই চিঠিটা ভিক্তর মাৎসুলেনকো’র ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’- বইয়ের ৮০-৮১ পৃষ্ঠার ভাঁজে রাখা আছে। আলসেমী করে চিঠিটা পোস্ট করা হয়নি, সেই সুযোগও আসবেনা আর কোনদিন।
“বাজান’গো,
আপনার চিঠি পেলে আমার যে কি ভালো লাগে বুঝাতে পারবোনা। এখন পর্যন্ত কতবার যে পড়েছি আপনার চিঠিখানা, গুনে শেষ করতে পারবোনা। আপনার হাতের লেখাও কিন্তু মাশাআল্লাহ। এত দ্রুত আপনার উন্নতি হচ্ছে দেখে খুব খুশী হয়েছি। কুমুদখালী যাবার দিন-তারিখ সব ঠিক আছে আশা করি। যে আলোয় আপনারা আলোকিত হয়েছেন, আশা করি সেই আলোতে কুমুদখালী’র অন্ধকারও আপনারা দূর করবেন।
আমার অনার্স ফাইনাল (এই পরীক্ষা পাশ দিলেই আমি চাকরী করতে পারবো) পরীক্ষার আর তিনমাস বাকী। আমি খুব লেখাপড়া করছি। পরীক্ষা ভালো হবে ইনশাল্লাহ। দোয়া করবেন।
আব্বা, এই জীবনে আপনি অনেক কষ্ট করেছেন, আশা করি এবার সব কষ্ট শেষ হবে। বিলাতের এক কবিয়াল আছেন, তার নাম শেলী। উনি তার এক পদ্যে বলেছেন- শীত যখন আসে, তখন বুঝতে হবে সামনেই বসন্ত। আমাদেরও সামনে সুখের বসন্তকাল। আর কয়েকটা দিন সবুর করেন আব্বা ।
আদুরী কেমন আছে? এইবার বাড়ী আসলে ওর রঙ-পেন্সিল নিয়ে আসবো, আদুরী’কে বলে দিবেন। একটা ছবি পাঠালাম আদুরীর জন্য, ছবির এই বিদেশী (বাড়ী রাশিয়ায়) মহিলার নাম ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। এখন থেকে আরো ঊনচল্লিশ বছর আগে, ১৯৬৩ সালে প্রথম মহিলা হিসাবে ইনি মহাকাশ প্রদক্ষিণ করেছেন।
আম্মা’র লেখাপড়ার কতদূর ঊন্নতি হয়েছে? আম্মা’কে বলবেন, আম্মা’র নিজের হাতের লেখা চিঠি পড়ার সৌভাগ্য আমার যেদিন হবে, সেইদিন আমার মতো সুখী আর কেউ হবেনা। আমি সেই সুখের অপেক্ষায় আছি।
ইতি,
আপনার ফিরোজ
একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। এখন মেঘ সরে সকালের আলো ফুটে উঠেছে। ধীরে ধীরে জেগে উঠছে সমস্ত গ্রাম, শহর, চরাচর। শুধু আমার আর জেগে উঠা হবেনা। ডুমনী বিলের ভরা বর্ষার থৈ থৈ পানি, সেই পানিতে ঢেউয়ের তালে তালে লাশ হয়ে আমি ভাসছি। আমার সাথে সাথে পানিতে ভাসছে আমার এবং আমার স্বজন-সুহৃদ’দের অনেক স্বপ্ন। আগামীকাল এই সময়ের মধ্যে আমি সমাহিত হবো। আমার সাথে সাথে সব স্বপ্নরাও হবে সমাহিত। অথচ কি আশ্চর্য, গতকাল ঠিক এই সময়েও আমি একজন স্বপ্নচারী জীবিত মানুষ ছিলাম।